যুক্তরাষ্ট্রের অপারেশন মিডনাইট হ্যামার : ইরানের ৩ পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলা
ভয়াবহ যুদ্ধের মুখে মধ্যপ্রাচ্য
পার্লামেন্টে হরমুজ প্রণালি বন্ধের অনুমোদন ইরানের * হরমুজ প্রণালি বন্ধ হবে আরেকটি ‘ভয়াবহ ভুল’ : যুক্তরাষ্ট্র * ইরানকে প্রতিশোধ না নেওয়ার আহ্বান জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরাইলের তেল আবিবের রামাত আবিব এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলোয় নিরাপত্তা বাহিনী ও জরুরি পরিষেবা বিভাগের উদ্ধার তৎপরতা -এএফপি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। শান্তি পুনরুদ্ধারে তার ‘দুই সপ্তাহ’ সময়ের দুদিন না যেতেই হামলা চালালেন ইরানে। শান্তিদূতের মুখোশে নিজেই হয়ে উঠলেন ‘মধ্যপ্রাচ্যের অসুর’। ছড়িয়ে দিলেন যুদ্ধের আগুন। ভয়াবহ হুংকার ছেড়ে গর্জে উঠেছে ইরানও। ছুটে গেছে বিশ্ব রাজনীতির দ্বিতীয় পরাশক্তি রাশিয়ার কাছে। ইতোমধ্যে বিশ্ব বাণিজ্যের পথ ‘হরমুজ প্রণালি’ বন্ধের অনুমোদন দিয়েছে দেশটির পার্লামেন্ট। সবমিলিয়ে ভয়াবহ যুদ্ধের মুখে পড়েছে মধ্যপ্রাচ্য। এখনই ঠেকাতে ব্যর্থ হলে চলতে পারে বছরের পর বছর। শনিবার মধ্যরাতের পর ইরানের তিন পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। ফর্দো, নাতনজ ও ইস্পাহান। পরপর ১২টি হামলা চালিয়েছে তিন কেন্দ্রে। হোয়াইট হাউজের ‘সিচুয়েশন রুম’ থেকে সে হামলা পর্যবেক্ষণ করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের বি-২ বোমারু বিমানগুলো দেশটির মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করে। টানা প্রায় ১৮ ঘণ্টা উড়ে গিয়ে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। এতে ১১ জন আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে ইরান।
যুক্তরাষ্ট্রের এই কর্মকর্তা বলেন, হামলায় অংশ নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের বি-২ বোমারু বিমানগুলো মাঝ আকাশে একাধিকবার জ্বালানি নিয়েছে। মার্কিন বিমানবাহিনী এই প্রথম কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের বাংকারবিধ্বংসী বোমা জিবিইউ-৫৭ ব্যবহার করল। একজন মার্কিন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বি-২ বোমারু বিমান ইরানের ভূগর্ভস্থ ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনায় ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের এক ডজন বাংকারবিধ্বংসী বোমা ফেলেছে। অন্যদিকে মার্কিন নৌবাহিনীর সাবমেরিন থেকে ইরানের নাতাঞ্জ ও ইস্পাহান পারমাণবিক স্থাপনায় ছোড়া হয়েছে ৩০টি এলএএম ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র।
এ হামলার মধ্য দিয়ে ইরানের সঙ্গে একেবারে নাক বাড়িয়ে যুদ্ধে জড়াল যুক্তরাষ্ট্র। হামলার পরপরই আবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ইরানকে কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় ফিরতে বলেন। না ফিরলে আরও ভয়ংকর হামলার হুঁশিয়ারিও দেন। হামলায় উচ্ছ্বসিত নেতানিয়াহু ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এ হামলা ‘ইতিহাস বদলে দেবে’। পালটা হুঁশিয়ারিতে দেওয়া ভিডিও বার্তায় ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লা খামেনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যে ক্ষতির মুখে পড়বে, তা ইরানের যে কোনো ক্ষতির চেয়ে বহুগুণ বেশি হবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল ড্যান কেইন জানিয়েছেন, ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’ নামে পরিচালিত অভিযানে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। এ হামলার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বি-২ বোমারু বিমান স্থানীয় সময় শুক্রবার উড্ডয়ন করে। ১৮ ঘণ্টার ফ্লাইট শেষে নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছে হামলা চালায় বিশেষ এই বিমান। মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর পেন্টাগনে রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান কেইন।
রোববার সকাল থেকেই হামলার মাত্রা বাড়িয়েছে ইরান। অত্যাধুনিক খাইবারসহ ভয়াবহ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে তেহরান। ইরানের ছোড়া ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের হামলায় ইসরাইলের রাজধানী তেল আবিবের উত্তরাঞ্চলে বিধ্বস্ত হয়েছে একটি চারতলা আবাসিক ভবন। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ভবনটির মাঝখানে একটি গর্ত হয়ে গেছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের তথ্যমতে, ভবনটির ওপরতলার দেওয়াল ভেঙে গেছে, চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছে সব জানালা। সিএনএনের ইসরাইল প্রতিনিধি জানিয়েছেন, বিস্ফোরণের তীব্রতায় বাইরে উড়ে এসেছে আসবাবপত্র, বিছানার তোশক ও অন্যান্য জিনিসপত্র। তবে কেউ হতাহত হয়েছে কিনা, এ ব্যাপারে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি।
সকাল থেকে শুরু হওয়া বিভিন্ন হামলায় ইরানজুড়ে ৮৬ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরাইল। ইসরাইলের বেন গুরিয়ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) বরাতে এ তথ্য জানিয়েছে কাতারি সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা। আইআরজিসি জানিয়েছে, বিমানবন্দরের পাশাপাশি ইসরাইলের গবেষণাকেন্দ্র, সহায়তা ঘাঁটি এবং কন্ট্রোল ও কমান্ড সেন্টারও ছিল হামলার লক্ষ্যবস্তু। আইআরজিসি আরও জানিয়েছে, রোববার যে হামলা চালানো হয়েছে তাতে তরল ও কঠিন দুই ধরনের জ্বালানিযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্রই ব্যবহার করা হয়েছে। ২০০০ কিলোমিটার পাল্লার খাইবার ক্ষেপণাস্ত্র। দেড় হাজার কেজি ওজনের ওয়ারহেড বহনে সক্ষম। ইরানের মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভারী ওয়ারহেডগুলোর মধ্যে একটি এটি। তরল জ্বালানিচালিত এই ক্ষেপণাস্ত্রটিকে উড়ন্ত অবস্থায়ই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্রযুক্তিগতভাবে এই ক্ষেপণাস্ত্র এতটাই শক্তিশালী যে প্রচলিত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে এই ক্ষেপণাস্ত্র আটকানো বেশ কঠিন।
ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, ইরান দুই দফায় মোট ২৭টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। প্রথম দফায় ২২টি এবং দ্বিতীয় দফায় ৫টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়।
দখলকৃত সিরিয়ার গোলান মালভূমি থেকে শুরু করে উপরের দিকে গালিলি এবং উত্তরাঞ্চলীয় ও মধ্যাঞ্চলীয় উপকূলীয় এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল হামলা।
পালটা হামলায় ইরানের দেজফুল বিমানঘাঁটিতে দুটি ইরানি এফ-৫ যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়েছে বলে দাবি করছে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। আরও দাবি করা হচ্ছে, পৃথক আরেকটি হামলায় ধ্বংস হয়েছে ইরানের আটটি ব্যালিস্টিক মিসাইল লঞ্চার। যার মধ্যে ছয়টি ইসরাইলের হামলার জন্য প্রস্তুত ছিল।
শনিবার রাতেও ইরানের বেশ কয়েকটি স্থাপনায় বড় পরিসরের বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। আইডিএফের তথ্যমতে, একযোগে ২০টি যুদ্ধবিমান দিয়ে ইরানি ভূখণ্ডে হামলা চালানো হয়েছে ওই হামলায়। এসব যুদ্ধবিমান ইরানের ডজনখানেক সামরিক স্থাপনায় আঘাত হেনেছে বলে দাবি করছে তারা।
মার্কিন হামলায় তেজস্ক্রিয়তা বাড়েনি-আইএইএ : আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) বলেছে, ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালানোর পরও ‘আশপাশের এলাকায় তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা বৃদ্ধির’ কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষক সংস্থা রোববার এক বিবৃতিতে এ কথা জানায়। এতে আরও বলা হয়, ‘ইরানের পরিস্থিতি সম্পর্কে আরও তথ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইএইএ তার পরবর্তী মূল্যায়ন জানাবে।’ তেহরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থা ‘অ্যাটমিক এনার্জি অর্গানাইজেশন অব ইরান’ (এইওআই) বলেছে, এ হামলা আন্তর্জাতিক আইন, বিশেষ করে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির (এনপিটি) লঙ্ঘন। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আইআরএনএ একজন কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে বলেছে, যে তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার কথা যুক্তরাষ্ট্র বলছে, আদতে সেখানে তেজস্ক্রিয়তা সৃষ্টি করার মতো কোনো পদার্থ নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের হামলা ‘গোপন প্রস্তুতির’ ফল : যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ বলেছেন, ইরানের যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য চালানো ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হঠাৎ নয়, বরং কয়েক মাসের পরিকল্পনা ও গোপন প্রস্তুতির ফল। এসব অভিযানে মিসডাইরেকশন বা বিভ্রান্তির কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। স্থানীয় সময় শনিবার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এ পরিকল্পনা ছিল দীর্ঘমেয়াদি। এতে ছিল সপ্তাহ ও মাসব্যাপী প্রস্তুতি এবং অবস্থান গ্রহণ-যেন যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্দেশ দেবেন, তখনই আমরা প্রস্তুত থাকি।’ তিনি আরও জানান, ‘এটি ছিল অত্যন্ত নির্ভুলতা ও গোপনীয়তায় ভরা একটি সামরিক পরিকল্পনা। এমনকি আমাদের ই-২ বোমারু বিমানগুলো ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোয় প্রবেশ ও বহির্গমন করেছে, যা গোটা বিশ্ব বুঝতেই পারেনি।’
বিশ্বনেতাদের নিন্দা : ট্রাম্পের ইরান হামলার পর নিন্দা-প্রশ্ন মন্তব্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন বিশ্বনেতারা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, তিনি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তিনি এ হামলাকে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি বলেও উল্লেখ করেছেন। গুতেরেস সতর্ক করে বলেন, ‘এই সংঘাত দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে; যা বেসামরিক মানুষ, এতদঞ্চল ও সারা বিশ্বের জন্যই ভয়ানক পরিণতি ঢেকে আনতে পারে।’
হামলার ‘তীব্র নিন্দা’ জানিয়েছে চীন। পাশাপাশি সব পক্ষকে দ্রুত যুদ্ধবিরতিতে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বেইজিং। বিশেষ করে ইসরাইলকে। রোববার এক বিবৃতিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা আরও বাড়াচ্ছে। নিন্দা জানিয়েছে রাশিয়াও। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে (রোববার) দৃঢ় কণ্ঠে বলেছে, পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা ‘আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা হামলা চালানোর এই দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত। যে যুক্তিই দেওয়া হোক না কেন, আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘ সনদ এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবগুলোর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এই হামলা।’ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘আমরা আগ্রাসন বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছি। চলমান পরিস্থিতিকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পথে ফিরিয়ে নেওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে প্রচেষ্টা বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছি।’
ইস্তাম্বুলের এক সংবাদ সম্মেলনে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবাস আরাঘচি জানিয়েছেন, আজ (রোববার) রাশিয়া যাচ্ছেন তিনি। সোমবার (আজ) রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করবেন। সেখানে ‘গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা’ হবে। আরও বলেন, ‘রাশিয়া ইরানের বন্ধু। আমরা একটা কৌশলগত অংশীদারত্ব উপভোগ করছি। সবসময় আমরা পরস্পরের সঙ্গে পরামর্শ করি এবং সমন্বয় করি।’ আমি আগামীকাল (আজ) রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করব এবং আমাদের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।’ এদিন সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর তার দেশকে আলোচনায় ‘ফিরতে’ ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের আহ্বানের জবাব দিয়েছেন। বলেছেন, ‘ইরান যেটা ছেড়ে আসেনি, সেখানে ফিরবে কীভাবে? গত সপ্তাহে, আমরা যখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা এগিয়ে নিচ্ছিলাম, তখন ইসরাইল তা ভেস্তে দেওয়ার পথ বেছে নেয়। এরপর এ সপ্তাহে এসে, আমরা ইইউর (ইউরোপীয় ইউনিয়ন) সঙ্গে বসেছিলাম। তখন যুক্তরাষ্ট্র বোমা ফেলে সেই কূটনীতিকে উড়িয়ে দিয়েছে।’ আরাঘচির রাশিয়া সফর ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পরেই ইরানকে পালটা প্রতিশোধ থেকে বিরত থাকতে বলেছে জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য। রোববার এক যৌথ বিবৃতিতে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কেইর স্টারমার, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো ও জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎস মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছেন। ‘এমন কোনো পদক্ষেপ’ না নিতে সতর্ক করেছে, যা এই অঞ্চলকে আরও ‘অস্থিতিশীল’ করতে পারে।
যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, ‘ইরানের কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র থাকতে পারবে না।’ ইসরাইলের নিরাপত্তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেছেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা থেকে বিরত রাখা।’ ইরানকে আবারও আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে যেসব উদ্বেগ রয়েছে, সেগুলো সমাধানের জন্য একটি চুক্তি অর্জনে ইরানকে আলোচনায় অংশ নিতে হবে। সেই লক্ষ্যে সব পক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে সহযোগিতা করতে আমরা প্রস্তুত।’ হামলার পরপরই, মার্কিন দোসর আঞ্চলিক দেশগুলোকেও চরম হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইরান। দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা আলী আকবর বেলায়াতি বলেছেন, মার্কিন হামলার পর এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ঘাঁটির আর কোনো স্থান থাকবে না। দেশগুলোর উদ্দেশে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করলে ইরানের বৈধ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে।
তাসনিম সংবাদ সংস্থা অনুসারে, ইরানের ইসলামিক বিপ্লবী বাহিনী (আইআরজিসি) এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘ইরানে যেখান থেকে আগ্রাসন চালানো হয়েছিল সেই স্থানটি চিহ্নিত করেছে।’ প্রসঙ্গত এই অঞ্চলে ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), কাতার, সৌদি আরব, বাহরাইন, কুয়েত, জর্ডান এবং সিরিয়ায় মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে। প্রায় ৪০ সেনা রয়েছে ঘাঁটিগুলোতে। এর কিছুক্ষণ পরেই (রোববার) ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সঙ্গে ফোনালাপ শেষে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পালটা জবাবের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান। বলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে ‘তাদের আগ্রাসনের জন্য জবাব দিতে হবে।’ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ওই বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘ইরান সামরিক আগ্রাসনের শিকার হয়েছে এবং অটলভাবে নিজেদের রক্ষা করেছে। আমাদের জাতি কখনোই গুন্ডামি ও নিপীড়নের কাছে আত্মসমর্পণ করবে না।’ এদিকে হরমুজ প্রণালি বন্ধ না করার বিষয়ে ইরানকে রাজি করানোর জন্য চীনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। শনিবার রাতে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ফক্স নিউজকে বলেছেন, ‘যারা হরমুজ প্রণালি দিয়ে তেল পরিবহণের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, সেই চীনের সরকারকে আমি উৎসাহিত করব তারা যেন এ বিষয়ে (ইরানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে) যোগাযোগ করে। হরমুজ প্রণালি বন্ধ করা ইরানের জন্য আরেকটি ‘ভয়াবহ ভুল’ বলে অভিহিত করেছেন তিনি।
ফোর্দো পরমাণু স্থাপনা ‘অনেক আগেই’ খালি করা হয় : তিনটি পরমাণু স্থাপনায় চালানো মার্কিন হামলার কথা স্বীকার করেছে ইরান। দেশটির কোম এলাকায় পার্লামেন্ট সদস্য মানান রাইসি জানিয়েছেন, হামলায় ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনার ‘মারাত্মক কোনো’ ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র এই হামলা চালাতে পারে, এমন অনুমান থেকে স্থাপনাটি ‘অনেক আগেই’ খালি করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন ইরানের পার্লামেন্টের স্পিকার মোহাম্মদ বাগের গালিবাফ।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি মহাকাশপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাক্সারের ধারণ করা স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা গেছে, ১৯ ও ২০ জুন ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনার প্রবেশপথে ১৬টি পণ্যবাহী ট্রাক অবস্থান করছিল। এ সময় সেখানে কিছু বুলডোজারও দেখা যায়। তবে ট্রাকগুলোতে করে কী পরিবহণ করা হয়েছে, তা জানা যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের হামলার জবাব দেওয়ার প্রত্যয় ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর : ইরানের তিন পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার জবাব দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি। তিনি বলেছেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার মাধ্যমে ট্রাম্প শুধু ইরানই নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের সঙ্গেও ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করেছেন। রোববার ইস্তাম্বুলে ওআইসির এক বৈঠকে দেওয়া ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ইরানের পরমানু স্থাপনায় হামলা চালানোর জন্য শুধু এবং পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রই দায়ী। এর চরম এবং ভয়াবহ পরিণতি যুক্তরাষ্ট্রকেই ভোগ করতে হবে। ইরানের তিন পরমাণু স্থাপনায় হামলা করে যুক্তরাষ্ট্র চরম সীমা লঙ্ঘন করেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল যুদ্ধে জড়ানো বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচিত হয়ে এসেছিলেন। কিন্তু এখন তিনি উলটো আমাদের (ইরান) সঙ্গে কূটনীতির নামে প্রতারণা করেছেন এবং একজন ওয়ান্টেড যুদ্ধাপরাধীর মিশনে জড়িয়ে নিজ দেশের ভোটারদেরকেও ঠকিয়েছেন। এমন এক যুদ্ধাপরাধীর মিশনে তিনি (ট্রাম্প) শামিল হয়েছেন, যে কিনা ইসরাইল রাষ্ট্রের লক্ষ্য এগিয়ে নিতে মার্কিন নাগরিকদের জীবন ও সম্পদ নিংড়ে নিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হয়েও ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ সনদ, আন্তর্জাতিক আইন ও পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করেছে। তিনি বলেন, আজকের সকালের (শনিবার) ঘটনা চরমভাবে নিন্দনীয় এবং এর দীর্ঘস্থায়ী পরিণতি থাকবে। জাতিসংঘের প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রেরই অত্যন্ত বিপজ্জনক, আইনবহির্ভূত ও অপরাধমূলক এই আচরণ নিয়ে সোচ্চার হওয়া উচিত। জাতিসংঘ সনদ ও সেখানে দেওয়া আত্মরক্ষার বিধান অনুসারে, ইরান তার সার্বভৌমত্ব, স্বার্থ এবং জনগণকে রক্ষায় সব বিকল্প খোলা রাখছে। এদিকে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার মাধ্যমে যুদ্ধ শুরু হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে ইয়েমেনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী হুতিরা। রোববার আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। হুতিদের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য মোহাম্মদ আল-ফারাহ দাবি করেছেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলা যুদ্ধের সমাপ্তি নয়, বরং এটি ‘যুদ্ধের সূচনা’।
এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ট্রাম্প দ্রুত শত্রুতা শুরু করে যুদ্ধের সমাপ্তি চান বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এখানে-সেখানে পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করা যুদ্ধের শেষ নয়, এটি শুরু। তিনি আরও বলেন, আঘাত করে পালিয়ে যাওয়ার সময় এখন শেষ।
