সাংবাদিকদের মুক্তিযোদ্ধা উপদেষ্টা
শেখ মুজিব ও চার নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা
মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিলের খবর সঠিক নয়
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেছেন, নতুন অধ্যাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় চার নেতা ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসাবে বিবেচিত হবেন। মুজিবনগর সরকারে যারা ছিলেন, তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। তবে মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী হিসাবে বিবেচিত হবেন। শেখ মুজিবসহ ৪ শতাধিক নেতার মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিল শিরোনামে বুধবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরটি সঠিক নয় বলে তিনি জানান। বুধবার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা এসব কথা বলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে মঙ্গলবার জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করা হয়েছে।
উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, অধ্যাদেশে মুজিবনগর সরকারকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য নেতাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিলের যে কথাটি বলা হচ্ছে তা মোটেই সঠিক নয়। সঠিক নয় এই অর্থে যে, এখানে (অধ্যাদেশে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায়) সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার যেটা মুজিবনগর সরকার এবং এ সরকার কর্তৃক স্বীকৃত অন্যান্য বাহিনী তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা হবেন। তার মানে মুজিবনগর সরকার নিজে এবং তার দ্বারা স্বীকৃত অন্যান্য বাহিনীর যারা সশস্ত্র যুদ্ধ করেছেন তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা হবেন। এটাকে ইতিহাসভিত্তিক করা হয়েছে। যারা সশস্ত্রভাবে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন এবং এই যুদ্ধ যারা পরিচালনা করেছেন, তারা বীর মুক্তিযোদ্ধা হবেন। মুক্তিযুদ্ধকে সফল করার জন্য যারা দেশে এবং দেশের বাইরে থেকে সহযোগিতা করেছেন, কাজ করেছেন, যারা সশস্ত্র ছিলেন না, তারা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী হিসাবে বিবেচিত হবেন।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা বলেন, মুজিবনগর সরকারের মধ্যে কে ছিলেন? শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, কামারুজ্জামান ও খন্দকার মুশতাক আহমেদ ছিলেন। এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। ফারুক-ই-আজম বলেন, এই যুদ্ধটা এ সরকার (মুজিবনগর সরকার) পরিচালনা করেছে, এই সরকারের লেজিটিম্যাসির (বৈধতা) বাইরে কাউকে স্বীকৃতিই দেওয়া হয়নি। এই সরকারটাই ছিল তখন স্বীকৃত সরকার।
আবার অর্থটা এমন দাঁড়ায় কি না, যে এই সরকার হয়তো মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করল, কিন্তু তারা তো সরাসরি রণাঙ্গনে অংশ নেয়নি-এ বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, না এটা হয়নি। কারণ রণাঙ্গন ওনারা পরিচালনা করেছেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, তাহলে তো একই কথা আপনি সেক্টর কমান্ডারদের ক্ষেত্রেও বলতে পারেন। তাহলে তারা কি যুদ্ধ করেনি? তারা যুদ্ধ ডিজাইন করেছেন, যুদ্ধে কারা যাবেন আর কারা যাবেন তা তারা ঠিক করেছেন, যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। ঠিক একইভাবে মুজিবনগর সরকার তো পুরো যুদ্ধটা পরিচালনা করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রেশন ও অস্ত্র কোথা থেকে আসবে-এগুলো ওই সরকার (মুজিবনগর সরকার) সংগ্রহ করেছে। এটা তো ঐতিহাসিক সত্য যে, এ সরকার পুরো যুদ্ধটা পরিচালনা করেছে। কেমন করে এই ইতিহাস পরিবর্তন করা যায় আপনারাই বলুন।
তিনি আরও জানান, শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য নেতাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিলের সংবাদটি মিসলিডিং হয়েছে। যা প্রচার-প্রকাশ হয়েছে তা সত্য নয়। মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীর সংজ্ঞায়ও মুজিবনগর সরকারের বিষয়টি এসেছে, সে বিষয়ে কি বলবেন এমন প্রশ্নে ফারুক-ই-আজম বলেন, সেখানে মুজিবনগরের কর্মচারীদের বোঝানো হয়েছে। মুজিবনগর সরকারের অধীনে যেসব বেতনধারী কর্মচারী ছিলেন, তাদেরকে সহযোগী বলা হয়েছে, সরকারকে বলা হয়নি।
উপদেষ্টা বলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী হয়েছেন, তাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে এটা মোটেও সঠিক নয়। কারণ মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদানও অসাধারণ। ওই সময় কে কোন ভূমিকায় অংশগ্রহণ করেছিলেন, সেভাবেই তাদেরকে সম্মানিত করা হচ্ছে। মর্যাদায় পরিবর্তন এলেও ভাতাসহ রাষ্ট্রের দেওয়া সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য নেই, সবাই সমান বলে জানান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা। তিনি বলেন, আমরা মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনগুলোর সঙ্গে সিরিজ মিটিং করেছি। এভাবে করাটাই তাদের সবার দাবি ছিল। এখানে আমরা নতুন করে প্রবর্তন করিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের এই সংজ্ঞা ১৯৭২ সালে ছিল, ২০১৮তে এসে এই সংজ্ঞাটা পরিবর্তন করা হয়। আবার ২০২২-এ এসেও মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৭২ সালে যে সংজ্ঞাটা ছিল আমরা সেটা ফিরিয়ে এনেছি। ইতিহাসকে ইতিহাসের জায়গায় রাখতে হবে। আমি দাবি করছি-আমি মুক্তিযোদ্ধা, উনি দাবি করছেন উনি মুক্তিযোদ্ধা। শাশ্বতভাবে দেশের মানুষ জানেন কারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন।
অধ্যাদেশে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা সুস্পষ্ট জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, অধ্যাদেশ করার আগে যাচাই হয়েছে, ভেটিং হয়েছে অনেক কিছু হয়েছে। আপনি যদি টুইস্ট করতে চান করতে পারেন। এটা তো অল টুগেদার ডিফারেন্ট জিনিস। আমরা চেষ্টা করছি মুক্তিযুদ্ধটা নিয়ে যাতে কেউ বিতর্ক না করতে পারে। তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে দেখা যায়, মুজিবনগর সরকারের কিছু কর্মচারী বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গণ্য হচ্ছেন। এখন থেকে তারা হবেন মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী।
তিনি বলেন, এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে কারও মুক্তিযোদ্ধা পদবি, সম্মান ও ভাতা বাতিল করা হয়নি। শুধু সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। শুধু যারা সরাসরি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন, তারা বীর মুক্তিযোদ্ধা হবেন। অন্যরা হবেন মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী। সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আলাদা করার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, যারা যুদ্ধ করেননি তারা কী করে মুক্তিযোদ্ধা হবেন। যারা মুক্তিযুদ্ধের কারণে ভারতে গেছেন, সেখানে তারা নানা রকমের কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন অর্থাৎ কেউ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে, কেউ কূটনৈতিক চ্যানেলে এবং অন্যান্য কাজে তারা ব্যস্ত ছিলেন। তারা সহযোগিতা করেছেন, তারা তো রণাঙ্গনে এসে লড়াই করেননি।
প্রকাশিত সংবাদে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিবাদ : ‘জামুকা অধ্যাদেশে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা : শেখ মুজিবসহ ৪ শতাধিক নেতার স্বীকৃতি বাতিল, মুজিবনগর সরকারের সদস্যরা হবেন ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ শিরোনামে দৈনিক যুগান্তরের প্রথম পাতায় বুধবার প্রকাশিত খবরের প্রতিবাদ জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবাদপত্রে বলা হয়েছে-‘পত্রিকায় যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। গেজেটে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞায় এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত যা নিম্নে দেওয়া হলো-
‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ অর্থ যারা ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে গ্রামে-গঞ্জে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন এবং যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন এবং বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের এই দেশীয় সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, তৎকালীন মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন এরূপ সব বেসামরিক নাগরিক ওই সময়ে যাদের বয়স সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সর্বনিম্ন বয়সের মধ্যে এবং সশস্ত্র বাহিনী, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), পুলিশ বাহিনী, মুক্তিবাহিনী, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) ও ওই সরকার কর্তৃক স্বীকৃত অন্যান্য বাহিনী, নৌ কমান্ডো, কিলো ফোর্স ও আনসার সদস্য এবং বাংলাদেশের নিম্নবর্ণিত নাগরিকরাও মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হবেন। যথা : (ক) হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগী কর্তৃক নির্যাতিত সব নারী (বীরাঙ্গনা);
(খ) মুক্তিযুদ্ধকালে আহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী ফিল্ড হাসপাতালের সব ডাক্তার, নার্স ও চিকিৎসা-সহকারী;
‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ অর্থ যারা ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে দেশের অভ্যন্তরে বা প্রবাসে অবস্থান করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপিত করা এবং মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করার প্রয়াসে সংগঠকের ভূমিকা পালন, বিশ্বজনমত গঠন, কূটনৈতিক সমর্থন অর্জন এবং মনস্তাত্ত্বিক শক্তি অর্জনের প্রেক্ষাপটে নিম্নবর্ণিত যেসব বাংলাদেশের নাগরিক প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা করেছেন :
(ক) যেসব বাংলাদেশি পেশাজীবী মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশে অবস্থানকালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন এবং যেসব বাংলাদেশি নাগরিক বিশ্বজনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন;
(খ) যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) অধীন কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা দূত এবং উক্ত সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য সহকারী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন;
(গ) মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) সঙ্গে সম্পৃক্ত সব এমএনএ (Member of National Assembly) বা এমপিএ (Member of Provincial Assembly) যারা পরবর্তীকালে গণপরিষদের সদস্য (Member of Constituent Assembly) হিসাবে গণ্য হয়েছিলেন;
(ঘ) স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সব শিল্পী ও কলাকুশলী এবং দেশ ও দেশের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে দায়িত্ব পালনকারী সব বাংলাদেশি সাংবাদিক; এবং (ঙ) স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।
