Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

মাথার উপর দিয়ে উড়ছিল ক্ষেপণাস্ত্র

Icon

মার্জিয়া আলী সালসাবিল

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মাথার উপর দিয়ে উড়ছিল ক্ষেপণাস্ত্র

মার্জিয়া আলী সালসাবিল

ভয়ংকর সই ভোর। লিখতে বসে এখনো গা শিউরে উঠছে আমার। ১৩ জুন, শুক্রবার ভোর রাত। ফজরের ঠিক কাছাকাছি সময়। পড়ালেখার চাপ চলছিল। পুরো রাত জেগেইছিলাম সেদিন। হঠাৎ বিকট শব্দ। পরপর দুটি। কি ভয়ংকর সে আওয়াজ। একেবারেই অপরিচিত। মনে হলো যেন গমগম করে উঠল চার পাশ। কেঁপে উঠলে কান। ভয়ে হকচকিয়ে উঠেছিলাম প্রথমে। ভেবেছিলাম হয়তো বজ পাত হয়েছে। ইরানে এই সময়ে বৃষ্টি হয়। বজ পাতও হয় মাঝে মাঝে। কিন্তু আমার রুমমেট বলল, এটা বজ পাতের আওয়াজ নয়। বললাম এটা বজ পাতই হবে। যেহেতু আলোচনা চলছে, এখন হামলা হবে না। ১৫ তারিখেও একটি আলোচনা হওয়ার খবর পড়েছি। সেটা না হতেই কিভাবে হামলা হয়? বের হয়ে আকাশ দেখে নিশ্চিত হলাম- বজ পাত নয়। হামলাই হয়েছে। এরই মধ্যে আরও কয়েক দফা আওয়াজ শোনা যায়। একের পর এক কানফাটা শব্দ। ততক্ষণে জেগে উঠেছে হোস্টেলের বাকিরাও। সবাই ভীতসন্ত্রস্ত। শব্দটা এত তীব্র ছিল যে, মনে হচ্ছিল এই বুঝি একটি পড়ল আমাদের হোস্টেলের ছাদে। দু-পা আগ বাড়িয়ে জানালার শিক ধরে কিংবা বেলকনিতে গিয়ে মাথাটা একটুখানি বের করে আবার আকাশটা দেখব- সে সাহসও আর পাচ্ছিলাম না আমরা।

সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্ববিদ্যালয় (আলজাহরা) থেকে অ্যানাউন্সমেন্ট আসে যেন আমরা সবাই ফার্স্ট ফ্লোরে অবস্থান করি। মুহূর্তেই দৌড়-ছোটাছুটি। কান্নাকাটি হৈচৈ। হুড়মুড় করে নেমে পড়লাম সবাই। তখনো ক্রমাগত আমরা আমাদের মাথার উপর দিয়ে ফাইটার জেট যাওয়ার আওয়াজ পাচ্ছিলাম। সে কি রুদ্ধশ্বাস সময়। ‘জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ’ বলে বইয়ের পাতায় পড়ে বড় হওয়া কথাটির বাস্তব দৃশ্যের সঙ্গে সেদিনই প্রথম দেখা হলো আমার।

সেদিন সকালেই আমাদের সবার মোবাইল সিমে ইরান গভর্নমেন্ট হতে এসএমএস আসে বর্তমান অবস্থা ও সতর্কতা নিয়ে। উল্লেখ করা হয় যে, প্রতিশোধ নেওয়া হবে এবং এই যুদ্ধের শেষ ইরানের হাতে লেখা হবে। এরপর আমরা নরমাল জীবনে ফিরে যাই যে যার কাজে। তেমন একটি অস্বাভাবিক কেউ আর ছিল না।

১৪ জুন মাঝরাতে আবার দুই দেশের পালটাপালটি হামলা শুরু হয়। আমাদের মাথার উপর দিয়ে আমরা একেকটা মিসাইল ভূপাতিত হতে দেখছিলাম। তবে কিছু মিসাইল আবার আঘাতও হানছিল। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এরিয়া ইরানের একটি তেহরান শহরে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়। ইরানের মিডিয়া, মিলিটারি অনেক ফ্যাসিলিটি এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ অনেক স্থাপনা আমার ভার্সিটি এলাকায় তথা ভানাক এলাকায়।

ওই মুহূর্তে আমরা অনেক ভয়ে ছিলাম। সবারই নির্ঘুম রাত, ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় রাতযাপন। কিন্তু নেটিভ ইরানিয়ানদের মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না, তারা ছিল নিডর। তাদের যখন জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভয় পাও না?’ তারা বলে, ‘আমরা বীরের জাতি। আমরা শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা রাখি। আমরা ভয় পাই না। আমাদের ইতিহাস এমনই।’

সেই রাতে আমাদের ভার্সিটি থেকে জানানো হয়, সেইফ বেসমেন্টের দিকে যেতে। ভার্সিটির একটু পেছনের দিকে বনজঙ্গলের মতো দেখতে জায়গায় অবস্থিত। সেখানে একটা গ্রাউন্ড ফ্লোর ছিল অনেক শব্দ, আওয়াজের মাঝে আমরা অনেক ভয়েই ছিলাম। তাই আমরা সেই বেসমেন্ট শিফট হয়ে যায়। কিন্তু সেখানেও আমরা বাইরের অবস্থা আন্দাজ করা যাচ্ছিল। এই সিচুয়েশনে আমাদের অবস্থা অনেক খারাপ হয়েগিয়েছিল, আমরা প্রায় খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলাম। চার দিকের অবস্থা নিজের চোখে দেখে আমরা ট্রমাতে চলে গিয়েছিলাম। খাওয়া দাওয়া ঘুম সব প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম।

১৪ জুন সকালে ইরানে একটি ইসরাইলবিরোধী সমাবেশ হয়। সেখানে সব ইরানি জনগণ তাদের ইরানের পক্ষে অবস্থান করে এবং সভা সমাবেশ করে। তারা জীবনের পরওয়া না করে সেই সমাবেশে অংশগ্রহণ করে। তাদের চেহারায় ভয়ের কোনো ছাপ ছিল না। ১৬ জুন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৭ জুনের মধ্যে খালি করার নির্দেশ আসে। তখন ইরানিরা তাদের বাসায়, পাকিস্তানিরা নিজ দেশে ফিরে যেতে থাকে, অন্য ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টরা অন্য শহরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

লেখক পরিচিতি : ইসরাইলের ইরান হামলার সেই ভয়াল রাতের অভিজ্ঞতা নিয়ে সোমবার যুগান্তরে লিখলেন তেহরানে আলজাহরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বাংলাদেশি শিক্ষার্থী মার্জিয়া আলী সালসাবিল।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম