সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক আলী রীয়াজ
ঐকমত্য হয়নি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক সংস্কারে
জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জুনের শুরুতে দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা শুরুর পরিকল্পনা
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৭ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রশ্নে এখনো ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি। এর মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণের কাঠামো, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন, একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে কতবার নির্বাচিত হতে পারবেন, একজন সংসদ-সদস্য কতগুলো পদে থাকতে পারবেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়া কী হবে, সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়া কী হবে-এ ধরনের মৌলিক কাঠামোগত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অমীমাংসিত থেকে গেছে।
সোমবার জাতীয় সংসদের এলডি হলে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ এসব কথা বলেন। তিনি আরও জানান, যেসব বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি, সেসব বিষয়ে অনেক দলই আরও আলোচনার কথা বলেছে। তাই সংস্কারের ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা শুরুর পরিকল্পনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আগামী মাসের (জুন) শুরুতে দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা শুরু করা হবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ অন্যদের মতামতের ভিত্তিতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই জাতীয় সনদ প্রণয়ন করা সম্ভব হবে বলে আশা করি। তবে এ সনদ বাস্তবায়নের বিষয়টি সরকারের। রাজনৈতিক দলগুলো নির্ধারণ করবে প্রক্রিয়াটি কী হবে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে কোনো দ্বিমত নেই। এছাড়া দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের বিষয়েও বেশির ভাগ দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। কিছু দল অবশ্য এককক্ষবিশিষ্ট সংসদ বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। আর সংসদের নিম্নকক্ষে নারীর জন্য ১০০ আসন সংরক্ষণের প্রশ্নে এক ধরনের ঐকমত্য রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। তবে এর পদ্ধতি কী হবে, তা নিয়ে মতভিন্নতা রয়েছে। যারা সংসদের উভয়কক্ষের পক্ষে এবং যারা এককক্ষবিশিষ্ট আইন সভার পক্ষে, উভয়ই আইনসভার ব্যাপারে ডেপুটি স্পিকারের পদ বিরোধী দল থেকে দেওয়ার পক্ষে।
নির্বাচন ও সংস্কারের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই দাবি করে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, নির্বাচন ও সংস্কারের মধ্যে কল্পিত বিরোধ তৈরি করা হচ্ছে। নির্বাচনের প্রক্রিয়া চলুক এবং জাতীয় সনদ তৈরির প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে যাতে রাজনৈতিক কাঠামোটা এমনভাবে হয়, যার মধ্যে স্বৈরাচারীব্যবস্থা পুনরায় উত্থিত হতে না পারে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, ঐকমত্য কমিশন প্রস্তাবিত সংস্কার সংক্রান্ত সুপারিশগুলোর মধ্য থেকে নির্বাচিত কিছু বিষয়ে জনগণের মতামত জানতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মাধ্যমে একটি জরিপ পরিচালনার ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যে সুপারিশগুলো সম্পর্কে রাজনৈতিক দলের মতামত নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্য থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো সম্পর্কে জনগণের মতামত নেওয়ার উদ্দেশ্যে এ জরিপ পরিচালনা করা হবে। আগামী মাসেই এ জরিপ পরিচালনা করা হবে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোর ক্ষেত্রে অনেক বিষয়ে নীতিগত ঐকমত্য হলেও অনেক বিষয়ে আরও আলোচনার প্রয়োজন আছে। তিনি জানান, আইনসভার গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী কমিটিগুলোর সভাপতিত্ব পদ বিরোধী দলের সংসদ-সদস্যদের দেওয়ার ব্যাপারে প্রায় সবাই একমত। এক্ষেত্রে বিশেষ কয়েকটি কমিটি যেমন: পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি, এস্টিমেট কমিটি, পাবলিক আন্ডারটেকিং কমিটি, প্রিভিলেজ কমিটির সভাপতিত্ব বিরোধী দলের কাছে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপের ব্যাপার বিবেচনায় আছে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ আরও বলেন, সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনকে সেসব দল সমর্থন করে, তারা ১০০ জন সদস্য নিয়ে উচ্চকক্ষ গঠনের ব্যাপারে একমত। তবে এ প্রতিনিধিদের কীভাবে নির্বাচন করা হবে, সংবিধান সংস্কার কমিশন কর্তৃক প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারের সুপারিশে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন থাকলেও এই বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি। তিনি জানান, সংবিধান বিষয়ে ঐকমত্য বা আংশিক ঐকমত্য আছে, তার মধ্যে সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসাবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র’ অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবে ‘বহুত্ববাদ’ না রাখার ব্যাপারে বেশির ভাগ দল মতামত দিয়েছে। অন্য চারটি মূলনীতির ব্যাপারে একধরনের ঐকমত্য আছে। তবে অনেক দল এ চারটির বাইরেও অন্যান্য বিষয় যুক্ত করার কথা বলেছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি বলেন, নাগরিকদের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অধিকার সম্প্রসারিত করা এবং সেগুলোর কিছু কিছু বিষয় রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা তৈরি করা। তবে এই অধিকারের তালিকা এবং তার প্রয়োগে রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা এবং বিশেষ করে তার মাত্রা বিষয়ে মতপার্থক্য আছে। এছাড়াও সংবিধানের ৪৮(ক) অনুচ্ছেদ যা কার্যত রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নির্ধারণ করে, তা সংশোধনের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য কীভাবে হবে, সেই প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে।
অর্থবিল, আস্থা ভোট, সংবিধান সংশোধন বিলে দলীয় অনুশাসনে বাধ্যবাধকতা প্রসঙ্গে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ৭০ অনুচ্ছেদ, অর্থাৎ সংসদে নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে যে বিধান, তা পরিবর্তনের ব্যাপারে ঐকমত্য হলেও কী কী বিষয়ে দলের পক্ষে ভোট দেওয়া বাধ্যতামূলক হবে, তার একটি আংশিক তালিকার ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছে। এছাড়াও অর্থবিল, আস্থা ভোট, সংবিধান সংশোধন বিলের ব্যাপারে দলীয় অনুশাসনের বাধ্যবাধকতার ব্যাপারে বেশির ভাগ দল একমত, এর অতিরিক্ত আরও কিছু যুক্ত করার, যেমন: রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাবিষয়ক বিল যুক্ত করার জন্যও কিছু দলের প্রস্তাব আছে।
তিনি বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের সবগুলো সুপারিশের পক্ষেই মোটা দাগে রাজনৈতিক দলগুলো নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় ও আইনি ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে স্বার্থের দ্বন্দ্ব নিরসন ও প্রতিরোধসংক্রান্ত আইন প্রণয়নের সুপারিশের বিষয়ে সব দল একমত পোষণ করেছে। দুদকের স্বাধীনতা, কার্যকারিতা ও গতিশীলতার পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা, নৈতিকতা ও জবাবদিহিতার লক্ষ্যে প্রস্তাবিত সুপারিশমালা সম্পর্কে প্রায় সব দলই সম্পূর্ণ একমত। প্রতিষ্ঠান হিসাবে দুদককে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করার প্রস্তাবে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল একমত পোষণ করেছে। দু-একটি দল এ বিষয় নিয়ে নির্বাচিত সংসদে আলোচনা হতে পারে বলে মত দিয়েছে।
দুর্নীতিবিরোধী ন্যায়পালের পদ সৃষ্টি করে ন্যায়পালকে দুর্নীতিবিরোধী জাতীয় কৌশলপত্রের যথাযথ প্রতিপালন নিশ্চিত করার জন্য ক্ষমতায়িত করার প্রস্তাবে অধিকাংশ দল নীতিগতভাবে একমত পোষণ করেছে। তবে এই বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে গেছে, কেননা কোনো কোনো দল এই বিষয়ে আংশিক একমত। রাজনৈতিক ও নির্বাচনি অর্থায়নে স্বচ্ছতা ও শুদ্ধাচার চর্চা নিশ্চিতের লক্ষ্যে আনীত প্রস্তাবে নীতিগতভাবে বা আংশিক একমত হয়েছে সবগুলো দল। সেবা প্রদানকারী সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবা কার্যক্রম ও তথ্য-ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ (এন্ড-টু-এন্ড) অটোমেশনের আওতায় আনার প্রস্তাবে সব দল একমত পোষণ করেছে।
আলী রীয়াজ জানান, কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার রোধে বাংলাদেশকে রাষ্ট্রীয়ভাবে কমন রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড ও উন্মুক্ত সরকার ব্যবস্থায় সহায়ক হিসাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয়ভাবে উন্মুক্ত সরকারি অংশীদারত্বের পক্ষভুক্ত হওয়ার প্রস্তাবে অধিকাংশ দল একমত পোষণ করেছে। ইউএন কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট করাপশনের অনুচ্ছেদ ২১ অনুসারে বেসরকারি খাতের ঘুস লেনদেনকে স্বতন্ত্র অপরাধ হিসাবে শাস্তির আওতায় আনার সুপারিশে সব দল একমত পোষণ করেছে।
এছাড়া বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপারিশের মধ্যে বেশ কিছু বিষয়ে ঐকমত্য লক্ষণীয়। এর মধ্যে আছে-নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে কার্যকরভাবে পৃথকীকরণের জন্য সুপ্রিমকোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা এবং প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা। এই সুপারিশের ব্যাপারে সব দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। বিচারকদের চাকরির নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে সুপ্রিমকোর্টের ওপর ন্যস্ত করার জন্য সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ ও সংশ্লিষ্ট বিধিমালা সংশোধন করার সুপারিশের বিষয়ে একমত পোষণ করেছে।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা রদ করে আপিল বিভাগের কর্মে প্রবীণতম বিচারককে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করার প্রস্তাবে অধিকাংশ দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। কোনো কোনো দল প্রবীণতম তিনজন বিচারকের মধ্য থেকে একজনকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। আপিল বিভাগের ন্যূনতম বিচারক সংখ্যা ৭ জন নির্ধারণ এবং প্রধান বিচারপতির চাহিদা মোতাবেক সময়ে সময়ে আপিল এবং হাইকোর্ট বিভাগে প্রয়োজনীয়সংখ্যক বিচারপতি নিয়োগ করার প্রস্তাবে সব দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। জুডিশিয়াল কাউন্সিল কর্তৃক সাবেক বিচারপতিদের জন্য পালনীয় আচরণবিধি প্রণয়ন ও প্রকাশ, শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা হিসাবে সতর্ক করা ও উপযুক্ত ক্ষেত্রে বিচারপতি পদবি ব্যবহার থেকে বিরত করার সুপারিশের সঙ্গে নীতিগত একমত পোষণ করেছে।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন আইন নামে একটি আইন প্রণয়ন ক্ষমা প্রদর্শন বোর্ড স্থাপন এবং বোর্ডের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে দণ্ডিত অপরাধীকে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ক্ষমা প্রদর্শন করার সুপারিশের বিষয়ে সব দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। তবে একটি-দুটি দল ভিন্নমত প্রকাশ করেছে। আইনগত সহায়তাকে অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধনের সুপারিশে সব দল একমত পোষণ করেছে। আইনজীবী সমিতি নির্বাচন ও বার কাউন্সিল নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইযের ক্ষেত্রে এবং নির্বাচন পরিচালনায় দলীয় রাজনীতির প্রভাব বিলোপের জন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের যে কোনো সংগঠনকে স্বীকৃতি না দেওয়ার প্রস্তাবে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে দলগুলো। কোনো কোনো দল আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে আলোচনা শেষে নির্বাচন কমিশনের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন করার ব্যাপারে অধিকাংশ দল একমত হয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের কাছে হস্তান্তর করার ব্যাপারে সব দল একমত পোষণ করেছে। দলনিরপেক্ষ, সৎ, যোগ্য ও সুনামসম্পন্ন ব্যক্তির রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার বিধান করার ব্যাপারে অধিকাংশ দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। ভবিষ্যতে সীমানা নির্ধারণের জন্য একটি আলাদা স্বাধীন সীমানা নির্ধারণ কর্তৃপক্ষ গঠন করার ব্যাপারে অধিকাংশ দল নীতিগতভাবে একমত। তবে এ ব্যাপারে মতের ভিন্নতা আছে। নির্বাচন কমিশনের আইনি, আর্থিক ও প্রশাসনিক প্রস্তাব কোনো মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে সংসদের প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষের স্পিকারের নেতৃত্বে একটি সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির কাছে উপস্থাপনের বিধান করার ব্যাপারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে দলগুলো।
সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে কিংবা শপথভঙ্গ করলে কমিশনারদের মেয়াদ পরবর্তী সময়ে উত্থাপিত অভিযোগ প্রস্তাবিত সংসদীয় কমিটি তদন্ত করে সুপারিশসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণের বিধান করার ব্যাপারে বেশির ভাগ দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে ‘তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯’-এর আওতাভুক্ত করার প্রস্তাবে বেশির ভাগ দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত করার লক্ষ্যে মানবতাবিরোধী (ট্রাইব্যুনাল) আইন ও আরপিও সংশোধন করার ব্যাপারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে দলগুলো। এর আইনি দিক বিবেচনার জন্য অধিকাংশ দল গুরুত্ব দিয়েছে।
কমিশনের দেওয়া সুপারিশগুলোর ক্ষেত্রে জুলাই অভ্যুত্থান গণহত্যা ও নিপীড়নের সঙ্গে জড়িত এবং ভোট জালিয়াতি ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের চিহ্নিতকরণ এবং তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করার ব্যাপারে অধিকাংশ দল একমত পোষণ করেছে। তথ্য অধিকার আইন ২০০৯-এর সংশোধন করার প্রস্তাবে সব দল একমত পোষণ করেছে। অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩ সংশোধন করার প্রস্তাবে সব দল নীতিগতভাবে একমত পোষণ করেছে। বর্তমান পাবলিক সার্ভিস কমিশন পুনর্গঠনের মাধ্যমে ৮ সদস্যবিশিষ্ট পৃথক তিনটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন করার ব্যাপারে অধিকাংশ দল নীতিগতভাবে একমত পোষণ করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন-ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের মধ্যে ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
প্রসঙ্গত, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৪ সালের অক্টোবরে ৬টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এই কমিশনগুলো ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের সুপারিশ সংবলিত প্রতিবেদন সরকারের কাছে পেশ করে। পরে ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা তার নেতৃত্বে একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করেন। কমিশন ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তার কাজ শুরু করে। এই কমিশনের দায়িত্ব হলো রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো এবং একটি ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়ন করা। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ছয়টি কমিশনের প্রতিবেদনের প্রিন্টকপি এবং পরে ৫টি কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন থেকে গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ নিয়ে স্প্রেডশিট আকারে ৩৯টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে তাদের মতামত প্রদানের জন্য প্রেরণ করে। ১৬৬টি সুপারিশের মধ্যে সংবিধান সংস্কারসংক্রান্ত সুপারিশ ছিল ৭০টি, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে ২৭টি, বিচার বিভাগ সংক্রান্ত ২৩টি, জনপ্রশাসন সংক্রান্ত ২৬টি এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সুপারিশ ছিল ২০টি। লিখিত মতামতের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম দফা সংলাপ গত ২০ মার্চ শুরু হয়। এরপর ১৯ মে পর্যন্ত ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ৪৫টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনার সুবিধার্থে কয়েকটি দলের সঙ্গে একাধিক দিনও বৈঠক চলে। সর্বশেষ ২৫ মে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপ হয়েছে।
