Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

ইরানে ভয়ংকর বিমান হামলা ইসরাইলের

সেনাপ্রধান, আইআরজিসি প্রধান, বিমানবাহিনী প্রধান ও ৬ পরমাণু বিজ্ঞানীসহ ৭৮ জন নিহত * পালটা হামলা শুরু : ইসরাইলে ১৫০ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে তেহরান

Icon

শামীম জোয়ার্দ্দার

প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ইরানে ভয়ংকর বিমান হামলা ইসরাইলের

ইরান-ইসরাইলের রণাকাশে যুদ্ধের মেঘ। এক পশলা রণবৃষ্টির পর এখন বজ পাতের অপেক্ষায় দুই রাষ্ট্র-ই। দুই ভূ-খণ্ডই থমথমে। দুই সেনাবাহিনীতেই সাজসাজ রব। হামলা-পালটা হামলার টানটান উত্তেজনা দু-দেশেই। উচিত শিক্ষা দেওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকারে কঠোর হামলার প্রস্তুতি ইরানে। যে কোনো মুহূর্তে পালটা হামলার শঙ্কায় তটস্থ ইসরাইল। দুই চিরশত্রুর রণ দামামায় অগ্নিমূর্তি হয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত মরু রাজনীতিও। নাগরিকদের নিরাপত্তায় ইতোমধ্যেই জরুরি অবস্থা জারি করেছে ইসরাইল। তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তে ১০ হাজারেরও বেশি সেনা মোতায়েন করেছে সীমান্তে। শুক্রবার ভোররাতে ইরানে ভয়ংকর বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। রাজধানী তেহরানসহ ইরানের ৮টি শহরের ১০০ লক্ষ্যবস্তুতে ২০০ যুদ্ধবিমান থেকে বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। স্থানীয় সময় রাত ৩টা থেকে শুরু হয় হামলা। ইসরাইলের ডজন ডজন যুদ্ধবিমানের ছোট ছোট দলের বর্বর তাণ্ডবে কেঁপে ওঠে তেহরানের ঘুমন্ত জনপদ। মুহূর্তে তছনছ হয়ে যায় তেহরানের সুরক্ষিত সেনাসদর দপ্তর, ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) হেডকোয়ার্টার ও দক্ষিণের ইস্পাহান প্রদেশের নানতাজ পারমাণবিক কেন্দ্র। দফায় দফায় প্রায় ২ ঘণ্টা ধরে ইরানের আবাসিক, সামরিক ও পারমাণবিক কাঠামোতে সফল হামলা চালায় ইসরাইল। পালটা হামলার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ইসরাইল ভূ-খণ্ড লক্ষ্য করে ১০০টিরও বেশি ড্রোন হামলা চালায় ইরান। যার সবই ভূপাতিত করা হয়েছে বলে দাবি করেছে ইসরাইলি বাহিনী। রয়টার্স, আলজাজিরা, সিএনএন, বিবিসি, টাইমস অব ইসরাইল। 

পালটা হামলা শুরু করেছে ইরানও। শনিবার মধ্যরাতে ১ ঘণ্টারও কম সময়ে প্রায় ১৫০ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে তেহরান। ইসরাইলের নিরাপত্তা বাহিনীর বরাতে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে ইসরাইলের শীর্ষ গণমাধ্যম চ্যানেল ১২। তেল আবিব লক্ষ্য করে ওই হামলায় ১৫ জন আহত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশ কয়েকটি ভবনও। নাগরিকদের দ্রুত বোম্ব শেল্টারে আশ্রয় নিতে বলেছে ইসরাইলের সেনাবাহিনী আইডিএফ। প্রত্যক্ষদর্শীরা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, তেল আবিব শহরে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। তেল আবিব ও জেরুজালেমে সাইরেনের শব্দ শোনা গেছে। আকাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলীও দেখা গেছে। আইআরজিসির বরাতে ইরানের সরকারি বার্তা সংস্থা জানিয়েছে, ইরানের পক্ষ থেকে জবাব দেওয়া শুরু হয়েছে। ইসরাইলকে লক্ষ্য করে কয়েকশ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে। ইসরাইলের কয়েক ডজন লক্ষ্যবস্তুতে হামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে আইআরজিসিও। ইসরাইলি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে টাইমস অব ইসরাইল জানিয়েছে, দেশটিতে নিক্ষেপ করা ইরানি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে ইসরাইলকে সহায়তা করছে যুক্তরাষ্ট্র।

‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামের ওই হামলায় ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি, ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর প্রধান (আইআরজিসি) মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি , আইআরজিসির বিমানবাহিনীর প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির আলী হাজিজাদেহ, আইআরজিসি নিয়ন্ত্রিত ইরানি প্রকৌশল সংস্থা খাতাম আল-আম্বিয়া সদর দপ্তরের কমান্ডার মেজর জেনারেল গোলাম আলী রশিদসহ ২০ জন শীর্ষস্থানীয় সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। আইঅরজিসির কুদস ফোর্সের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইসমাইল কানিও হামলায় নিহত হয়েছেন। শুক্রবার সন্ধ্যায় ইরানের একটি সূত্রের বরাত দিয়ে এ খবর জানিয়েছে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস। পারমাণবিক কর্মকাণ্ডের উন্নতি সাধনে জড়িত দেশটির ৬ জন বিজ্ঞানীকেও এই হামলায় হত্যা করেছে ইসরাইল। ইরানি গণমাধ্যমের বরাতে মিডল ইস্ট আই জানিয়েছে, ভয়ংকর এই হামলায় নারী-শিশুসহ ৭৮ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৩২৯ জন।

ওমানের রাজধানী মাস্কাটে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের পরমাণুবিষয়ক আলোচনার ষষ্ঠদফা বৈঠকের আগেই নজিরবিহীন এ হামলা চালালো ইসরাইল। ১৯৮০ সালে ইরাক-ইরান যুদ্বের প্রায় ৪৫ বছর পর এমন ভয়াবহ হামলার শিকার হলো তেহরান। অন্য অর্থে কয়েক দশকের ছায়া যুদ্ধের পর এবারই প্রথম প্রকাশ্য যুদ্ধ-ময়দানে দাঁড়ালো ইরান-ইসরাইল। 

শুক্রবার পাঁচটি ধাপে হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। ইসরাইলি এক সামরিক কর্মকর্তা বলেন, শত শত হামলা চালানো হয়েছে এবং অন্তত আটটি স্থানের (শহরে) লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে পাওয়া বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরাইলি সামরিক বাহিনী ইরানের ছয়টি স্থানে বিমান হামলা চালিয়েছে। তেহরানের উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাটি শহীদ ফাকৌরি সামরিক ঘাঁটি ও তাবরিজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। 

ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, গত কয়েক ঘণ্টায় অন্তত দুটি ধাপে হামলা চালানো হয়। তবে নিশ্চিত না হলেও এখন তৃতীয় দফার হামলা চলমান থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। হামলার স্থানগুলো হলো- রাজধানী তেহরান ও এর আশপাশের সামরিক স্থাপনা; তেহরানের দক্ষিণে নাতানজ শহর, যেখানে ইরানের প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র অবস্থিত; তেহরানের উত্তর-পশ্চিমে তাবরিজ শহর, যেখানে একটি পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র ও দুটি সামরিক ঘাঁটির কাছে বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে; তেহরানের দক্ষিণে ইস্পাহান শহর; তেহরানের দক্ষিণ-পশ্চিমে আরাক শহর ও পশ্চিমে কেরমানশাহ শহর। ইরানের সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, তেহরানজুড়ে ৬ থেকে ৯টি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। হামলা হয়েছে আবাসিক ভবনেও।

ইরানের বিভিন্ন পারমাণবিক স্থাপনা ও সামরিক ঘাঁটিতে ইসরাইলের হামলাকে ‘খুবই সফল’ বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এদিন সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে সমর্থন করে এবং গত রাতে ইরানের ওপর হামলাকে ‘খুব সফল আক্রমণ’ বলে অভিহিত করছে। টেলিফোনে দেওয়া সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমরা অবশ্যই ইসরাইলকে সমর্থন করি। আমরা এমনভাবে সমর্থন করি কেউ কখনো তাদের এমনভাবে সমর্থন করেনি।

ট্রাম্প বলেন, ইরানের আমার কথা শোনা উচিত ছিল। আপনি জানেন কিনা জানি না, আমি তাদের (ইরানকে পরমাণু চুক্তি করতে) ৬০ দিনের সতর্কতা দিয়েছিলাম। আজ ৬১তম দিন চলছে। এর আগে নিজের ট্রুথ সোশ্যাল পোস্টের হুঁশিয়ারিতে বলেন, ‘একের পর এক সুযোগ দিয়েছি। সবকিছু হারানোর আগে ইরানকে একটি চুক্তি করার আহ্বান জানাই। এক সময় ইরানি সাম্রাজ্য নামে পরিচিত দেশটিকে রক্ষা করতে হবে। আর মৃত্যু নয়, আর ধ্বংস নয়, শুধু চুক্তিটা করতে হবে, খুব দেরি হওয়ার আগেই।’ অর্থাৎ চুক্তিতে রাজি না হলে আরও নৃশংশ হামলার পরোক্ষ হুমকিও রয়েছে ওই পোস্টে। 

ইসরাইলের হামলার কড়া জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইরান। হামলার পর দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি এক বিবৃতিতে ‘তেল আবিবকে তেহরানের ভয়ংকর পালটা জবাবের জন্য প্রস্তুত’ থাকতে বলেছেন। রাতের এ হামলার মাধ্যমে ইসরাইল সরকার তার নিজেরে কপালে একটি ‘তিক্ত এবং বেদনাদায়ক’ সিলমোহর বসালো বলেও উল্লেখ করেন তিনি। কড়া হুমকি দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানও। কার্যালয় থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে ইসরাইলের হামলায় নিহত প্রত্যেক নাগরিকের রক্তের প্রতিশোধ নেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন তিনি। গত ২০০ বছরে ইরান আগ বাড়িয়ে কখনো কোনো যুদ্ধ শুরু করেনি উল্লেখ করে বলেন, ‘এই গল্পের শেষ অধ্যায় ইরানই লিখবে’।

ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফের মুখপাত্র আবুলফজল শেখারচি বলেন, ‘ইসরাইলের এই অপরাধের প্রতিক্রিয়া জানানোর কোনো সীমা নেই।’ পালটা প্রতিক্রিয়ায় ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, আমরা প্রাথমিক হামলা চালিয়েছি, যা খুবই সফল হয়েছে। ঈশ্বরের সহায়তায় আমরা আরও অনেক কিছু অর্জন করব’। শুক্রবার এক ভিডিও বার্তায় ইসরাইলি নেতা এসব কথা বলেন। এর আগে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘অনেকদিন ধরে’ ইরানের বিরুদ্ধে হামলা চলতে পারে। ইরানে সামরিক হামলার প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তার স্বার্থে বিশ্বজুড়ে সব দূতাবাস বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে ইসরাইল। শুক্রবার এক বিবৃতিতে ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে। বলা হয়, বিশ্বের সব ইসরাইলি মিশনগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং কনস্যুলার সেবা প্রদান বন্ধ থাকবে। বিদেশে থাকা সব ইসরাইলিদের তাদের অবস্থান এবং পরিস্থিতির সর্বশেষ তথ্য জানানোর পরামর্শ দিয়েছে মন্ত্রণালয়।

ইসরাইলের হঠাৎ এই ইরান আগ্রাসনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে বিশ্ব নেতাদের মাঝেও। আঞ্চলিক শত্রুতা সত্ত্বেও ইসরাইলকে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে সৌদি আরব। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলে, ‘ভ্রাতৃপ্রতিম ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইলি আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে সৌদি আরব। ইসরাইলের এ হামলা আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতির স্পষ্ট লঙ্ঘন’। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মতই ইসরাইলের ইরান হামলাকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন অধিকাংশ মার্কিন আইনপ্রণেতা। শুক্রবার সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হাউজ স্পিকার মাইক জনসন বলেছেন: ‘ইসরাইল সঠিক এবং আত্মরক্ষার অধিকারও রয়েছে’। এনবিসি-তে এক সাক্ষাৎকারে হাউস ডেমোক্রাটিক নেতা হাকিম জেফ্রিস বলেছেন, ‘আমরা অবশ্যই বিশ্বাস করি ইরানকে কখনই পারমাণবিকভাবে সক্ষম হতে দেওয়া উচিত নয়। তারা কেবল ইসরাইলের নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র এবং মুক্ত বিশ্বেরও শত্রু’। ভোররাতে হামলার পরপরই দেওয়া বিবৃতিতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছিলেন , ইসরাইলের ইরান হামলার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নেই। একই কথা বলেছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু বেলা বাড়তেই গোমর ফাঁস হতে থাকে। বেরিয়ে পড়ে থলের বিড়াল। শুক্রবার বিকালের এক ভিডিও বার্তায় নেতানিয়াহু নিজেই বলেন, ‘হামলার বিষয়ে আগে থেকেই সব জানতেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। আগেই তাকে জানিয়েছি। আগের দিন বৃহস্পতিবারও তার সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে। তারা এখন কী করবে, তা আমি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ওপরই ছেড়ে দিচ্ছি’।


Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম