Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

৪ দিনে ৩৭০ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল তেহরান

ইরানের হামলায় গাজার মতোই বিধ্বস্ত ইসরাইল

মধ্যপ্রাচ্যের পথে মার্কিন বিমানবাহী রণতরি * ইরান এই যুদ্ধে জিতছে না : ট্রাম্প * ইরানে সরকার উৎখাত চায় না ব্রিটেন

Icon

শামীম জোয়ার্দ্দার

প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ইরানের হামলায় গাজার মতোই বিধ্বস্ত ইসরাইল

মধ্যপ্রাচ্যের দুর্বৃত্ত ইসরাইলকে আর চেনার উপায় নেই। আকাশছোঁয়া অহংকারে নাক উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পশ্চিমা ফ্যাশনের অভিজাত প্রাসাদগুলো এখন জাত হারিয়ে দুর্ভিক্ষের কাঙাল। হাড়গুলো পর্যন্ত গোনা যাচ্ছে। কর্পূরের মতোই চোখের পলকে উড়ে গেছে কদিন আগের সেই ‘পাঁচতারা’ জৌলুশ। ছাল-চামড়া ছিটকে জীর্ণ পোড়াবাড়ির হাল। ‘কোমর-গর্দানে’ বজ ঝাঁকুনিতে মুখ থুবড়ে পড়েছে আরব মুল্লুকে যুক্তরাষ্ট্রের ভাড়াটে গুন্ডা এই ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের’ সুরম্য ভবনগুলো। ঠিক যেন গাজার মতো- ধ্বংসাবশেষের উপত্যকা। চোখ খুললেই বিধ্বস্ত জনপদ। ডানে-বামে, সামনে-পেছনে কেবলই ভাঙা অট্টালিকা। ইট-পাথরের মরুভূমি। বাস্তুহারা সেই নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের দশা এবার ইসরাইলের বেশ কয়েকটি শহরেও। রাখঢাক ভেঙে রোববার জেরুজালেম পোস্টের খবরেও বলা হয়েছে, শত শত মানুষের মানুষের মাথার ছাদ উড়ে গেছে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ধামাকায়। 

মাত্র ৪ দিনেই আগ্রাসী দম্ভে চিড় ধরেছে ইসরাইলের। ৬১৯ দিনের হামলায় গাজায় যে ধ্বংসস্তূপের মানচিত্র ইসরাইল বুনেছে; সেই চাদরেই তাদের মুড়ে দিয়েছে ইরান। মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে উল্কা গতিতে ধেয়ে আসা ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে পরভূমির আলিশান প্রাসাদ। রাজধানী তেল আবিব, বন্দরনগরী হাইফা দেখার মতো নেই! পৌঢ় বন্ধুর মতো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কঙ্কালসার শরীরে দাঁড়িয়ে আছে ডজনের পর ডজন ঘরবাড়ি। জেরুজালেম, বাত ইয়াম, পেতাহ তিকভা, মোশার জাদিয়েল, বনি ব্রাক শহরগুলোর কপালেও গাজার তিলক লেপে দিয়েছে ইরান। এএফপি, সিএনএন, বিবিসি, রয়টার্স।

ইরানের পালটা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলায় সোমবারও কেঁপে উঠেছে ইসরাইলের মাটি। যুদ্ধ গড়িয়েছে চতুর্থ দিনে। আজ পঞ্চম দিনে গড়াল। কিন্তু সেই প্রথম দিনের মতোই এখনো গর্জে উঠছে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র। বৃষ্টির মতো ছোড়া শত শত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে ইসরাইলের শহরগুলো। এদিন ভোরে পেতাহ তিকভা, হাইফা, বনি ব্রাক, তেল আবিবসহ একাধিক শহরে আছড়ে পড়েছে অন্তত ৪০টি ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র। এতে নিহত হয়েছেন ৮ জন। আহত ২৮৭। ধসে পড়েছে বহুতল ভবন, ঘরবাড়ি ভেঙে চুরমার, চারদিকে ধোঁয়া, ধ্বংসস্তূপ আর আতঙ্কে ইসরাইলের অভ্যন্তরে যেন নেমে এসেছে যুদ্ধক্ষেত্রের বিভীষিকাময় ছায়া।

ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইরানের হামলায় পেতাহ তিকভায় ৪, হাইফায় ৩ এবং বনি ব্রাকে ১ জন নিহত হয়েছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোমবার ভোর ৪টার কিছু আগে ইরান একযোগে প্রায় ৪০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। যেগুলোর অধিকাংশই ইসরাইলের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় বাধা পায়। তবে কিছু ক্ষেপণাস্ত্র বাধা ভেঙে আবাসিক ভবন ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আঘাত হানে। এর ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং বহু মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়ে। সোমবার ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে, গত ৪ দিনের হামলায় দেশটিতে নিহত হয়েছেন ২৪। আহত ৫৯২ জন। ইরানে ২২৪ জনের প্রাণহানি। আহত ১২৭৭ জন। এপি। 

তেল আবিবে মার্কিন দূতাবাসে আঘাত : রোববার রাতে তেল আবিবেও দুটি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে। এতে বেশ কয়েকটি ভবনে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শহরটিতে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসের একটি শাখা ভবনও সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে কোনো কূটনীতিক আহত হননি। দূতাবাস ও কনস্যুলেটগুলো এখনো বন্ধ রয়েছে এবং মার্কিন নাগরিকদের আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থানের নির্দেশ জারি রয়েছে।

পেতাহ তিকভায় ধ্বংসস্তূপে প্রাণহানি : ইরানের ছোড়া একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলের পেতাহ তিকভার একটি ২০তলা আবাসিক ভবন বিধ্বস্ত করে দেয়। ভবনের চতুর্থ ও পঞ্চম তলা ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হামলায় ৪ জন নিহত হয়েছেন। 

নেতানিয়াহু দফতর বলছে, শুক্রবার রাত থেকে সোমবার ভোর পর্যন্ত ৩৭০টি ক্ষেপণাস্ত্র ও শতশত ড্রোন হামলা চালিয়েছে ইরান। ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী জানিয়েছে, হামলা নিক্ষিপ্ত প্রায় ৩৫০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের অধিকাংশ প্রতিহত করা হয়েছে। তবুও ২৪ জন নিহত হয়েছেন। এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী মিলে ১২৫টির মতো ড্রোন সফলভাবে গুলি করে নামিয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ইরানের হামলায় ইসরাইলে নিহতের সংখ্যা আরও অধিক হতে পারে। সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে ইরানের মিসাইল লঞ্চার বা ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ যন্ত্রের ‘এক-তৃতীয়াংশ ধ্বংস’ করে দেওয়ার দাবি করেছেন ইসরাইলি সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডিফ্রিন। বলেছেন, আমরা ইরান সরকারের ‘ভূমি থেকে ভূমিতে’ ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণে ব্যবহৃত যন্ত্রের এক-তৃতীয়াংশই ধ্বংস করে দিয়েছি। একই সঙ্গে ইরানের আকাশসীমায় নিজেদের ‘পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ’ অর্জনেরও দাবিও করেছেন এফি ডিফ্রিন। এই দাবির জের ধরেই এদিন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা করেছেন, ‘আমরা বিজয়ের পথে।’ পরে সোমবার রাতের দেওয়া আরেক ববিৃতিতে ইরানের সরকার কাঠামো খুবই দুর্বল মন্তব্য করে বলেন , তেহরানের পারমানবিক স্থাপনায় হামলার পরিকল্পানা ইসরাইলের অনেক আগে থেকেই। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তার প্রতিদিনই কথা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। এপি। 

রোববার ইরানের অভিজাত বাহিনী রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) গোয়েন্দা শাখার প্রধানসহ ও দুই ইরানি জেনারেল নিহত হয়েছেন। তার কিছুক্ষণ পর তেহরানে কুদস ফোর্সের সদর দপ্তরেও হামলা চালায় ইসরাইল। এদিনই মোসাদের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ইরানে এক ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে তেহরান। ২০২৩ সালে গ্রেফতার হওয়া ওই ব্যক্তির নাম এসমাইল ফেকরি। অর্থের বিনিময়ে মোসাদকে গোপন তথ্য সরবরাহের চেষ্টা করেছিলেন তিনি। সোমবার রাত বাড়তেই নতুন হামলা শুরু করে ইসরাইল। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন তেহরানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র সম্প্রচার সংস্থার (আইআরআইবি) ভবনে হামলা চালায়। কিছুক্ষণের জন্য সম্প্রচার বন্ধ থাকার পর পুনরায় সম্প্রচার শুরু হয়েছে। হামলার কিছুক্ষণ আগেই অবশ্য ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ও রেডিও ‘অদৃশ্য হতে যাচ্ছে’ বলে হুমকি দিয়েছেন ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ। ইরানের পশ্চিমাঞ্চলীয় কেরমানশাহ শহরে অবস্থিত ফারাবি হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রের ওপর ইসরাইলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় পুরো ভবন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সোমবার সকাল ৯টার দিকে (স্থানীয় সময়) হামলাটি চালানো হয় বলে জানিয়েছে ইরানি রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আইআরএনএ। 

ইরান ও ইসরাইলের পালটাপালটি হামলার মধ্যে দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে যাত্রা শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস নিমিটজ। জাহাজের গতিপথ শনাক্তকারী ওয়েবসাইট মেরিন ট্রাফিকের তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয় সময় সোমবার সকালে দক্ষিণ চীন সাগর ত্যাগ করে পশ্চিমদিকে যাত্রা করেছে মার্কিন এই রণতরি। সোমবার কানাডায় শুরু হওয়া দুদিনের জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, আমি বলব, ইরান এই যুদ্ধে জিতছে না... তাই দেরি হওয়ার আগেই তাদের কথা বলা উচিত।’ কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কারনির সঙ্গে বৈঠকের শুরুতে এ মন্তব্য করেন তিনি। তার আগে ইরানের সরকার পরিবর্তনসংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর মুখপাত্র টম ওয়েলস বলেছেন, ‘এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা তৈরিতে কোনো দেশেরই সমর্থন নেই।’


ঘটনাপ্রবাহ: ইরান-ইসরাইল সংঘাত


আরও পড়ুন

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম