Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক

রাষ্ট্রীয় মূলনীতি নিয়ে ঐকমত্য তৈরি হয়নি

প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ১০ বছরে একমত বিএনপি

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রাষ্ট্রীয় মূলনীতি নিয়ে ঐকমত্য তৈরি হয়নি

ছবি: সংগৃহীত

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি নিয়ে ঐকমত্য তৈরি হয়নি। জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের (এনসিসি) প্রস্তাব থেকে সরে এসেছে ঐকমত্য কমিশন। এর পরিবর্তে নতুন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সেটি হলো-‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি’।

বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ঐকমত্য কমিশনের ষষ্ঠ দিনের দ্বিতীয় দফার বৈঠক শেষে তিনি এসব কথা জানান। এ সময় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ১০ বছরে একমত বিএনপি। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি জীবনে সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন। বৈঠক নিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা’ ও ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজনের দাবি জানানো হয়। বৈঠকে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। রোববার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের পরবর্তী আলোচনার দিন ধার্য করা হয়েছে। অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘কমিশন জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের (এনসিসি) প্রস্তাব পরিবর্তন করেছে। এর পরিবর্তে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।’ এনসিসির কাঠামোগত পরিবর্তন আনা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এতে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, দুই কক্ষের স্পিকার, রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান বিচারপতির প্রতিনিধি সদস্য থাকবেন। এ বিষয় অধিকাংশ দল স্বাগত জানিয়েছে। কিছু দল আপত্তি জানিয়েছে। আর কিছু পরামর্শও এসেছে। এ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব আগামী সপ্তাহে করা হবে।’ সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি নিয়ে সিদ্ধান্তে না এলে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নিয়ে সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, সবার মনে রাখতে হবে, আমরা রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। ১৬ বছরের দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের পর নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। সবাই মিলে লড়াই করতে না পারার কোনো বিষয় নেই। এখানে আমরা যেভাবে পরমতসহিষ্ণুতা বজায় রেখে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছি, সব ক্ষেত্রেই সবাইকে সেভাবে অগ্রসর হতে হবে।

অধ্যাপক আলী রীয়াজ আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে এনসিসি প্রস্তাব থেকে কমিশন সরে এসেছে। নতুন প্রস্তাবিত কমিটির কাঠামোতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। এনসিসির পরিবর্তে ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি’ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ কমিটি শুধু সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করবে। অ্যাটর্নি জেনারেল ও তিন বাহিনীর প্রধানের নিয়োগ এ কমিটির অন্তর্ভুক্ত হবে না।

কমিশনের সহসভাপতি জানান, আজকের আলোচনায় রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার বিদ্যমান মূলনীতি অটুট রাখার বিষয়ে কয়েকটি দল মত দিয়েছে। আবার কিছু দল ভিন্নমতও পোষণ করেছে। তাই এ বিষয়ে কোনো ঐকমত্য হয়নি। তবে সাম্য ও মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি এবং পক্ষপাতিত্বহীনতা-এ পাঁচ বিষয়ে অধিকাংশ দলের সমর্থন রয়েছে। তার মতে, যেহেতু সংবিধান এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে এখনো উপনীত হওয়া যায়নি, তাই প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাচ্ছে না।

আলোচনার শুরুতে রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশে সূচনা বক্তব্যে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছি। আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করছি। এ অব্যাহত আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংশোধন-সংযোজনের মধ্য দিয়ে আমরা অভীষ্ট লক্ষ্যে অর্থাৎ একটি জাতীয় সনদে পৌঁছাতে পারব। রাজনৈতিক দলগুলোকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আলোচনায় ক্ষেত্রবিশেষে মতপার্থক্য থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা কমিশনের বৈঠক ছাড়াও আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে পরস্পরের মধ্যে মতবিনিময় করছেন। এটি একটি ইতিবাচক দিক।

এদিকে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ হবে ১০ বছর-এ সিদ্ধান্তে একমত হয়েছে বিএনপি। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি টানা ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। সংবিধানে এমন বিধান যুক্ত করা হবে। বুধবার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ জীবদ্দশায় ১০ বছরের বেশি হবে না, এ বিষয়ে একমত। তবে এনসিসির মতো কোনো কমিটি দিয়ে যদি নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা কার্টেল করা হয়, তাহলে আমরা প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নিয়ে একমত থাকতে পারব না।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের কথা হলো কেন সংবিধানের এই একটা বডি যুক্ত করতে চাচ্ছে। রাষ্ট্রে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য যেসব আইন আছে, সেগুলো সংস্কার করে সার্চ কমিটি করা হোক, সেসব প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির জন্য বিধানগুলো সংযুক্ত করা হোক। আইন না থাকলে আইন করা, আইন থাকলে শক্তিশালী করা হোক।’ সালাহউদ্দিন বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন যদি স্বাধীন নির্বাচন করে এবং জুডিশিয়ারি যদি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে, তাহলেই গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে। এগুলো না করে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা কার্টেল করতে হবে-এ ধারণা থেকে বের হতে হবে। এজন্য নির্বাহী বিভাগকে দুর্বল করার মানে হয় না। এজন্য আমরা এখানে একমত হতে পারিনি। সালাহউদ্দিন বলেন, ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি নিয়ে কমিশনের প্রস্তাব এবং ৫ম সংশোধনীতে গৃহীত আর্টিকেলগুলো সংযুক্ত করব। যেহেতু এ বিষয়ে কোনো ঐকমত্য হয়নি, তাই পেন্ডিং রয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশন গঠনের আইন পূর্ণাঙ্গ নয়, তবে সেটাকে আমরা শক্তিশালী করতে পারি। তাদের ট্রান্সপারেন্সি বাড়ানোর জন্য বিধান যুক্ত করা যেতে পারে। সার্চ কমিটি যেটা সুপারিশ করে, সেটাই যদি ট্রান্সপারেন্ট হয়, তাহলে তো সমস্যা হয় না।’

বৈঠক নিয়ে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসাবে সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা’ ও ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিমের’ সংযোজন করতে হবে। তার দাবি, সিপিবি ও দু-একটি বাম দল ছাড়া বেশির ভাগ দলই এ প্রস্তাবের সঙ্গে একমত। ডা. তাহের জানান, সাংবিধানিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়োগে প্রস্তাবিত এনসিসির বদলে সাংবিধানিক বিধিবদ্ধ পদে নিয়োগ কমিটির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে বিভিন্ন সাংবিধানিক পদ যেমন: নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, পিএসসি ও মহাহিসাবরক্ষক পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। যেখানে আগের মতো প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতায় নিয়োগ দেওয়া হবে না। জামায়াতের এই নেতা বলেন, ‘এজন্য একটি কমিটি হবে। অনেকে বলেছেন, এতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমবে। আমরা মনে করি, এটা ঠিক নয়, বরং এতে ক্ষমতার ভারসাম্য আসবে।’ তিনি বলেন, ‘এই কমিটিতে প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা, দুই কক্ষের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার ও সব বিরোধী দলের প্রতিনিধি এবং রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতির প্রতিনিধি থাকবেন।’ বিগত দিনে প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতার কারণেই এত নৈরাজ্য হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সচিবালয়ে এখনো ফ্যাসিস্টের দোসর রয়েছে। তাই এ ব্যবস্থার বিলোপ প্রয়োজন।’

বৈঠকে অংশ নেওয়া গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, রাষ্ট্রের মূলনীতি নিয়ে এখনো ঐকমত্য হয়নি। তবে সংবিধানের মূলনীতিতে কী কী অবশ্যই উল্লেখ থাকতে হবে, সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সুবিচার, গণতন্ত্র এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা, সম্প্রীতি ও পক্ষপাতহীনতা-এই পাঁচ বিষয়কে সমর্থন করেছেন তারা।

বিল্পবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘আমরা দলের পক্ষ থেকে বলেছি, রাষ্ট্রের যে মূলনীতি, সেটা দীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রাম আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাওয়া। গণ-আকাঙ্ক্ষার সাংবিধানিক প্রতিফলন হিসাবে সেটা সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছে।’ তিনি জানান, তারা মনে করেন, মূলনীতি অব্যাহত থাকা দরকার। সংশোধিত এনসিসির প্রস্তাবের বিষয়ে আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি) সভাপতি মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, সাংবিধানিক পদের নিয়োগগুলো প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার উভয় পক্ষের সবাই মিলে আলোচনা করবেন। সেখানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতির প্রতিনিধি থাকবেন। এর চেয়ে সুন্দর প্রস্তাব আর হতে পারে না।

ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বুধবারের আলোচনায় ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণ-অধিকার পরিষদ, গণসংহতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম