অবসান হচ্ছে ১৩ বছরের বন্দিজীবন
এটিএম আজহার খালাস যে কোনো মুহূর্তে মুক্তি
আপিল বিভাগের রায়: মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ সম্পর্কিত প্রমাণ সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে আগের ব্যর্থতা স্বীকার করছেন আদালত-পর্যবেক্ষণ
আলমগীর মিয়া
প্রকাশ: ২৮ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে খালাস পেয়েছেন জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম। দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আজহারুলের করা আপিল সর্বসম্মতিতে মঞ্জুর করেছেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের বেঞ্চ মঙ্গলবার এ রায় দেন। সেখানে বলা হয়, এই মামলায় আজহারুলকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রেখে আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছিলেন, তা বাতিল করা হলো। অন্য কোনো মামলা না থাকলে আজহারুলকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে আগের রায়ের জন্য অনুতপ্ত হয়েছেন আপিল বিভাগ। মুক্তিযুদ্ধকালের মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো মামলায় রিভিউ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিলে এই প্রথম কেউ খালাস পেলেন। প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর যে কোনো মুহূর্তে তাকে মুক্তি দেওয়া হবে। এর মধ্য দিয়ে অবসান হচ্ছে আজহারের ১৩ বছরের বন্দিজীবন।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ, নির্যাতনের ছয় ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত করে ২০১৪ সালে আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ২০১৯ সালে প্রথমবার আপিল শুনানি করে সেই রায় বহাল রেখেছিলেন তখনকার আপিল বেঞ্চ। ওই দুই রায় বাতিল করে এখনকার আপিল বিভাগ বলেছেন, যেসব তথ্যপ্রমাণ এই মামলায় ছিল, তা অতীতের আপিল বিভাগ সঠিকভাবে বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আপিল বিভাগ এটিএম আজহারুল ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ সম্পর্কিত প্রমাণ সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে তার আগের ব্যর্থতা স্বীকার করছে। আপিল বেঞ্চের অন্য ৬ বিচারপতি হলেন-বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি ইমদাদুল হক, বিচারপতি মো. আসাদুজ্জামান, বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।
রায়ের পর আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ফেসবুকে তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, এই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টির কৃতিত্ব জুলাই গণ-আন্দোলনের অকুতোভয় নেতৃত্বের। এই সুযোগকে রক্ষা করার দায়িত্ব এখন আমাদের সবার।
রায়ের খবর শোনার পর বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রিজন সেলে চিকিৎসাধীন এটিএম আজহারকে মিষ্টিমুখ করান তার পরিবারের সদস্যরা। আজহারের আইনজীবী মো. শিশির মনির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এই রায়ের মধ্য দিয়ে সত্য জয়ী হয়েছে, মিথ্যা পরাজিত হয়েছে। রায়ের সময় রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক। রায়ের পর তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। খালাসের রায়ের মাধ্যমে সত্যের বিজয় হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।
এদিকে মঙ্গলবার বিকালে রায়ের কপি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পৌঁছানো হয়। এরপর প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সংশ্লিষ্ট কারাগারে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম। কারা কর্তৃপক্ষ এখন বিধি মোতাবেক এটিএম আজহারের মুক্তির ব্যবস্থা করবেন।
প্রসঙ্গত, এই মামলায় আপিলের ওপর শুনানি শেষে ৮ মে আপিল বিভাগ রায় ঘোষণার জন্য ২৭ মে তারিখ ধার্য করেছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় আপিলটি রায় ঘোষণার জন্য মঙ্গলবারের কার্যতালিকায় এক নম্বর ক্রমিকে ছিল। আসন গ্রহণের পর সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটের দিকে রায় ঘোষণা করেন আদালত।
সংক্ষিপ্ত রায়ে আদালত যা বললেন : মঙ্গলবার বিকালে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদসহ ৭ বিচারপতির স্বাক্ষরের ৩ পৃষ্ঠার এ রায় প্রকাশ করা হয়। খালাসের রায়ে আপিল বিভাগ বলেন, বস্তুগত প্রমাণ এবং দাখিল করা আইনি যুক্তিতর্ক পুঙ্খানুপুঙ্খ পুনর্মূল্যায়নের পর, আপিল বিভাগ বিবেচনা করছে যে, এটিএম আজহারুল ইসলামকে দোষী সাব্যস্ত করা ছিল ফৌজদারি আইনশাস্ত্রের মৌলিক নীতিগুলোর প্রতি স্পষ্ট অবজ্ঞা। ফলে ন্যায়বিচারের চরম অবহেলা ঘটেছে। এছাড়া আপিল বিভাগ এটিএম আজহারুল ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ সম্পর্কিত প্রমাণ সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে তার আগের ব্যর্থতা স্বীকার করছে। এই মৌলিক নীতিগুলো মেনে চলতে ব্যর্থতার ফলে ন্যায়বিচারের প্রতি চরম অবজ্ঞা করা হয়েছে। সংক্ষিপ্ত রায়ে আপিল বিভাগ বলেন, আদালত বিচারিক দায়িত্বের গভীর বোধের সঙ্গে স্বীকার করেন যে, তার পূর্ববর্তী রায়ে, তারা এটিএম আজহারুলের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ ও তাকে দোষী হিসাবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আপিল বিভাগের পূর্ববর্তী রায়টি দুঃখজনকভাবে এত গুরুতর প্রকৃতির ফৌজদারি কার্যধারায় যাচাই-বাছাই এবং ন্যায্যতার উচ্চমান পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
রায়ে আদালত বলেন, আপিল বিভাগ আরও দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করেন যে, আগের রায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের বৃহত্তর প্রেক্ষাপট এবং রাষ্ট্রপক্ষের মামলার অন্তর্নিহিত প্রমাণের দুর্বলতাগুলোর প্রতি যথাযথ বিবেচনা করা হয়নি। তাই ন্যায়বিচারের স্বার্থে এটিএম আজহারুল ইসলামকে দোষী সাব্যস্তকরণ এবং তার সাজা বহাল রাখা সম্ভব নয়। আদালত আরও বলেন, আপিলকারী এটিএম আজহারুল ইসলামকে সব অভিযোগ থেকে খালাস ও অবিলম্বে জেল হেফাজত থেকে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো।
এই মামলায় ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আজহারুলকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় দেন। দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি আপিল করেন আজহারুল। এই আপিলের শুনানি শেষে ২০১৯ সালের ৩০ অক্টোবর আপিল বিভাগ রায় দেন। ২০২০ সালের ১৫ মার্চ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর তা পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে ২০২০ সালের ১৯ জুলাই আপিল বিভাগে আবেদন করেন আজহারুল। ২৩ পৃষ্ঠার আবেদনে ১৪টি যুক্তি উপস্থাপন করা হয়। এই পুনর্বিবেচনার আবেদনের শুনানি শেষে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি লিভ মঞ্জুর করে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। পাশাপাশি দুই সপ্তাহের মধ্যে আপিলের সংক্ষিপ্তসার জমা দিতে বলা হয়।
পরে আপিলের সংক্ষিপ্তসার জমা দেওয়া হয়। এ আপিলের ওপর শুনানি শেষে মঙ্গলবার রায় দিলেন আপিল বিভাগ। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ২২ আগস্ট মগবাজারের বাসা থেকে আজহারুলকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। আজহারুল ১৩ বছর যাবৎ কারাগারে আছেন।
আদালতে আপিলকারীর পক্ষে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির শুনানি করেন। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী সৈয়দ মো. রায়হান উদ্দিন। রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক ও প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম শুনানিতে অংশ নেন। রায় ঘোষণার সময় উপস্থিত ছিলেন জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম মাছুম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান, এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, মোয়াজ্জেম হোসেন হেলাল, নির্বাহী পরিষদ সদস্য আবদুল হালিম, মোবারক হোসাইন, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে মাসুদ সাঈদী ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি দেলোয়ার হোসেন সাঈদীসহ আরও অনেকে।
আদালতের পর্যবেক্ষণ প্রসঙ্গে যা বললেন শিশির মনির : রায়ের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে আদালতের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন আজহারের আইনজীবী শিশির মনির। তিনি বলেন, আদালত বলেছেন, অতীতের রায়ে বাংলাদেশসহ এই ভারতীয় সাব কনটিনেন্টের ক্রিমিনাল বিচারব্যবস্থার পদ্ধতি চেইঞ্জ করে দেওয়া হয়েছিল। এটা ছিল সবচাইতে বড় ভুল। আরও বলেছেন, আদালতের সামনে উপস্থাপিত সাক্ষ্যপ্রমাণ অ্যাসেসমেন্ট করা ছাড়াই এটি আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এবং আরেকটি ইম্পর্টেন্ট কথা বলেছেন যে, পৃথিবীর ইতিহাসে এটি একটি ট্রাবেস্ট্রি অব ট্রুথ, অর্থাৎ বিচারের নামে অবিচার। আরও বলেছেন, যেসব তথ্যপ্রমাণ আদালতে হাজির করা হয়েছিল, অতীতের আপিল বিভাগ তা সঠিকভাবে বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে আজকে এটিএম আজহারকে বেকসুর খালাস প্রদান করেছেন আপিল বিভাগ। বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা হয়ে থাকবে। এর মাধ্যমে আমরা মনে করি, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সত্য বিজয়ী হয়েছে, মিথ্যা পরাজিত হয়েছে। যুদ্ধাপরাধ মামলায় এর আগে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির ছয়জন শীর্ষ নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার প্রসঙ্গ ধরে শিশির মনির বলেন, পাঁচজন, অন্ততপক্ষে পাঁচজন জেলেই মৃত্যুবরণ করেছেন। দুনিয়ার ইতিহাসে এটা নজিরবিহীন নির্যাতনের শামিল। এটিএম আজহারুল ইসলাম সৌভাগ্যবান, তিনি ন্যায়বিচার পেয়েছেন। আল্লাহতায়ালা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। তাই আমরা এটা মনে করি, এই রায়ের মাধ্যমে ‘সিন্ডিকেটেড ইনজাস্টিস’ অবসান হয়েছে। আমরা এটাও মনে করি, এই রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মর্যাদা সমুন্নত হয়েছে। এই আইনজীবী বলেন, এখন থেকে জামায়াতে ইসলামের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম ইজ অ্যান ইনোসেন্ট ম্যান। শিশির মনির বলেন, তারা আদালতের কাছে একটি ‘শর্ট অর্ডার’ চেয়েছিলেন, আদালত তা মঞ্জুর করেছেন। আদালত বলেছেন, আমরা চেষ্টা করব আজকেই যেন এবং আজকে বা কালকের মধ্যে যেন এই শর্ট অর্ডারটা প্রসেস হয়ে এটিএম আজহারুল ইসলাম মুক্তি পেতে পারেন। এজন্য সব আইনি ব্যবস্থা আমরা গ্রহণ করব।
