মোবাইল ফোন ট্র্যাক করেই শনাক্ত
‘আমি-ডামি’ ভোটের কারিগর হাবিবুল আউয়াল গ্রেফতার
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কাজী হাবিবুল আউয়াল
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
অবশেষে মোবাইল নম্বর ট্র্যাক করেই ‘আমি-ডামি’ ভোটের হোতা সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের অবস্থান নিশ্চিত করা হয়। বুধবার দুপুর ২টার দিকে রাজধানীর মগবাজার এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ডিএমপি ডিবির যুগ্মকমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। রোববার রাতে মোবাইল ফোন বাসায় রেখে আত্মগোপনে গিয়ে তিনি গোয়েন্দাদের বিভ্রান্ত করেছেন। এরপর কমপক্ষে আরও দুবার তিনি গোয়েন্দা জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে যান। গ্রেফতার এড়াতে বারবার অবস্থান পরিবর্তন করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। বুধবার সকালে তার হাতে থাকা মোবাইলটি একবার অন করেই গোয়েন্দা জালে ধরা পড়েন। এরপর সে অনুযায়ী অভিযান চালিয়ে তাকে ধরে ডিবি কার্যালয়ে আনা হয়। রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় বিএনপির পক্ষ থেকে করা একটি মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংসের সঙ্গে জড়িত তিন সিইসিসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে বিএনপি। এই মামলায় সিইসি কাজী রকিব উদ্দিনও আসামি। তিনজনের মধ্যে এখন কাজী রকিব উদ্দিনই গ্রেফতারের বাইরে আছেন।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় ও একই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচন করে ‘আমি-ডামি’ ভোটের হোতা হিসাবে উপাধি পান সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। এই নির্বাচনে ভোটের হার নিয়েও বড় ধরনের বিতর্ক তৈরি হয়। ঘোষণার সময় সিইসি প্রথমে ২৮ শতাংশ ভোট পড়ার কথা বলেন। পরে তা সংশোধন করে ৪০ শতাংশ ভোট পড়ার ঘোষণা দেন। এভাবেই বিতর্ক তৈরি করেন তিনি। এদিকে হাবিবুল আউয়ালকে গ্রেফতার করতে গিয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। রোববার রাত থেকে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালান গোয়েন্দারা। এতে তারা একাধিকবার ব্যর্থ হন।
বিএনপি মামলা দায়েরের পর রোববার রাতে উত্তরায় জনতার হাতে আটক হন ২০১৮ সালের প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদা। পরে তাকে পুলিশ গ্রেফতার করে। নূরুল হুদা গ্রেফতারের খবর সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে হাবিবুল আউয়াল নিজ বাসভবন থেকে বেরিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। এদিকে সেই রাতেই পুলিশের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয় হাবিবুল আউয়ালকেও গ্রেফতার করা হবে। এরপরই গোয়েন্দা বাহিনী সাবেক সিইসির সন্ধানে বিভিন্ন স্থানে তল্লাশি চালায়। একপর্যায়ে তার মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসায় তার অবস্থান শনাক্ত হয়। রাতেই বাসাটি গোয়েন্দা পুলিশ ঘিরে ফেলে। সেখান থেকে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়-‘স্যার আমি-ডামি ভোটের হোতা হাবিবুল আউয়াল কট, তাকে পাওয়া গেছে।’ নির্দেশ দেওয়া হয় গ্রেফতারের। এরপর গোয়েন্দা সদস্যরা তার বাসায় প্রবেশ করেন। সেখানে তল্লাশি চালিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। বাসার অন্য সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তারা জানান তিনি বেরিয়ে গেছেন। তবে মোবাইল ফোনটি রেখে গেছেন। গোয়েন্দারা মোবাইল ট্র্যাক করার পর নিশ্চিত হয়েছিলেন তিনি বাসাতেই আছেন। সে কারণেই অভিযান চালানো হয়। কিন্তু সাবেক সিইসি চাতুর্যের সঙ্গে ফোন বাসায় রেখে আত্মগোপনে গিয়ে পুলিশকে বিভ্রান্ত করতে পারেন তা বুঝতে পারেননি গোয়েন্দা সদস্যরা। ফলে সে রাতের অভিযান ব্যর্থ হয়। এরপর থেকে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়। সম্ভাব্য স্থানগুলো থেকে তার অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। একপর্যায়ে তথ্য মেলে হাবিবুল আউয়াল মগবাজার এলাকার একটি বাসায় আছেন। পরে সেখান থেকেই তাকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে রোববার রাতে তাকে গ্রেফতারের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ সদর দপ্তরের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, তাকে গ্রেফতার করে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়েছে। যদিও ডিবির পক্ষ থেকে ওইদিন বিষয়টি অস্বীকার করা হয়।
বুধবার গ্রেফতারের পর ডিএমপি ডিবির যুগ্মকমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, বেশ কয়েক দিন ধরেই আমরা তাকে খুঁজছিলাম। রোববার রাতে আমরা দুটি বাসায় অভিযান চালিয়েছিলাম। কিন্তু আমরা পৌঁছার আগেই তিনি বাসা থেকে বের হয়ে যান। এরপর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়েছি। গ্রেফতার এড়াতে তিনি বারবার নিজের অবস্থান পরবির্তন করেন। শেষ পর্যন্ত আমরা তাকে আইনের আওতায় এনেছি।
তিনি বলেন, মগবাজারের যেখান থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে সেটি মূলত তার বাসা নয়। আমাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল তিনি মগবাজারে আত্মগোপনে রয়েছেন। সেখানে নজরদারির মধ্যেই আজ (বুধবার) তাকে ডিবি পুলিশের একটি দল গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের আগে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। মগবাজারে কার বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মোবাইল নম্বরের ভিত্তিতেই আমরা তার অবস্থান শনাক্ত করে গ্রেফতার করেছি। তার মোবাইল বন্ধ অবস্থা থেকে একবার ওপেন করা হলে আমরা তার অবস্থান শনাক্ত করতে সক্ষম হই। তবে, বাসাটি কার সেটি বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
নাসিরুল ইসলাম বলেন, ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তিনি (কাজী হাবিবুল আউয়াল) প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ছিলেন। তার বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়েছে। মামলায় বলা হয়েছে, ২৪ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ না করা সত্ত্বেও নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করতে না পারা, শুধু আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থিত ডামি ক্যান্ডিডেট এবং জাতীয় পার্টিকে দিয়ে নির্বাচন করানো হয়। এমনকি নির্বাচনের দিনে ভোটের পরিসংখ্যান নিয়ে দ্বিচারিতার আশ্রয় নেওয়া হয়। এসব অভিযোগে দায়ের করা মামলায় তিনি আসামি।
বিএনপির পক্ষ থেকে রাজধানী শেরেবাংলা নগর থানায় দায়ের করা মামলায় ২৪ জন আসামি। সেই মামলায় সেই নির্বাচনের সময়কার সিইসি কাজী রকিব উদ্দিন একই মামলার আসামি। তাকে গ্রেফতার করা হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এই মামলার এজাহারভুক্ত সব আসামিকে গ্রেফতারে গোয়েন্দা নজরদারি ও কার্যক্রম অব্যাহত আছে। আমরা সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত পেলে গ্রেফতার করব।
আওয়ামী লীগ আমলে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ কমিশন সদস্যদের আসামি করে রোববার রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করে বিএনপি। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মো. সালাহউদ্দিন খান বাদী হয়ে করা এই মামলায় মোট ২৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে আছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক চার আইজি, নূরুল হুদা এবং হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন ছাড়াও কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ ও তার নেতৃত্বাধীন কমিশন সদস্যদেরও মামলায় আসামি করা হয়েছে। এই মামলায় গ্রেফতার কেএম নূরুল হুদা ডিবি হেফাজতে রিমান্ডে আছেন। তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে তিনি অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন বলে ডিবি সূত্র জানিয়েছে।
