Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

দেশব্যাপী একযোগে কর্মসূচি পালনের ডাক

বিক্ষোভে উত্তাল সচিবালয়

কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে আরও কঠোর আন্দোলন * সচিবালয় ও সংলগ্ন এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করল ডিএমপি * সচিবালয়ে আজ দর্শনার্থী প্রবেশ বন্ধ থাকবে

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২৭ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিক্ষোভে উত্তাল সচিবালয়

‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ প্রত্যাহারের দাবিতে বিক্ষোভে উত্তাল প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়। টানা তৃতীয় দিনের মতো সোমবারও সচিবালয়ের ভেতরে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মচারী এবং নন-ক্যাডার কর্মকর্তারা। তারা সচিবালয়ের প্রধান ফটক আটকে দিয়ে বিক্ষোভ করায় অন্যান্য প্রবেশ পথও কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে একাধিক উপদেষ্টা ও কয়েক সচিব সচিবালয়ে প্রবেশ করতে পারেননি। গেটের সামনে থেকে উপদেষ্টা ও সচিবদের গাড়ি ফেরত গেছে। কর্মচারীদের বিক্ষোভে উত্তাল সচিবালয়ে এদিনও তেমন কাজ হয়নি। স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন সচিবের অপসারণ দাবি করেন তারা। প্রশাসনের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে নেতারা বলেন, কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে আরও কঠোর আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে। তারা একসঙ্গে এই কর্মসূচি পালনের জন্য সচিবালয়ের বাইরে দেশের সব সরকারি দপ্তর, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, বিভাগীয় কমিশনারের দপ্তর, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের দপ্তরের কর্মচারীদের প্রতি আহ্বান জানান। নেতারা বলেন, এই কালো অধ্যাদেশ বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। আজ থেকে ঢাকার বাইরের কর্মচারীরাও এই কর্মসূচি পালন করবেন। আজ সচিবালয়ে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশসহ অন্যান্য কর্মসূচি পালনের জন্য সবাইকে বাদামতলায় সমবেত হওয়ার আহবান জানান তারা। এদিকে সচিবালয়সংলগ্ন এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে ডিএমপি। মঙ্গলবার সচিবালয়ে দর্শনার্থী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের নেতারা বলেছেন, কর্মচারীর দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।

প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে ৩টা পর্যন্ত সংগঠনটির নেতারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের উপদেষ্টা ও সিনিয়র সচিব এবং সচিবদের সঙ্গে সংকট নিরসনে আলোচনা চালিয়ে যাবেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের অপসারণের দাবিতে প্রধান উপদেষ্টাকে স্মারকলিপি দেবেন সংগঠনটির নেতারা। কারণ তারা ফ্যাসিবাদের দোসরদের আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়েছেন। তারা প্রশাসন পরিচালনায় সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। সংগঠনের সভাপতি ও সাবেক সচিব এ বি এম আব্দুস সাত্তার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। 

এদিকে সংস্কারে বাধা দিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারকে জিম্মি করলে পরিস্থিতি ভালো হবে না বলে হুঁশিয়ার করেছেন এনসিপি দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, কর্মচারীরা সরকারের কাজে বাধা দিলে, হুমকি দিলে জনগণই তাদের বিকল্প খুঁজে নেবে। প্রায় একই রকম হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে ফেসবুক পোস্ট করেছেন দলটির অন্যতম নেতা আব্দুল হান্নান মাসউদ। 

সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ খসড়া বাতিলের দাবিতে গত কয়েক দিন ধরেই আন্দোলন করছেন সচিবালয়ের কর্মচারী ও নন-ক্যাডার কর্মকর্তারা। তাদের আন্দোলনের মধ্যেই রোববার সন্ধ্যায় চাকরিচ্যুতির মতো শাস্তির বিধান রেখেই সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’র গেজেট প্রকাশ করে সরকার। এরপর সোমবার আন্দোলন আরও বেগবান হয়। সোমবার সকাল ১০টায় সচিবালয়ের কর্মকর্তা কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের দুই অংশের নেতারা চার নম্বর ভবনের পেছনের টিনশেডে বসে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। পরে বেলা ১১টার দিকে অধ্যাদেশটি প্রত্যাহারের দাবিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মচারী মিছিল নিয়ে সচিবালয়ের বাদামতলায় জমায়েত হন। শুরুতে বাদিউল কবিরের নেতৃত্বে একটি মিছিলে এসে বাদামতলায় সমবেত হয়। এরপর নূরুল ইসলামের নেতৃত্বে আরেকটি মিছিল বাদামতলায় আসে। এর একটু পরেই আন্তঃমন্ত্রণালয় কর্মচারী ফোরামের আহ্বায়ক মো. নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি মিছিল এসে আগের দুটি মিছিলের সঙ্গে সমবেত হয়। 

মহিলা কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছেন। তারা সচিবালয়ের ভেতর বিভিন্ন এলাকা প্রদক্ষিণ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নতুন ভবনের নিচে সমাবেশ করেন। এরপর মিছিল নিয়ে বাদামতলায় জমায়েত হন। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা সচিবালয়ের মূল ফটকের কাছে অবস্থান নেন। এ সময় প্রধান ফটকসহ সচিবালয়ের বিভিন্ন ফটক বেশ কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের অপসারণ চান। সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ জারির জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে দায়ী করে স্লোগান দিতে দেখা গেছে। সেখান থেকে সরে এসে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নতুন ভবনের নিচে অবস্থান নেন কর্মচারীরা। কর্মচারী নেতারা জানান, সোমবার দুপুরে আইন উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের কথা ছিল। কিন্তু উপদেষ্টা রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ত থাকায় বৈঠকটি হচ্ছে না। কর্মচারী নেতারা জানান, তাদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। এখন থেকে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরাম নামে আগামী দিনের কর্মসূচি চলবে। মঙ্গলবার আবারও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হবে। মঙ্গলবার সকাল ১০টায় সচিবালয়ের বাদামতলায় সবাইকে সমবেত হওয়ার আহবান জানান তারা।

সারা দেশের কর্মচারীদের ডাক দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে কর্মচারী নেতারা বলেন, এটা একক কোনো কর্মচারীর আন্দোলন নয়। বরং সব কর্মচারীর অস্তিত্ব ও মর্যাদার লড়াই। নবগঠিত ফোরামের কো-চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের একাংশের সভাপতি মো. বাদিউল কবির বলেন, কালো আইন প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। অধ্যাদেশটি বাতিলের সঙ্গে সঙ্গে চলমান কর্মসূচি সমাপ্ত হবে। তিনি মঙ্গলবার সকাল ১০টায় সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে মিছিল নিয়ে সচিবালয়ে বাদামতলায় সমবেত হওয়ার আহ্বান জানান।

ঐক্য ফোরামের কো-চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের আরেকাংশের সভাপতি মুহা. নূরুল ইসলাম বলেন, সারা দেশের কর্মচারীরা তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। যদি কোনো কর্মচারীকে হয়রানি করা হয়, তাহলে কঠোর আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে। 

এদিকে সকাল থেকে সচিবালয়ে অবস্থান করলেও কারও সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করেননি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান। সচিবের দপ্তর থেকে জানানো হয় তিনি অফিসে আছেন তবে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসা সাবেক সচিব ও বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের কার্যকরি সভাপতি মো. আব্দুল খালেক যুগান্তরকে বলেন, জনপ্রশাসন সচিব অফিসেই আছেন, তবে তিনি কারও সঙ্গে দেখা করেননি। আব্দুল খালেক আরও বলেন, আমরাও তার সাক্ষাৎ পাইনি। আমরা সচিবের একান্ত সচিবকে (পিএস) বলেছি-আমাদের দাবির আলোকে ফ্যাসিবাদের দোসর সচিব ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত বিতর্কিত কর্মকর্তাদের সোমবার সন্ধ্যার মধ্যে প্রত্যাহার করতে হবে। অন্যথায় কঠোর কর্মসূচি দেবে বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম। 

অধ্যাদেশ অনুযায়ী, সরকারি কর্মচারীদের (আইনানুযায়ী সবাই কর্মচারী) চারটি বিষয়কে অপরাধের আওতাভুক্ত করা হয়। সেগুলো হলো-সরকারি কর্মচারী যদি এমন কোনো কাজে লিপ্ত হন, যা অনানুগত্যের শামিল বা যা অন্য যেকোনো সরকারি কর্মচারীর মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি করে বা শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধার সৃষ্টি করে; অন্যান্য কর্মচারীর সঙ্গে সমবেতভাবে বা এককভাবে ছুটি ছাড়া বা কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া নিজ কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকেন বা বিরত থাকেন বা কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ হন, অন্য যেকোনো কর্মচারীকে তার কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকতে বা বিরত থাকতে বা তার কর্তব্য পালন না করার জন্য উসকানি দেন বা প্ররোচিত করেন এবং যেকোনো সরকারি কর্মচারীকে তার কর্মে উপস্থিত হতে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধাগ্রস্ত করেন, তাহলে তিনি অসদাচরণের দায়ে দণ্ডিত হবেন। এসব অপরাধের শাস্তি হিসাবে বলা হয়েছিল, দোষী কর্মচারীকে নিম্নপদ বা নিম্ন বেতন গ্রেডে নামিয়ে দেওয়া, চাকরি হতে অপসারণ বা চাকরি থেকে বরখাস্ত করার দণ্ড দেওয়া যাবে।

সচিবালয় ও সংলগ্ন এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করল ডিএমপি : বাংলাদেশ সচিবালয় ও সংলগ্ন এলাকায় সভা-সমাবেশ, গণজমায়েত, মিছিল ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সোমবার রাতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এছাড়া আজ মঙ্গলবার সচিবালয়ে সব ধরনের দর্শনার্থীর প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

ডিএমপির ডিসি (মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশন্স) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, গত ১০ মে ২০২৫ ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের জারি করা গণবিজ্ঞপ্তি মোতাবেক বাংলাদেশ সচিবালয় এবং প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় যেকোনো প্রকার সভা-সমাবেশ, গণজমায়েত, মিছিল ও শোভাযাত্রা ইত্যাদি নিষিদ্ধ রয়েছে। এমতাবস্থায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে ওই নির্দেশনা মেনে চলার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ করা হলো।

এদিকে সোমবার রাতে সচিবালয় নিরাপত্তা শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসচিব আব্দুল্লাহ আল জাবেদ স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে, মঙ্গলবার সচিবালয়ে সব ধরনের দর্শনার্থীর প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, অনিবার্য কারণে মঙ্গলবার সচিবালয়ে সব ধরনের দর্শনার্থীর প্রবেশ বন্ধ থাকবে।


বিক্ষোভ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম