Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

প্রহসনের নির্বাচন করার অভিযোগ

সাবেক সিইসি নূরুল হুদা চার দিনের রিমান্ডে

ঢাকায় বসে প্রত্যন্ত অঞ্চলে নির্বাচনে কী হচ্ছে-তা জানার সুযোগ নেই : নূরুল হুদা * আপনি শপথ নিয়ে একথা বলতে পারেন না : আদালত * রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখতে প্রত্যেক ডিসিকে নির্দেশ দেন তিনি : পিপি

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সাবেক সিইসি নূরুল হুদা চার দিনের রিমান্ডে

সাবেক সিইসি নূরুল হুদাকে সোমবার আদালতে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ছবি: যুগান্তর

সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদাকে ৪ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন আদালত। অন্যায় প্রভাব খাটিয়ে প্রহসনের নির্বাচন দেওয়ার অভিযোগে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় করা মামলায় শুনানি শেষে এই আদেশ দেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান। সোমবার বিকালে রিমান্ড শুনানিতে আদালতের এক প্রশ্নে কেএম নূরুল হুদা বলেন, ঢাকায় বসে প্রত্যন্ত অঞ্চলে নির্বাচনে কী হচ্ছে-সবটা জানার সুযোগ নেই। এ সময় আদালত তাকে বলেন, ‘আপনি শপথ নিয়ে একথা বলতে পারেন না।’ 

এদিন বিকাল ৩টা ২ মিনিটে কেএম নূরুল হুদাকে আদালতে নিয়ে আসা হয়। এ সময় তাকে আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। পরে ৪টা ৯ মিনিটে নূরুল হুদাকে পুলিশ প্রহরায় হেলমেট, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও হাতকড়া পরিয়ে আদালতের কাঠগড়ায় তোলা হয়। এ সময় তার পরনে পাঞ্জাবি ও পায়জামা ছিল। তখন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা কাঠগড়ার কাছে যান। তাদের দেখে নূরুল হুদা হেসে কথা বলতে থাকেন। এরপর তার বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট খোলা হয়। এ সময় হাত উঁচিয়ে তিনি সবাইকে ইশারা করেন। তখন তাকে হাস্যোজ্জ্বল দেখা যায়। তবে পুলিশ সদস্যরা তাকে সরিয়ে কাঠগড়ার পেছনে পাঠিয়ে দেন। তখন তিনি দেওয়ালে হেলান দিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। রিমান্ডের বিষয়ে শুনানি শুরু হলে তিনি কাঠগড়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ান। রাষ্ট্রপক্ষ এবং আসামিপক্ষের বক্তব্য শোনেন। এরপর আদালত তার বক্তব্য শোনেন। পরে রিমান্ডের আদেশ দেন।

১১ কারণ দেখিয়ে রিমান্ড চান তদন্ত কর্মকর্তা : শেরেবাংলা নগর থানার উপপরিদর্শক শামসুজ্জোহা সরকার আদালতে ১১টি কারণ দেখিয়ে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। এগুলো হচ্ছে-১. গ্রেফতার আসামি ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চনকালে বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু তিনি সেই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক সম্পন্ন করতে পারেননি এবং দেশকে গভীর সংকটের মধ্যে নিমজ্জিত করেছেন; ২. প্রশাসনকে একটি পক্ষে ব্যবহার করেছেন। এতে সংবিধান অমান্য করেছেন এবং শপথ ঠিক রাখতে পারেননি; ৩. দণ্ডবিধি আইনের ১৭১ক ধারার সংজ্ঞামতে নির্বাচনের ছদ্মবেশ ধারণ করে দিনের ভোট রাতে সম্পাদন করার নিমিত্তে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানকে বাধা দিয়ে নির্বাচন সম্পন্ন করেন। তিনি নির্বাচন বডির প্রধান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি অন্যান্য কমিশনার এবং বিভাগীয় ও জেলা, উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন; ৪. ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সরকারি আদেশ, সাংবিধানিক ক্ষমতা হ্রাস, দেশের জনগণের ভোটাধিকার লঙ্ঘন করেছেন। তরুণ সমাজের ভোটবিমুখ, ভাবমূর্তি নষ্ট করেছেন ; ৫. আসামি ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার থাকাবস্থায় কার পরামর্শে ও সহযোগিতায় ভোটকেন্দ্রে নিয়োজিতদের দিয়ে দিনের ভোট রাতে সম্পন্ন করে মিথ্যা বিবৃতির মাধ্যমে একটি দলকে বিজয়ী ঘোষণা করেন এবং মিথ্যা গেজেট প্রকাশ ও বাস্তবায়ন করেন; ৬. তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসাবে দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একটি দলকে বিজয়ী ঘোষণা করার লক্ষ্যে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে প্রহসনমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা গ্রহণ করে কত টাকা ঘুস গ্রহণ করেছেন তা উদ্ঘাটন। যেখানে কোটি কোটি নতুন প্রজন্মের ভোটাররা ভোট দিতে পারেননি। তাতে দেশে স্বৈরাচারের বীজ বপন করা হয়েছিল; ৭. নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও গ্রেফতার আসামি সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদা কার ইন্ধনে ও কী স্বার্থে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্পূর্ণভাবে জনগণকে তাদের ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে; ৮. গ্রেফতার আসামি একজন ফ্যাসিবাদী বডির মূল নায়ক। তার কাছ থেকে পাতানো নির্বাচনের কৌশল ও জড়িতদের উদ্ঘাটন করা দরকার; ৯. গ্রেফতার আসামি কোন কোন সংসদ আমলে কার কার কাছ থেকে কত টাকা ঘুস গ্রহণ করে ফলাফল পরিবর্তন করে গেজেটে সাজানো ভোটের ফলাফল প্রকাশ করেছেন, তার তথ্য উদ্ঘাটন করা দরকার; ১০. এজাহার নামীয় পলাতক ও অজ্ঞাতনামা আসামিদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ ও গ্রেফতার; এবং ১১. মামলার মূল রহস্য উদ্ঘাটন।

শুনানিতে যা হলো : ৪টা ১৭ মিনিটে বিচারক এজলাসে ওঠেন। বেলা ৪টা ২৯ মিনিটে নূরুল হুদার রিমান্ড শুনানি শুরু হয়। তখন তিনি পেছন থেকে কাঠগড়ার সামনে এসে দাঁড়ান। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপপরিদর্শক শামসুজ্জোহা সরকার তার ১০ দিন রিমান্ড আবেদনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। তখন কাঠগড়ার রেলিঙে দুই হাত রেখে তিনি মাথা নিচু করে ছিলেন। এ সময় তাকে বিষণ্ন চেহারায় দেখা যায়। শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের পিপি ওমর ফারুক ফারুকী রিমান্ডের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, আসামি নূরুল হুদা ফ্যাসিস্ট হাসিনার তিনি অন্যতম একজন। তিনি জনতার হাতে কট হয়েছেন। হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট করার পেছনে যে কয়জন আছেন, তার মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশি দায়ী। তিনি যদি মানুষের পাশে থাকতেন, তাহলে শেখ হাসিনা ফ্যাসিস্ট হতো না। তিনি দেশের সার্বভৌমত্বের ক্ষতি করেছেন। জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। তিনি নিশি রাতের ইসি।

পিপি ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, তিনি (নূরুল হুদা) প্রত্যেক ডিসিকে নির্দেশ দেন, যাতে রাতে ভোট ভরে (বক্সে ব্যালট পেপার) রাখা হয়। রাতে বিরিয়ানি খাওয়ার টাকা দেওয়া হয়েছে। সকালে ভোট দিতে গিয়ে জনগণ জানতে পারেন, ভোট আর নেই। ভোট তো হয়ে গেছে, জনগণ ভোট দিয়ে দিয়েছে। পরে নূরুল হুদা এই নির্বাচনকে বৈধ ঘোষণা করেন। এজন্য তাকে বলা হয়, নিশি রাতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তিনি হাসিনার সঙ্গে যড়যন্ত্র করেছেন। তিনি ভোট চোরদের সহায়তাকারী। প্রহসনের নির্বাচনকে বৈধতা দিয়েছেন। তার ১০ দিনের রিমান্ড প্রার্থনা করছি। 

পরে আসামিপক্ষের আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম সজীব রিমান্ড বাতিল ও জামিন চেয়ে আবেদন করেন। শুনানিতে তিনি বলেন, আপনি মামলার ধারাগুলো দেখবেন। প্রতিটি জামিনযোগ্য ধারা। অথচ এ মামলায় রিমান্ড চাওয়া হচ্ছে, যা সম্পূর্ণরূপে মামলার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তিনি জামিন পাওয়ার হকদার। জামিনযোগ্য ধারায় রিমান্ড চাওয়ার কোনো আইন নেই। তিনি তো জাল ভোট দেননি। এই ধারা তার সঙ্গে যায় না। আইনানুযায়ী তিনি জামিন পেতে পারেন। আইনগতভাবে এ মামলা চলার সুযোগ নেই। ত্রুটিপূর্ণ এজাহারে রিমান্ড দেওয়ার সুযোগ নেই। 

পরে আদালত নূরুল হুদার কাছে জানতে চান, আপনি মনে করেন দায়িত্ব নেওয়ার পর আপনি শপথভঙ্গ করেছেন? তখন নূরুল হুদা বলেন, ‘না, আমি মনে করি না।’ তখন বিচারক বলেন, আপনার নির্বাচনে সবাই ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছেন? তখন নূরুল হুদা বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন ৫টা লোক নিয়ে গঠিত। আর এ নির্বাচনের জন্য আরও ১৫ লাখ লোক নিয়োজিত থাকে। রিটার্নিং কর্মকর্তা, প্রিসাইডিং অফিসার, পুলিশ, আর্মি-সবাই থাকে। তাদের সবার ওপর নির্বাচনের দায়িত্ব থাকে। ঢাকায় বসে প্রত্যন্ত অঞ্চলে নির্বাচনে কী হচ্ছে, সবটা জানার সুযোগ নেই।’ তখন বিচারক বলেন, আপনি শপথ নিয়ে এ কথা বলতে পারেন না। পরে বিচারক আবার বলেন, যারা ভোট কারচুপি করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন? তখন নূরুল হুদা বলেন, ‘নির্বাচন হয়ে গেলে নির্বাচন কমিশনের হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। এরপর হাইকোর্ট ব্যবস্থা নেন।’ এরপর আদালত জানতে চান, নির্বাচনের পর থেকে নির্বাচনি কর্মকর্তারা আপনার অধীনে। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে আপনি ব্যবস্থা নিয়েছেন? নির্বাচনের আগে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের যে হুংকার মুভমেন্ট ছিল, আপনি তা দেখেছেন? এ বিষয়ে নূরুল হুদা আদালতে বলেন, ‘আমি এমন কিছু দেখিনি। এসপি অফিস বা পুলিশকে টাকা দেওয়া হয়েছে-এমন কোনো অভিযোগ ছিল না নির্বাচন কমিশনে। এজন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পরে শুনানি শেষে আদালত তার ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। 

প্রসঙ্গত, রোববার (২২ জুন) সন্ধ্যার দিকে রাজধানীর উত্তরায় স্থানীয় জনতা তাকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। এর আগে একই দিন আওয়ামী লীগ আমলে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে আসামি করে মামলা করেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মো. সালাহউদ্দিন খান। রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় করা এ মামলায় মোট ২৪ জনকে আসামি করা হয়।


Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম