দেশে আবার করোনা সংক্রমণ বাড়ছে
মাস্ক পরাসহ ১১ দফা নির্দেশনা
দেশের সব হাসপাতালে শয্যা প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে * ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের টিকা নেওয়ার পরামর্শ
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১২ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশে নতুন করে ফের করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় বাংলাদেশেও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে দেশে করোনাভাইরাসের নতুন একটি উপধরনে বেশ কয়েকজন আক্রান্ত হয়েছেন। ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও ১০ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বুধবার এ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে করোনা প্রতিরোধে ১১ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনায় করোনা প্রতিরোধে দেশের সব সরকারি হাসপাতালে পৃথক শয্যা প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ১১ দফা নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সর্বসাধারণকে মাস্ক পরাসহ জনসমাগমস্থল এড়িয়ে চলতে বলা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনায় করোনা শনাক্তে আরটি-পিসিআর, র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট, টিকা, হাসপাতালে মেডিকেল অক্সিজেন, হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা, ভেন্টিলেটর, আইসিইউ, এইচডিইউ এবং সেবাদানকারীদের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাসামগ্রী প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে। জ্বর-কাশি ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত রোগীদের সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ঘর থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর দফাগুলোর নির্দেশনা পড়ে শোনান। এ সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা; হাসপাতাল শাখা এবং রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ (আইইডিসিআর) অন্যান্য দপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর বলেন, দেশে করোনাভাইরাসজনিত সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই মধ্যে ভাইরাসটির কয়েকটি নতুন সাব-ভ্যারিয়েন্ট (উপধরন) চিহ্নিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীদের (বিদেশ ভ্রমণকারী) মাধ্যমে বাংলাদেশে ভাইরাস সংক্রমণের বিস্তার প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যার অংশ হিসাবে সব স্থল, নৌ ও বিমানবন্দরের আইএইচআর ডেস্কগুলোয় নজরদারি ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়গুলো জোরদার করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, এ বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত দেশে করোনায় সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন ১৫৮ জন। আর জুনের প্রথম ১০ দিনে শনাক্ত হয়েছেন ৫৪ জন। এর অর্থ-সংক্রমণে উল্লেখযোগ্য কোনো পার্থক্য নেই। তবে প্রতিবেশী দেশগুলোয় সংক্রমণ বাড়তে দেখা যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিডিসির (রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা) লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক মো. হালিমুর রশীদ বলেন, সম্প্রতি থাইল্যান্ডে সংক্রমণ বেশি দেখা যাচ্ছে। ভারত ও মালয়েশিয়ায়ও সংক্রমণ বাড়ছে। ফলে সংক্রমণ প্রতিরোধে সবাইকে সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। আইইডিসিআর-এর প্রতিনিধিরা জানান, দেশে এখন করোনার যে ধরন দেখা যাচ্ছে, তা ওমিক্রন বা ওমিক্রনের উপধরন। এর আগে এ উপসর্গ তীব্র হতে দেখা যায়নি। তবে সতর্ক থাকার কোনো বিকল্প নেই।
স্বাস্থ্য বিভাগের প্রস্তুতি : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জানান, তারা ইতোমধ্যে ২৮ হাজার করোনা শনাক্তকরণ কিট সংগ্রহ করেছেন। ১০ হাজার আরটি-পিসিআর কিট এসেছে। বৃহস্পতি-শুক্রবারের মধ্যে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে কিটগুলো পৌঁছানো হবে।
হাসপাতাল শাখার পরিচালক আবু হোসাইন মো. মঈনুল আহসান বলেন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও রোগীর চিকিৎসায় শনিবারের মধ্যে দেশের সব সরকারি হাসপাতালে সার্বক্ষণিক কোভিড-১৯ রোগীর জরুরি চিকিৎসা নিশ্চিতে আলাদা শয্যা প্রস্তুতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাজধানীর মহাখালীর উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতালে সাধারণ ৫০ শয্যা ও আইসিইউ-এর ১৫ শয্যা শুধু করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। রাজধানীর মুগদা ও কুর্মিটোলা হাসপাতালে পৃথক শয্যার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি করোনা রোগীদের জন্য খুলনা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৃথক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সংক্রমণ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তুতি আরও জোরদার করা হবে।
টিকার ব্যপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ১৭ লাখ টিকা বিভিন্ন টিকাকেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। টিকা আগের নিয়মেই দেওয়া হবে। ষাটোর্ধ্ব মানুষ, দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম-এ ধরনের ব্যক্তিরা টিকা পাবেন।
এইচএসসি পরীক্ষা ও রাজনৈতিক কর্মসূচি : ২৬ জুন এইচএসসি (উচ্চমাধ্যমিক) পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। পাশাপাশি আসন্ন নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ ও কর্মসূচি বাড়বে-এমন প্রেক্ষাপটে করোনা সংক্রমণ রোধে করণীয় সম্পর্কে জানান মহাপরিচালক। তিনি বলেন, এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা তরুণ। তাদের শুধু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেই হবে। এছাড়া জনসমাগম এড়িয়ে চলার যে বার্তা সাধারণ মানুষকে দেওয়া হয়েছে, একই বার্তা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
সংক্রমণ প্রতিরোধে জনসাধারণের করণীয় : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে জনসমাগম এড়িয়ে চলা এবং মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। শ্বাসতন্ত্রের রোগগুলো থেকে নিজেকে রক্ষায় হাঁচি বা কাশির সময় বাহু বা টিসু দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে রাখতে হবে। ব্যবহৃত টিসুটি অবিলম্বে ঢাকনাযুক্ত ময়লার ঝুড়িতে ফেলতে হবে। ঘনঘন সাবান ও পানি কিংবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়ার (অন্তত ২০ সেকেন্ড) অভ্যাস করতে হবে। অপরিষ্কার হাতে চোখ, নাক ও মুখ ছোঁয়া যাবে না। আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলাসহ কমপক্ষে ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
সন্দেহজনক রোগীদের ক্ষেত্রে করণীয় : জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হলে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত বাড়িতে থাকতে হবে। রোগীর নাক-মুখ ঢাকার জন্য মাস্ক ব্যবহার করা। রোগীর সেবাদানকারীরাও সতর্কতা হিসাবে মাস্ক ব্যবহার করবেন। প্রয়োজন হলে কাছের হাসপাতালে অথবা আইইডিসিআর (০১৪০১১৯৬২৯৩) অথবা স্বাস্থ্য বাতায়নের (১৬২৬৩) নম্বরে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিতে হবে।
২৪ ঘণ্টায় ১০ রোগী শনাক্ত : এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে নতুন করে ১০ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এর আগের দিন মঙ্গলবার আক্রান্ত হয়েছিলেন ১৩ জন। ২৪ ঘণ্টায় করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন দুজন।
ভোমরা ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে করোনা সতর্কতা জোরদার : সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানান, করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী সাতক্ষীরার ভোমরা ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে করোনা সতর্কতা জোরদার করা হয়েছে। ভারতে যাতায়াতকারীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার পাশাপাশি করা হচ্ছে তথ্য সংরক্ষণও। ভোমরা ইমিগ্রেশন পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপরিদর্শক তুফান দুলাল মন্ডল জানান, পর্যটক ভিসা বন্ধ থাকায় ভোমরা ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যাতায়াতকারী পাসপোর্টধারী যাত্রীর সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক কম। তবে বর্তমান সময়ে প্রতিদিন পাসপোর্টধারী প্রায় ৩০০ জন যাত্রী ভারতে যাতায়াত করে থাকেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী এখানে মেডিকেল টিম কাজ করছে।
এদিকে স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে বাড়তি সতর্কতার পাশাপাশি মাস্ক পরা, হাত ধোয়া এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হলেও অনেক যাত্রী ও নিরাপত্তাকর্মীদের মধ্যে সচেতনতার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। চেকপোস্টে প্রবেশ ও প্রস্থানকারী যাত্রীদের অনেকেই স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। বিশেষ করে মাস্ক ব্যবহারে তাদের তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। বজায় রাখছেন না সামাজিক দূরত্বও।
ভোমরা ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের প্রবেশদ্বারে স্থাপিত মেডিকেল টিমে দায়িত্বরত স্বাস্থ্য সহকারী মো. মনিরুজ্জামান বলেন, বুধবার সকাল থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত ৬০ জন যাত্রীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছে। পাশাপাশি যাত্রীদের নাম, পাসপোর্ট নম্বর এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষার তথ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
