বিনাবাধায় দেশ ছেড়ে ফিরলেনও নির্বিঘ্নে
ব্যাংককে চিকিৎসা নিয়ে মধ্যরাতেই ঢাকায় ফেরেন আবদুল হামিদ * লাং ক্যানসারে থেরাপি নিতে এক মাস পর আবারও বামরুনগ্রাদে যাবেন
যুগান্তর প্রতিবেদন ও কিশোরগঞ্জ ব্যুরো
প্রকাশ: ১১ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ব্যাংককে চিকিৎসা নিয়ে এক মাস পর দেশে ফিরেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। ‘ত্রি টু ফোর স্টেজ’-এ থাকা লাং ক্যানসারের রেডিওথেরাপি নিয়ে বামরুনগ্রাদ হাসপাতাল ছেড়ে রোববার গভীর রাতে (রাত ১টা ২৫ মিনিটে) থাই এয়ারওয়েজের টিজি-৩৯৯ ফ্লাইটে তিনি ঢাকায় নামেন। সাবেক রাষ্ট্রপতিকে উড়োজাহাজ থেকে হুইলচেয়ারে নামানো হয়। তার পরনে ছিল লুঙ্গি ও নীল রঙের চাদর। আবদুল হামিদের সঙ্গে ছিলেন তার শ্যালক নওশাদ খান ও ছোট ছেলে রিয়াদ আহমেদ তুষার। বিনাবাধায় দেশ ছেড়ে আবার নির্বিঘ্নেই দেশে ফেরেন সাবেক এই রাষ্ট্রপতি। রাত আনুমানিক তিনটার দিকে বিমানবন্দর ছেড়ে ঢাকা সেনানিবাসের সিএসডিসংলগ্ন অ্যাপার্টমেন্টে ছোট ছেলে তুষার আহমেদের বাসায় ওঠেন তিনি। সেখানে তার অসুস্থ স্ত্রী রাশিদা খানমও থাকেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের পারিবারিক ঘনিষ্ঠ সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
এদিকে গভীর রাতে তার দেশত্যাগের পর তুমুল আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছিল। তোলা হয়েছিল নানা প্রশ্ন। তার যাওয়া-আসার এই সময়ে দেশের মধ্যেও ঘটে বেশ কিছু আলোচিত ঘটনা। তবে গভীর রাতেই আবার দেশে ফিরে অনেক প্রশ্নের উত্তর পরিষ্কার করে দিয়েছেন তিনি। আবদুল হামিদের পরিবারিক ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, তিনি দেশ ছেড়েছিলেন চিকিৎসার জন্য। ফলে চিকিৎসা শেষে তিনি আর দেশের বাইরে থাকতে চাননি। এছাড়া তার অসুস্থ স্ত্রী সত্তরোর্ধ্ব রাশিদা খানম গুরুতর কিডনি সমস্যায় ভুগছেন। তাকে দেখতে এবং স্বভাবসুলভ চিরচেনা আলো-বাতাসে সময় কাটাতেই দেশে ফিরেছেন ৮১ বছর বয়সি আবদুল হামিদ। যদিও আগামী এক মাসের মধ্যে আবারও থেরাপি নিতে থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কথা রয়েছে তার।
সূত্রমতে, উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিসের কারণে রাষ্ট্রপতিপত্নী রাশিদা খানমের কিডনি গুরুতরভাবে ‘ডেমেজ’ হয়ে গেছে। এজন্য তাকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচে) সপ্তাহে তিনবার ডায়ালাইসিস করাতে হয়। আগে ভিভিআইপি মর্যাদার কেবিনে থেকে ডায়ালাইসিস সুবিধা পেলেও জুলাই আন্দোলনের পর থেকে তাকে আর সে সুযোগ দেওয়া হয় না। সাধারণ কেবিনে থেকেই ডায়ালাইসিস করাচ্ছেন তিনি। একই কারণে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদও কোনো প্রকার রাষ্ট্রীয় ভিভিআইপি প্রটোকল ছাড়াই সাধারণ নাগরিকের মতোই চলাফেরা ও বসবাস করছেন।
চিকিৎসার জন্য গত ৭ মে গভীর রাতে থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে ঢাকা ত্যাগ করেন আবদুল হামিদ। তখন চুপিসারে নয়, বিমানবন্দরে সব গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের উপস্থিতি এবং ইমিগ্রেশনের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেই দেশ ছেড়েছিলেন সাবেক এই রাষ্ট্রপতি। বিমানবন্দরের সার্বিক আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে তিনি প্রায় চার ঘণ্টা বিমানবন্দরে ছিলেন। একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি, যিনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে কিশোরগঞ্জের এক হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। এরপরও তিনি কীভাবে দেশত্যাগ করলেন তা নিয়ে তখন অনেকেই প্রশ্ন তুলের্ছিলেন।
এ ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপারসহ চার পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে তিন সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত এক মাসের চিকিৎসা শেষে রোববার রাতে আবদুল হামিদ স্বাভাবিকভাবেই দেশে ফিরে আসেন।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এসএম রাগিব সামাদ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তিনি সাধারণ যাত্রীর মতোই এসেছেন, কোনো প্রটোকল চাননি। রাগিব সামাদ আরও বলেন, ‘ফ্লাইট থেকে হুইলচেয়ারে করে আবদুল হামিদকে নামিয়ে আনা হয়। তাকে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। তার মুখে মাস্ক ও পরনে ছিল শার্ট-লুঙ্গি। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন ছোট ছেলে রিয়াদ আহমেদ ও শ্যালক ডা. নওশাদ খান।’
এদিকে হামিদের এই দেশে ফেরা নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট না থাকায় তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। তদন্তের পর যে দোষী প্রমাণিত হবে তাকে আইনের আওতায় নেওয়া হবে। সোমবার ঢাকার যাত্রাবাড়ী থানা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আপনারাই আমাকে রিকোয়েস্ট করেছেন, আপনাদের কথাই আমি রাখছি, আমাদের তদন্ত করতে দিন। যদি তদন্তে কেউ দোষী হয় তাহলে আমরা আইনের আওতায় নিয়ে আসব। প্রমাণিত না হলে কেন একটা নির্দোষ লোককে সাজা দেব।’
আবদুল হামিদের দেশত্যাগের ঘটনায় যাদের বিরুদ্ধে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, তাদের বিষয়ে জানতে চাইলে এই উপদেষ্টা বলেন, এই ঘটনায় উপদেষ্টাদের তিনজনের একটা কমিটি হয়েছে। উনাদের ওই রিকমেনডেশনটা পাওয়ার পর দোষী হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদি দোষী না হয়, তারা আবার যার যার জায়গায় ফিরে আসবেন।’
এদিকে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের মামলা সম্পর্কে খোঁজ নিতে মঙ্গলবার দুপুরে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে কথা হয়। এ সময় তিনি যুগান্তরকে জানান, এ থানায় ১৪ জানুয়ারি দায়েরকৃত সহিংসতার মামলায় সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে প্যানাল কোডের ১০৯ ধারায় হুকুমের আসামি করা হয়েছে। কোনো হত্যা মামলায় নয়। তার শ্যালক ডা. নওশাদ খানের বিরুদ্ধেও করিমগঞ্জ থানায় একইরকম মামলা রয়েছে বলেও জানা গেছে।
এদিকে চিকিৎসার জন্য আবদুল হামিদের দেশে ছেড়ে যাওয়ার পর রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সারা দেশের বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা, সমালোচনা, বিক্ষোভ শুরু হয়। আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যার’ অভিযোগ এনে দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী ছাত্রশিবির, ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন। এরপর আন্দোলনের চাপের মুখে গত ১০ মে অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগ ও দলটির নেতাদের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত দল এবং দলটির অঙ্গ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সব সংগঠনের সব ধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশত্যাগ নিয়ে শোরগোলের মধ্যে তাকে নিয়ে ১৪ মে ফেসবুকে ‘আবেগঘন’ পোস্ট দেন তার ছেলে রিয়াদ আহমেদ তুষার। তার বাবা ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত জানিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ’৮২-৮৩ বছরের একজন বয়স্ক লোক যিনি কিনা অসুস্থতার কারণে এখন ২ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। ২ ঘণ্টা বসে থাকতে পারছেন না; বাধ্য হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েন। ওজন কমতে কমতে ৫৪ কেজিতে দাঁড়িয়েছে; যে কারণে নিজের কোনো প্যান্ট পরতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে লুঙ্গি পরে থাকতে হচ্ছে। যাকে বেটার চিকিৎসার জন্য ডাক্তাররা বোর্ড করে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন বিদেশে চিকিৎসা করানোর জন্য।’ ডেপুটি স্পিকার ও স্পিকার হিসাবে দায়িত্ব পালনের পর আওয়ামী লীগের শাসনামলে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন আবদুল হামিদ। ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার মেয়াদ শেষে ২০২৩ সালের ২৪ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নেন মো. সাহাবুদ্দিন। বঙ্গভবন ছাড়ার পর রাজধানীর নিকুঞ্জের বাসায় থাকতেন আবদুল হামিদ। বর্তমানে তিনি ছেলের বাসায় থাকছেন।
