Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

জুলাই হত্যাকাণ্ডে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জমা আজ

হাসিনার বিচার প্রক্রিয়া শুরু

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপি আসামি

Icon

আলমগীর মিয়া

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) জমা দেওয়া হবে আজ রোববার। প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বহুল প্রতীক্ষিত এই ফরমাল চার্জ দাখিল করবেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। শেখ হাসিনার পাশাপাশি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং অভ্যুত্থান সময়ের আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে আসামি করা হয়েছে আনুষ্ঠানিক অভিযোগে। এতে বলা হয়েছে, আন্দোলনে দেশব্যাপী মানবতাবিরোধী অপরাধ, হত্যাকাণ্ড ও লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার মতো অমানবিক কর্মকাণ্ডের প্রধান মাস্টারমাইন্ড ছিলেন শেখ হাসিনা।

ট্রাইব্যুনাল ফরমাল চার্জ গ্রহণের পর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচারিক কার্যক্রম শুরু করবেন। যেসব আসামি গ্রেফতার আছেন, তাদের আইনজীবীদের প্রস্তুতির জন্য নির্দিষ্ট সময় দেওয়া হবে। প্রসিকিউশনের ওপেনিং স্টেটমেন্টের মাধ্যমে মূল কার্যক্রম শুরু হবে। প্রসিকিউশন জানায়, পাঁচটি অভিযোগ দাখিলের মাধ্যমে শেখ হাসিনার আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে আজ।

এদিকে বিচারের স্বচ্ছতার লক্ষ্যে রোববারের ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রম বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) সরাসরি সম্প্রচার করবে বলে প্রসিকিউশন জানিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির নাৎসি বাহিনীর বিচারে গঠিত হয় নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল। ১৯৪৫-৪৬ সালে সেই ট্রাইব্যুনালে বিচার সরাসরি টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়। সবশেষ ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন বা মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট মুরসির বিচার শুনানি দেখেছে বিশ্ব। বিচারের স্বচ্ছতার বিবেচনায় এবার সেই কাতারে নাম লেখাচ্ছে বাংলাদেশ। এমন উদ্যোগকে বিচার বিভাগের নতুন অধ্যায়ের সূচনা বলছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। এতে আইনি বাধা নয়, বিচারের স্বচ্ছতা বাড়বে বলে মনে করছেন তারা।

আনুষ্ঠানিক অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম শনিবার যুগান্তরকে বলেন, রোববার (১ জুন) শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জমা দেওয়া হবে। আশা করছি চলতি মাসেই এ মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু করতে পারব। এর আগে শনিবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় তাজুল ইসলাম বলেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রোববার আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ দাখিল করা হবে। তিনি বলেন, আমরা বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। শেখ হাসিনাকে ‘গুম ও আয়নাঘরের নিউক্লিয়াস’ বলে উল্লেখ করেন তাজুল ইসলাম। বিচারের ক্ষেত্রে ডিসেম্বরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যাবে বলে জানান তিনি।

১২ মে পাঁচটি অভিযোগ এনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন জমা দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। নিয়মানুযায়ী তদন্ত সংস্থার জমা দেওয়া সব তথ্যপ্রমাণ ও আলামত চিফ প্রসিকিউটর আইন অনুযায়ী বিশ্লেষণ করেন। তিনি তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে বিচারের জন্য দাখিল করবেন।

চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, তদন্ত শুরুর ৬ মাস ২৮ দিনের মধ্যে প্রধান মাস্টারমাইন্ড, হুকুমদাতা ও সুপিরিয়র কমান্ডার হিসাবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রিপোর্ট দাখিল করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা। এতে জুলাই অভ্যুত্থানে দেশব্যাপী যে মানবতাবিরোধী অপরাধ, হত্যাকাণ্ড, গুলি করে আহত, লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার মতো অমানবিক কর্মকাণ্ড হয়েছিল এর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে মূলত পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে উসকানি ও প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৪ জুলাই প্রেস কনফারেন্সে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের তিনি রাজাকারের বাচ্চা, রাজাকারের নাতিপুতি বলেছিলেন। তার এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও সহযোগী বাহিনী অক্সিলারি ফোর্স হিসাবে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, হত্যা করে, আহত করে এবং অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধ করে। দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, সরাসরি শেখ হাসিনার নির্দেশে জুলাই আন্দোলনে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। শেখ হাসিনার এরকম অনেক টেলিফোন কনভারসেশন জব্দ করেছে তদন্ত সংস্থা। তিনি (শেখ হাসিনা) রাষ্ট্রীয় সব বাহিনীকে হেলিকপ্টার, ড্রোন, এপিসিসহ মারণাস্ত্র ব্যবহার করে নিরস্ত্র, নিরীহ আন্দোলনকারী সিভিলিয়ান পপুলেশন, তাদের সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন বা নির্মূল করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে হত্যার নির্দেশ, গুলি করে আহত করার নির্দেশ এবং সহযোগিতা করার অভিযোগ আনা হয়েছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। তাজুল ইসলাম বলেন, বাকি তিনটি অভিযোগ নির্দিষ্ট ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে।

প্রসিকিউশনের একটি সূত্র জানায়, আনুষ্ঠানিক অভিযোগে তিনটি চার্জের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যাত্রাবাড়ীতে বিপুলসংখ্যক মানুষকে হত্যা, রামপুরায় ভবনের ছাদের কার্নিশে ঝুলে থাকা তরুণকে গুলি করে হত্যা ও হেলিকপ্টার থেকে গুলিসহ সাভার-আশুলিয়ায় কয়েকটি ঘটনার আরও তিনটি চার্জ আনা হতে পারে। প্রসিকিউশন আরও জানায়, জুলাইয়ের আন্দোলন দমাতে প্রায় দেড় হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছে। ২৫ হাজারের বেশি মানুষকে গুলি করে আহত করা হয়েছে। নারীদের ওপর সহিংসতা, ‘টার্গেট’ করে শিশুদের হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পর লাশ ও জীবিত মানুষকে একত্রিত করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আহতদের হাসপাতালে নিতে, চিকিৎসা দিতে, এমনকি পোস্টমর্টেমেও বাধা দেওয়া হয়েছে। এসব বিষয় ফরমাল চার্জে এসেছে। আন্দোলনকারীদের ওপর দায় চাপানোর জন্য বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় নিজেদের লোক দিয়ে আগুন দেওয়া হয়। এসবের দায় চাপানোর জন্য নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছিল, তার টেলিফোনিক নির্দেশ তদন্ত সংস্থার হাতে এসেছে। গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনা এবং তার সহযোগীদের বিচারের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে গণ-অভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে প্রথম মামলাটি (মিস কেস বা বিবিধ মামলা) হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও দুটি মামলা : শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এই মামলা ছাড়াও ট্রাইব্যুনালে আরও দুটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় আওয়ামী লীগ শাসনামলের সাড়ে ১৫ বছরে গুম-খুনের ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে। অপর মামলাটি হয়েছে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়। অভিযোগ দাখিলের পর প্রসিকিউশনের আবেদনে ১৭ অক্টোবর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে অবস্থান করছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম