Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব

কাঁচা চামড়া ২০ শতাংশ কম সংগ্রহের শঙ্কা

বেঁধে দেওয়া মূল্য কার্যকর হয়নি-মৌসুমি ব্যবসায়ী * নির্ধারিত মূল্যেই বেচাকেনা হয়েছে-বাণিজ্য উপদেষ্টা

Icon

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১১ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কাঁচা চামড়া ২০ শতাংশ কম সংগ্রহের শঙ্কা

ছবি: সংগৃহীত

এ বছর দুই কারণে ২০ শতাংশ কুরবানির পশুর চামড়া কম সংগ্রহের শঙ্কা রয়েছে। এর একটি অর্থনৈতিক সংকট ও দ্বিতীয়টি রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। মৌসুমি বিনিয়োগকারী হিসাবে বিত্তশালীদের কাছ থেকে অর্থের জোগান আসত চামড়ার বাজারে। তারল্য সংকট কাটাতে ব্যাংকের সোর্সের বাইরে অর্থসংস্থানের বিকল্প লিংক হিসাবে মৌসুমি বিনিয়োগ কাজ করত। কিন্তু এবার এ ধরনের পরিবার থেকে বিনিয়োগ আসেনি। কারণ এদের অনেকেই পালিয়ে গিয়ে বিদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। এর প্রভাব কুরবানিতে পড়েছে। কাঁচা চামড়ার বাজারে অর্থের প্রভাবও গত বছরের তুলনায় ছিল কম। এছাড়া সার্বিক অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাবও এসে পড়ছে কুরবানির পশু কেনাবেচায় ও পশুর কাঁচা চামড়ার বাণিজ্যে।

ট্যানারি শিল্পে এ বছর চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ৮০ থেকে ৯০ লাখ পিস। বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের মতে ৭০ লাখ পিস চামড়া সংগ্রহ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রানুযায়ী পশু কুরবানি কম হওয়ায় লক্ষ্যপূরণ না হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, এ বছর কুরবানির পশুর চাহিদা ছিল ১ কোটি ৩ লাখ ৮০ হাজার। সেখানে গরু-ছাগলসহ কুরবানির জন্য প্রস্তুত ছিল প্রায় ১ কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার পশু। কিন্তু চাহিদা কমে যাওয়ায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম পশু জবাই হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে-এ বছর হাটগুলোতে পর্যাপ্ত কুরবানির পশু উঠলেও সেটি ছিল গত বছরের তুলনায় কম। রাজধানীর পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জ মাঠের হাট ইজারাদার টিপু সুলতান যুগান্তরকে জানান, দেড় হাজার গরু কম উঠেছে গত বছরের তুলনায়। মূলত নানা কারণে কুরবানি কিছুটা কম হওয়ায় কাঁচা চামড়ার হিসাবটি কিছুটা হেরফের হয়েছে।

জানা গেছে, কুরবানির গরুর লবণযুক্ত চামড়ার প্রতি বর্গফুটের দাম গতবারের চেয়ে এবার ৫ টাকা বাড়িয়ে ৬৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে সেই দরে চামড়া বিক্রি হয়নি। ঈদের দিন রাজধানীর মোহাম্মদপুর, সায়েন্সল্যাব এলাকা ঘুরে দেখা যায়, লবণ ছাড়া বড় ও মাঝারি গরুর কাঁচা চামড়া ৭০০ থেকে সর্বোচ্চ ৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর যেসব গরুর চামড়া আকারে তুলনামূলক ছোট ও মান কিছুটা খারাপ, সেগুলো ৬০০-৬৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পুরান ঢাকার লালবাগের পোস্তার আড়তগুলো কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের অন্যতম বড় জায়গা। সেখানে বড় ও মাঝারি আকারের গরুর কাঁচা চামড়া সর্বোচ্চ ৭০০-৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গত বছরও প্রায় একই রকম দাম ছিল। তবে ঢাকার বাইরে দাম আরও কম। গত কয়েক বছরের মতো এবারও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, চামড়া বিক্রি করে ন্যায্যমূল্য মেলেনি। কেউ কেউ বলেছেন, গতবারের চেয়েও দাম কম। আর ছাগলের চামড়া কেনায় আগ্রহ কম ছিল ব্যবসায়ীদের।

