অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা
হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে দেশ বিপদে পড়বে
মনির হোসেন
প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলার জবাবে পণ্য পরিবহণে গুরুত্বপূর্ণ নৌ চ্যানেল হরমুজ প্রণালি বন্ধ করতে যাচ্ছে ইরান। ইতোমধ্যে দেশটির পার্লামেন্টে এ সংক্রান্ত বিল পাশ হয়েছে। সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন হলে বিশ্ববাণিজ্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন দেশের অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলো বড় ধরনের বিপদে পড়বে।
তাদের মতে, নৌ চ্যানেলটি বন্ধ হলে বাংলাদেশের কয়েকটি খাতের ওপর প্রভাব পড়বে। এতে জ্বালানি সংকট তৈরি হবে, দেশের বাজারে পণ্যমূল্য বাড়বে, আমদারি-রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমবে। এছাড়াও চলমান যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে ছড়ালে দেশের প্রবাসী আয়ে (রেমিট্যান্সে) নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বিশ্লেষকদের মতে, পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। এর মধ্যে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তি এবং পণ্য পরিবহণে জাহাজ সংকট যাতে না হয়, সেজন্য কাজ করতে হবে।
প্রসঙ্গত, ইসরাইলের সঙ্গে চলমান যুদ্ধের মধ্যেই শনিবার রাতে ইরানের তিনটি পারমাণবিক কেন্দ্রে বোমা হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় রোববার ইরানের পার্লামেন্টে হরমুজ প্রণালি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে এখনো ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই হরমুজ প্রণালি একটি সরু জলপথ। এটি পশ্চিমের পারস্য উপসাগরকে পূর্বে ওমান উপসাগর ও আরবসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। এ পথটি ইরানের নিয়ন্ত্রণে। আন্তর্জাতিকভাবে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খনিজ তেলবাহী জাহাজ যাতায়াতের এটিই একমাত্র পথ। বর্তমানে এশিয়ার মোট জ্বালানির ৮০ শতাংশ এবং বিশ্বের ২০ শতাংশ তেল এ পথে পরিবহণ করা হয়। এছাড়াও এটি বন্ধ হলে সব ধরনের আমদানিতে প্রভাব ফেলবে। বর্তমানে বাংলাদেশের আমদানির ৩০ শতাংশই তিন ধরনের পণ্য। এগুলো হচ্ছে জ্বালানি তেল, খাদ্য ও সার। এসব পণ্যের অধিকাংশই হরমুজ প্রণালি দিয়ে আমদানি হয়।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডির) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, হরমুজ প্রণালি জ্বালানি ও অন্যান্য পণ্য আমদানির অন্যতম নৌরুট। এপথ বন্ধ হলে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ভিন্ন চ্যানেলে অনেক দূর দিয়ে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করতে হবে। এতে খরচ বাড়বে মিলিয়ন ডলার। এর প্রভাব পণ্যের দামের ওপরে পড়বে। পণ্য আনতে সময়ও অনেক লাগবে।
তিনি বলেন, এর আগে জাহাজ সংকটে আমদানিতে সমস্যা হয়েছে। অর্থাৎ হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে পরিবহণ খরচ বাড়বে, যা দেশের আমদানি-রপ্তানিতে প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, এ যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে বিস্তৃত হলে আমাদের রেমিট্যান্সেও (প্রবাসী আয়) নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কমে যাবে রেমিট্যান্স। সব মিলে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এটা খুবই নেতিবাচক হবে।
তিনি আরও বলেন, এর আগে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ হয়েছে। ওই দুই দেশ বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে। কিন্তু যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্য এবং জ্বালানির দাম বেড়েছিল। এতে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, মুদ্রার বিনিময় এবং আমদানিকৃত পণ্যমূল্য বেড়েছিল। নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল মূল্যস্ফীতিতে।
তিনি আরও বলেন, যুদ্ধ আগামী দিনে আরও বিস্তৃত হলে আমাদের এখনই প্রস্তুত থাকতে হবে। রিজার্ভে বড় ধরনের টানাটানি না হয়, সেটি বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। আমদানি সাশ্রয়ী বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। জ্বালানি সংকটে আমরা যাতে বিপদে না পড়ি, সেজন্য চুক্তিগুলো ঠিকমতো করার দিকে নজর দিতে হবে।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হলো-জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাবে। যেহেতু বাংলাদেশ জ্বালানি তেল আমদানির ওপর নির্ভরশীল, তাই পণ্যটির দাম বাড়লে অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। দ্বিতীয় বিষয় হলো শ্রমবাজার। এখানে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কারণ, ইসরাইলে বাংলাদেশের শ্রমিক না থাকলেও ইরানে কিছু আছে।
জানতে চাইলে উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক এম কে মুজেরী যুগান্তরকে বলেন, বর্তমানে যুদ্ধ ইরান-ইসরাইলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখানে যুক্তরাষ্ট্রও জড়িয়েছে। ইতোমধ্যে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা তৈরি করেছে। আর বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকটাই মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফলে এ যুদ্ধ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তবে এই প্রভাবের গভীরতা নির্ভর করবে যুদ্ধ কতটা দীর্ঘ স্থায়ী হয়, তার ওপর।
তিনি বলেন এখানে কয়েকটি শঙ্কা আছে। প্রথমত, বাংলাদেশ জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরশীল। এসব জ্বালানি মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানি করা হয়। এর মধ্যে এলএনজি (তরল প্রাকৃতিক গ্যাস) এবং ক্রুড অয়েল (অশোধিত তেল) অন্যতম। দ্বিতীয় বিষয় হলো শ্রমবাজার। বাংলাদেশের শ্রমিকদের অধিকাংশই মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করে। গত কয়েক মাসে দেশের অর্থনীতিতে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে, এর সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব রেমিট্যান্সের (প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ)। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য অস্থির হলে রেমিট্যান্স কমবে। এটি দেশের অর্থনীতিতে বড় আঘাত করবে। তৃতীয়ত, ইতোমধ্যে হরমুজ প্রণালি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইরান। এটি বন্ধ হলে তেল সরবরাহ ব্যাহত হবে। এতে বাংলাদেশে বিনিয়োগে প্রভাব পড়বে। বাড়বে পরিবহণ ভাড়া। পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। মূল্যস্ফীতিতেও প্রভাব ফেলবে। এছাড়াও সরকার জ্বালানি তেলের যে মূল্য সমন্বয়ের চেষ্টা করছে, সেটিও বন্ধ হয়ে যাবে। তবে সবকিছু নির্ভর করবে যুদ্ধ কতদিন দীর্ঘ স্থায়ী হয়, তার ওপর।
জানতে চাইলে তৈরি পোশাক খাতের মালিকপক্ষের সংগঠন বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ যুগান্তরকে বলেন, এই হরমুজ প্রণালি দিয়ে বিশ্বের ২০ শতাংশ জ্বালানি তেল পরিবহণ করা হয়। বাংলাদেশের জন্যও এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বাংলাদেশের জ্বালানিও কাতার ও ওমানের মতো দেশ থেকে আসে। ফলে হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে বাংলাদেশে জ্বালানি সংকট দেখা দেবে।
তিনি বলেন, অন্য চ্যানেলের মাধ্যমে জ্বালানি তেল আমদানি হলেও এর খরচ ও সময় অনেক বাড়বে। অপরদিকে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বাংলাদেশেও। এতে বাংলাদেশের রপ্তানিতেও প্রভাব পড়বে। সবকিছু মিলে হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো বড় বিপদে পড়বে।
