সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ বাতিল দাবি
বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশে উত্তাল সচিবালয়
অধ্যাদেশ পর্যালোচনা সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত * অধ্যাদেশ পুনর্বিবেচনার সুযোগ আছে -আইন উপদেষ্টা
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভে উত্তাল প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়। ঈদুল আজহার লম্বা ছুটির পর সোমবারও বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশের কর্মসূচি পালন করেন বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরামের নেতাকর্মীরা। দাবি আদায় না হওয়ার পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে ঘোষণা দেন নেতারা। সোমবার কর্মচারীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএসএ) নেতারা। তারা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। নেতারা অধ্যাদেশটি বাতিলের দাবি জানান। মঙ্গলবারও সচিবালয়ের বাদামতলায় বেলা ১১টায় জমায়েতের ঘোষণা দেন কর্মচারী নেতারা। প্রতিটি মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা মিছিল নিয়ে সমাবেশে যোগদানের আহ্বান জানান। নেতারা বলেন, যারা মিছিল সমাবেশে আসবে না, ধরে নেব তারা ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর। তারা বলেন, কর্মচারী আইন পর্যালোচনায় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে অথচ ওই কমিটিতে কর্মচারী প্রতিনিধি রাখা হয়নি। আমরা পরিষ্কার করে বলছি, কর্মচারী অধ্যাদেশ বাতিল করুন। অন্যথায় এই দাবির সঙ্গে নতুন দাবি যুক্ত করে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। এ অবস্থায় সোমবার সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ পর্যালোচনা সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি প্রথম বৈঠকে বসে।
এদিন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ পুনর্বিবেচনার সুযোগ আছে। তিনি বলেন, আমরা বিকাল (সোমবার) ৪টার দিকে প্রথম মিটিংয়ে বসব। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা একটা সুপারিশসহ প্রতিবেদন উপদেষ্টা পরিষদের মিটিংয়ে তুলব। উপদেষ্টা কমিটি রিপোর্ট দেওয়ার আগ পর্যন্ত সরকারি কর্মচারীদের আন্দোলন না করারও আহ্বান জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা।
এদিন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএসএ) নেতারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে দেখা করেন। অ্যাসোসিয়েশনের নেতারাও সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতির জট খুলতে সিনিয়র সচিবকে অনুরোধ জানান। সংগঠনটির তরফ থেকে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২০, ২১ ও ২২তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের একসঙ্গে পদোন্নতির দাবি জানানো হয়েছে। একই দাবিতে বেলা ৩টায় মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে দেখা করেছেন বিএএসএ-এর নেতারা। মন্ত্রিপরিষদ সচিব তাদের বক্তব্য শুনেছেন এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানাবেন বলে আশ্বস্ত করেন। এ সময় শতাধিক কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। অপরদিকে বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের তরফ থেকে সচিবালয়ে আন্দোলনরত কর্মচারী এবং বিএএসএ-এর কার্যক্রম ক্লোজলি মনিটিরিং করতে দেখা গেছে। সংগঠনটির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা তৎপর ছিলেন।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যাসোসিয়েশন (বিএএসএ) নেতারা এসেছেন। তারা সার্ভিস সংক্রান্ত নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। শুনেছি এবং তাদের যৌক্তিক দাবিগুলো নিশ্চয়ই সরকার বিবেচনা করবে। বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ও ঢাকা বিভাগের কমিশনার মো. শরফ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, আমরা সংগঠনের তরফ থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের সঙ্গে দেখা করেছি। সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি আদৌ প্রয়োজনীয়তা ছিল কি না, তা বিবেচনা করার জন্য বিএএসএ-এর তরফ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। কারণ, অধ্যাদেশটি জারির পর থেকে সচিবালয়ের ভেতরে প্রতিদিন মিছিল, মিটিং, সমাবেশ হচ্ছে। এতে কর্মপরিবেশ এবং সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তিনি জানান, আমরা বলেছি, অধ্যাদেশটি সংশোধন, পুনর্বিবেচনা কিংবা বাতিল-যাই হোক, দ্রুততম সময়ের মধ্যে হওয়া জরুরি। উল্লেখ্য, সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ বাতিলের জন্য এই প্রথম ক্যাডার কর্মকর্তারা দাবি তুললেন।
এদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের সঙ্গে সাক্ষাতের পর বিএএসএ-এর একাধিক নেতা যুগান্তরকে বলেন, আমরা জানিয়েছি, বর্তমানে প্রশাসনে ২২২ অতিরিক্ত সচিব কর্মরত। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে পদায়নের জন্য অতিরিক্ত সচিব পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে সরকারি কাজে বিঘ্ন ঘটছে। জনগণ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দিতে হবে। তবে স্বৈরাচারের দোসর বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২০, ২১ ও ২২ ব্যাচের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া যাবে না। বরং বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২০, ২১ ও ২২ ব্যাচের মধ্যে যোগ্য কর্মকর্তাদের একসঙ্গে পদোন্নতি দিতে হবে। তাহলে অতিরিক্ত সচিব পদে কর্মকর্তার বিদ্যমান সংকট দূর হবে। তিন ব্যাচকে একসঙ্গে পদোন্নতি দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে তারা বলেন, ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি দিলে স্বৈরাচারের দোসররা পদোন্নতি পেয়ে যাবেন এবং কর্মকর্তার সংকটও কাটবে না। বরং তিন ব্যাচকে একসঙ্গে পদোন্নতি দিলে কর্মকর্তার সংকট হবে না। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করা হয়েছে।
এদিকে বেলা সোয়া ১১টায় সচিবালয়ের বাদামতলায় শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী মিছিলসহ সমবেত হয় বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরামের কো-চেয়ারম্যান মো. নূরুল ইসলাম। এর কয়েক মিনিট পর তিন নম্বর ভবন থেকে একটি মিছিল যোগ দেয় বাদামতলার সমাবেশে। সাড়ে ১১টায় বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরামের সভাপতি মো. বাদিউল কবিরের নেতৃত্বে সচিবালয়ের চার নম্বর ভবন থেকে মিছিল সমাবেশস্থলে যোগ দেন। কয়েকশ নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারী সমাবেশে অংশ নেন। বাদামতলায় সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে তারা বিশাল মিছিল নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নতুন ভবনের নিচে গিয়ে সমাবেশ করেন।
এতে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরামের সভাপতি মো. বাদিউল কবীর। বক্তৃতা করেন সংগঠনের কো-চেয়ারম্যান মো. নূরুল ইসলাম, মহাসচিব মো. নজরুল ইসলাম ও কো-মহাসচিব মো. মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমসহ নেতারা।
বাদিউল কবীর বলেন, নিবর্তনমূলক ও কালো আইন কোনোভাবেই কর্মচারীরা মানবে না। যে কোনো মূল্যে এ আইন বাতিল করতে হবে। কোনো ধরনের বাহানা, ছলচাতুরী করা চলবে না। তিনি বলেন, লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত মাঠে থাকব।
সংগঠনের কো-চেয়ারম্যান মো. নুরুল ইসলাম বলেন, আমাদের সঙ্গে সাপ-লুডু খেলা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের কথায় যদি কান না দেন, তাহলে আমরা বিভাগীয় পর্যায়ে সম্মেলন ডাকতে বাধ্য হব।
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ পুনর্বিচনার সুযোগ রয়েছে : এদিকে সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ পুনর্বিবেচনার সুযোগ আছে বলে জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। সোমবার সচিবালয়ে জাতিসংঘের বলপ্রয়োগে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে গুম সম্পর্কিত কার্যনির্বাহী দলের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা এ কথা জানান। কর্মচারী অধ্যাদেশের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আইন উপদেষ্টা বলেন, সরকারি যে চাকরি আইন রয়েছে, সেটার বিষয়ে উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানসহ আমাদের একাধিক উপদেষ্টা বলেছেন, এখানে অবশ্যই পুনর্বিবেচনার অবকাশ রয়েছে। আমি আইনটি দেখেছি, দেখার পর মনে হয়েছে এটা অবশ্যই পুনর্বিবেচনার সুযোগ রয়েছে।