যদিও বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের দাবি, বেঁধে দেওয়া দামেই পশুর চামড়া বেচাকেনা হয়েছে। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়ার দাম পাচ্ছেন না এমন প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেছেন এটা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সত্য, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অসত্য। অসত্য এজন্য যে কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী যাদের চামড়া সংরক্ষণের ব্যাপারে কোনো অভিজ্ঞতা নেই, তারা চামড়া নিয়ে আধা পচা করে ফেলেছেন। আধা পচা চামড়া সাতশ-আটশ টাকায় বিক্রি হলে তো এটা অনেক বেশি। আর যেটা ভালো চামড়া সেটি বারো থেকে তেরোশ টাকায় বিক্রি হয়েছে। উপদেষ্টা আরও বলেন, আশা করছি লবণযুক্ত চামড়ার দাম আরও বাড়বে। আমরা চামড়া সংরক্ষণের সক্ষমতা তৈরি করেছি, যার মাধ্যমে দুই থেকে তিন মাস চামড়া ধরে রাখতে (সংরক্ষণ) পারবেন। ধরে রেখে উপযুক্ত দাম না পাওয়া পর্যন্ত বিক্রি না করার আহ্বান জানান তিনি।

শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেছেন, সরকার চামড়া শিল্পের সক্ষমতা বাড়াতে চায়। চামড়া যেন নষ্ট না হয় এজন্য ট্যানারিতে কাঁচা চামড়া ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর এ বছর দেরিতে লবণ দেওয়ার কারণে কুরবানির পশুর চামড়ায় কাঙ্ক্ষিত দাম অনেকেই পাননি। ট্যানারিতে চামড়া সংগ্রহ নিয়ে উপদেষ্টা বলেন, এবার সাভারের বিসিক শিল্প নগরী ট্যানারিতে তিন লাখ ৭৮ হাজার কুরবানির পশুর চামড়া এসেছে। ঢাকাসহ সারা দেশে আরও সাত লাখ পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি চামড়া রয়েছে। সেগুলো আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই ট্যানারির কারখানাতে ঢুকবে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমই) মহাসচিব টিপু সুলতান যুগান্তরকে জানান, আমাদের কাঁচা চামড়া সংগ্রহের টার্গেট ছিল ৮০ থেকে ৯০ লাখ পিস। সেখানে ৭০ লাখ পিস সংগ্রহ হয়েছে। তিনি বলেন, অনেক ধনী ব্যক্তি এখন পলাতক। প্রতিবছর কুরবানি ও পশুর চামড়ার বাণিজ্যর সঙ্গে তারা সম্পৃক্ত থাকলেও এ বছর তাদের থাকা সম্ভব হয়নি। যে কারণে আমার ধারণা সার্বিক হিসাবে কমপক্ষে ২০ শতাংশ কাঁচা চামড়া সংগ্রহ কম হবে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকার বিনামূল্য এ বছর ৩০ হাজার টন লবণ মাদ্রাসা ও এতিমখানায় দিয়েছে কুরবানির চামড়া সংরক্ষণের জন্য। সর্বশেষ হিসাবে খুলনা বিভাগের মাদ্রাসা ও এতিমখানায় এক লাখ ১৯ হাজার ১১২ পিস গরুর চামড়া ও ২ লাখ ৭ হাজার ৬৮২ পিস ছাগলের চামড়া লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগে গরুর চামড়া ৭ লাখ ৪৫৪ পিস এবং ছাগলের চামড়া ৭৪ হাজার ৩২০ পিস, রংপুরে গরু ও মহিষের চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে এক লাখ ৮৩ হাজার পিস ও ছাগলের ৫১ হাজার পিস। একইভাবে বরিশাল বিভাগে মাদ্রাসা ও এতিমখানায় গরুর চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে ৭২ হাজার ২০৯ পিস ও ছাগলের প্রায় ৭ হাজার পিস। সিলেটে সংরক্ষণ করা হয়েছে ২ লাখ ৯ হাজার ৩৪৫ পিস। এর মধ্যে গরুর চামড়া ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩৪৫ পিস ও ছাগলের ২২ হাজার পিস এবং রাজশাহী বিভাগে গরু, ছাগল মিলে মোট ২ লাখ ৮৭ হাজার পিস সংরক্ষণ করা আছে। যার মধ্যে গরুর চামড়ার সংখ্যা ১ লাখ ৭৬ হাজার পিস।

মাদ্রাসা ও এতিমখানা ছাড়াও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় কাঁচা চামড়া লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। কারণ ঈদের দিন থেকে পরবর্তী ১০ দিন বিভিন্ন জেলার চামড়া ঢাকা প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আছে। সেটি উঠে যাওয়ার পর বিক্রির উদ্দেশ্যে ঢাকায় আনা হবে। আবার ঢাকার বড় পাইকারি বাজার পোস্তার ব্যবসায়ীরাও লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করেছেন কুরবানির চামড়া। কয়েক দিন পর হাট খোলা হলে ট্যানারি মালিকরা এসব চামড়া কিনতে নামবেন।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম