Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

মব ভায়োলেন্স দমবে না কঠোর পদক্ষেপ ছাড়া

১০ মাসে সারা দেশে মবের শিকার হয়ে গণপিটুনিতে ১৭৪ জন মারা গেছেন-আসক

ইমন রহমান

ইমন রহমান

প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মব ভায়োলেন্স দমবে না কঠোর পদক্ষেপ ছাড়া

ছবি : সংগৃহীত

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই এখন আতঙ্কের নাম মব ভায়োলেন্স। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নানা ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন-এমন ব্যক্তিদের টার্গেট করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে নিরপরাধ ব্যক্তিও মব ভায়োলেন্সের শিকার হচ্ছেন। ফ্যাসিস্টের দোসর আখ্যা দিয়ে দল বেঁধে কারও বাসাবাড়ি বা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি, টেনেহিঁচড়ে এনে নির্যাতন করা এবং অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতনে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। এতে ছড়াচ্ছে উদ্বেগ। এমনকি আসামিকে আদালতে তোলার সময়ও মব সৃষ্টি করে হামলার ঘটনা ঘটছে।

এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে মবের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হলেও বাস্তবে কোনো কাজে আসছে না। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার এ প্রবণতা ঠেকাতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে কার্যত ব্যর্থ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মব ভায়োলেন্সের অসংখ্য ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ছে, যার অনেকই গা শিউরে ওঠার মতো। বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছে, ১০ মাসে মবের শিকার হয়ে এবং গণপিটুনিতে সারা দেশে ১৭৪ জন মারা গেছেন।

পুলিশও রেহায় পাচ্ছে না মব ভায়োলেন্স থেকে। আসামি ছাড়িয়ে নেওয়া এবং বেআইনি দাবিতে থানা ও পুলিশের যানবাহন ঘেরাও করে হামলা হচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র বলছে, ১০ মাসে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় ৪৭৭টি মামলা হয়েছে। ২০২৪ সালের আগস্টে পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনায় মামলা হয়েছে ৪১টি, সেপ্টেম্বরে ২৪, অক্টোবরে ৩৪, নভেম্বরে ৪৯, ডিসেম্বরে ৪৪, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৩৮, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭, মার্চে ৯৬, এপ্রিলে ৫২ এবং মে মাসে ৬২টি।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে মব ভায়োলেন্স আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। সুতরাং মবকে গুরুতর অপরাধ চিহ্নিত করে জামিন অযোগ্য হিসাবে গণ্য করতে হবে। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যেসব নেতকর্মী মব ভায়োলেন্সে অংশ নিচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, ‘অভিযোগের প্রমাণ ছাড়াই এভাবে সুরাহা করার প্রবণতা জাতীয় ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। গত সরকারের আমলেও এ ধরনের প্রচুর অপরাধ হয়েছে। চারদিকে অভিযোগের বন্যা। এই অভিযোগ বন্যার প্রতিফলন হলো মব ভায়োলেন্স। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে সঙ্গে সঙ্গে এর একটা সুরাহা করার জন্য লোকজন মাঠে নেমে যায় এবং ভুলে যায় যে তারা এই অভিযোগের নিষ্পত্তি করতে গিয়ে নিজেরাই অপরাধী হয়ে উঠছেন এবং অপরাধমূলক কাজ করছেন।

তিনি বলেন, ‘চারদিকে যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে বা হয়েছে-এই বিশৃঙ্খলাগুলো এতদিন সরকার প্রতিরোধ করতে পারেনি। এটা তারই প্রতিফলন। এজন্য রাতারাতি এখান থেকে উন্নতি সম্ভব না।

মব ভায়োলেন্স বন্ধে করণীয় জানতে চাইলে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা যুগান্তরকে বলেন, ‘কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। যারা মব করছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে ধরতে হবে এবং বিচারের আওতায় আনতে হবে। কঠোর পদক্ষেপ না নিলে এগুলো হতেই থাকবে। শুধু কথা বললে হবে না, অ্যাকশন তো কিছুই দেখা যাচ্ছে না।’

এ বিষয়ে সম্প্রতি আসক-এর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তা নিষ্পত্তির একমাত্র পথ সংবিধান ও আইনি প্রক্রিয়া। বিচারব্যবস্থার বাইরে গিয়ে যে কোনো অপমানজনক ও সহিংস আচরণ শুধু ব্যক্তির অধিকারই লঙ্ঘন করে না, তা একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) এক বিবৃতিতে বলেছে, কোনো ব্যক্তি অপরাধ করলে প্রচলিত আইনে তার বিচার করতে হবে। বিচার ছাড়া মব বা জনতার হাতে আইন তুলে নেওয়ার ঘটনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর দৃষ্টান্ত। এ ধরনের আচরণ দেশের আইনি কাঠামো, মানবিক মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচারব্যবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক যুগান্তরকে বলেন, মব সৃষ্টির পেছনে যারা ইন্ধন দেন, যারা সামনে থাকেন বা নেতৃত্ব দেন, তাদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজন হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাদী হয়ে মামলা করে গ্রেফতার করবে এবং জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।

তিনি বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত মবকে গুরুত্বপূর্ণ অপরাধ চিহ্নিত করে জামিন অযোগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য করতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী বা সমর্থক মব ভায়োলেন্সে সম্পৃক্ত হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থার পাশাপাশি ওই দলকে কঠোর এবং দৃষ্টান্তমূলক সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে হবে।

বর্তমানে অনলাইন ও অফলাইনে মবের পক্ষে কেউ কেউ সাফাই গাইছেন উল্লেখ করে ড. তৌহিদুল হক বলেন, দেশের বাইরে থেকে মবের পক্ষে যারা ইন্ধন দেবেন, তাদের সতর্ক করা এবং ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমগুলোর দেশে প্রচার হওয়া বন্ধ করতে হবে। আর যারা দেশ থেকে প্রচার করেন, তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে। এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করলে দ্রুত সময়ের মধ্যে স্বস্তি মিলবে বলে মনে করেন এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ।

উল্লেখ্য, রোববার রাজধানীর উত্তরায় মব ভায়োলেন্সের সর্বশেষ শিকার হন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, পুলিশের সামনেই নূরুল হুদার গলায় জুতার মালা পরিয়ে মুখে জুতা দিয়ে আঘাত করা হচ্ছে।

সচেতন মহলের অনেকে মনে করেন, একজন সিনিয়র সিটিজেনকে এভাবে নাজেহাল করা গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে করার জন্য তার বিরুদ্ধে যে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, সে বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়ায় বিচার হওয়া জরুরি। কিন্তু সভ্যসমাজে এভাবে ভব সন্ত্রাসকে সমর্থন বা প্রশ্রয় দেওয়ার সুযোগ নেই।

২০ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগ এনে একদল লোক লালমনিরহাট শহরের একটি সেলুন থেকে পরেশ চন্দ্র শীল (৬৯) ও তার ছেলে বিষ্ণু চন্দ্র শীলকে (৩৫) মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এ ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।

এর আগে গত মার্চে মবের শিকার হন দুই বিদেশি নাগরিক। বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের (ডলার বদলে টাকা নেওয়ার) সময় ভুল বোঝাবুঝির জেরে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ইরানের দুই নাগরিককে মারধর করা হয়। ওই সময় তাদের ছিনতাইকারী আখ্যা দিয়ে ‘মব’ সৃষ্টি করা হয়। মারধরের একপর্যায়ে তাদের উদ্ধার করতে গিয়ে পুলিশও আহত হয়।

প্রায়ই দেশের কোথাও না কোথাও এমন মব ভায়োলেন্স সংঘটিত হচ্ছে। মবের বিষয়ে মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভা শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘মব ভায়োলেন্স পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি, তবে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।’

এদিকে আদালত প্রাঙ্গণে মব ভায়োলেন্স ঠেকানোর বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী যুগান্তরকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও অ্যালার্ট থাকতে হবে। আসামি ওঠানো ও নামানোর সময় এলাকা সিলগালা করে দিতে হবে, যাতে বাইরের কেউ এখানে প্রবেশ করতে না পারে। আদালতের ভেতরে একমাত্র বিচারপ্রার্থী ও দুই পক্ষের আনজীবী ছাড়া যেন কেউ থাকতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি বলেন, আসামিপক্ষের আইনজীবীরা অনেক সময় ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দেন। এতে অন্য আইনজীবীরা ক্ষুব্ধ হন। এছাড়া আসামিরাও কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এমন বক্তব্য দেন যাতে অডিয়েন্স খেপে যায়। এজন্য আদালতের উচিত আসামিরা কিছু বলতে চাইলে সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম