Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক

দ্বিকক্ষ সংসদে নীতিগত মত অধিকাংশ দলের

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ৩০ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেছেন, দ্বিকক্ষ সংসদ নিয়ে অধিকাংশ দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। কিছু কিছু দল সামান্য কারণে আপত্তি জানিয়েছে। রোববার বিকালে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় অধিবেশন শেষে তিনি এসব কথা বলেন।

আলী রীয়াজ বলেন, নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রাপ্ত ভোটের মাধ্যমে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট করার জন্য অধিকাংশ দল মতামত দিয়েছে। কিছু কিছু দল এই বিষয়ে সুস্পষ্ট আপত্তি জানিয়েছে। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল যেহেতু দ্বিকক্ষ পার্লামেন্ট গঠনে আগ্রহী, সেক্ষেত্রে ভোট গ্রহণের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে একমত হতে পারব। এ বিষয়ে যেসব দলের আপত্তি আছে তারা জানিয়েছে ফের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবে।

তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশন থেকে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছিল। এরপর অনেক রাজনৈতিক দল প্রস্তাবটি সমর্থন করছে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কমিটি নামে নতুন কমিটি করার প্রস্তাব করেছিলাম। সেখানে এনসিসির যেসব দায়দায়িত্ব ছিল, তা সীমিত করে কাঠামোগত দিক পরিবর্তন করা হয়। যেসব রাজনৈতিক দল কমিটিকে স্বাগত জানিয়েছিল তারা এর বিস্তারিত জানতে চেয়েছিল। আমরা তার পরিপ্রেক্ষিতে আজকে নতুন কাঠামোগত দিকের প্রস্তাব তুলে ধরেছি।

আমরা বলেছি, এই নিয়োগ কমিটি সুনির্দিষ্টভাবে ৬টি কমিশনের প্রধান ও সদস্য নিয়োগ করবে। এগুলো হচ্ছে নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, সরকারি কর্মকমিশন, মহাহিসাব নিরক্ষক ও নিয়ন্ত্রতক, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং তথ্য কমিশন। এছাড়া আইনের দ্বারা এর বাইরের (৬ কমিশন) অন্য প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠানটি কাজ করবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন মনে করে এই কমিশনগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো একটি জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি বলেন, এনসিসিতে আমাদের প্রস্তাব ছিল-রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতির অন্তর্ভুক্তি। সেটা অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। সেজন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সেখান থেকে সরে এসেছে।

কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে বোঝা যায়, এ ধরনের একটি কাঠামোর ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সমর্থন আছে। তিনি বলেন, কাঠামোগত ক্ষেত্রে আরেকটু আলোচনা ও সুস্পষ্ট হওয়া দরকার। যেসব দল এখনো এই প্রস্তাবে সম্মত হয়নি আমরা কমিশনের পক্ষ থেকে তাদের অনুরোধ করেছি-পুনর্বিবেচনা করার সুযোগ আছে কিনা। আশা করছি যেসব দল এখন পর্যন্ত একমত হতে পারছে না তারা এগুলো পুনর্বিবেচনা করবে।

দেশের স্বার্থে সংস্কার আলোচনার অগ্রগতি প্রয়োজন বলে উল্লেখ করে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি কমিশনের সহসভাপতি বলেন, আমরা কেউ আগের অবস্থায় ফিরে যেতে চাই না। তাই দেশের স্বার্থে আপনারা বিষয়টি বিবেচনা করুন। যে অঙ্গীকার নিয়ে আমরা গত জুলাইয়ে ঐক্যবদ্ধ ছিলাম, তার কতটা অর্জিত হয়েছে? আমরা কি শুধু নিজের ও দলের স্বার্থ চাইব, নাকি দেশের স্বার্থও দেখব? আমরা আশাকরি বেশির ভাগ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে একমতে নিয়ে আসতে পারব। কমিশন থেকে আগামী ২ জুলাই পরবর্তী আলোচনার দিন ধার্য করা হয়েছে।

সব বিষয়ে ঐকমত্যে বাধ্য করা ঠিক হবে না-সালাহউদ্দিন আহমদ : সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি গঠন এবং সংসদের উচ্চকক্ষের সদস্য নির্বাচনের প্রক্রিয়ার প্রস্তাবে বিএনপি ঐকমত্যে পৌঁছায়নি বলে জানিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেছেন, সব বিষয়ে ঐকমত্যে বাধ্য করা ঠিক হবে না। রোববার সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা শেষে তিনি এ কথা বলেন।

সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, জুলাই সনদ নিয়ে এ পর্যন্ত বিএনপিই সবচেয়ে বেশি আন্তরিকতা দেখিয়েছে। সংবিধানের মূলনীতি, ৭০ অনুচ্ছেদ, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর সময়সীমা ও সংসদের স্থায়ী কমিটি নিয়ে বিএনপি ঐকমত্যে পৌঁছেছে। এখন কমিশনের সব প্রস্তাবে একমত হতে হলে তো আর আলোচনার দরকার নেই। তিনি বলেন, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে, সেগুলো নিয়েই জুলাই সনদ হবে।

তিনি বলেন, তারা সংসদ দ্বিকক্ষ করা, উচ্চকক্ষে ১০০ আসন করা, উভয় কক্ষে ডেপুটি স্পিকার বিরোধী দল থেকে করা-এসব প্রস্তাবে একমত। তবে উচ্চকক্ষের নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে তাদের দ্বিমত আছে। তারা নিম্নকক্ষের আসনের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষের আসন চান। তবে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এ বিষয়ে যদি আরও সুন্দর প্রস্তাব আসে, গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব আসে দেশের স্বার্থে জনগণের সঙ্গে আমরা সেটা বিবেচনা করব। কিন্তু সে রকম কোনো প্রস্তাব এখনো পর্যন্ত উঠে আসেনি।

ঐকমত্যের পথে অগ্রগতি হলেও আপত্তি রয়েছে বিএনপির-জামায়াত : জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থাগুলোতে নিয়োগের জন্য একটি স্থায়ী কমিটি গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তবে প্রস্তাবিত ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থার নিয়োগ কমিটি’ (পূর্বে ন্যাশনাল কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল নামে পরিচিত) গঠনে এখনো বিএনপির আপত্তি রয়েছে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় পর্যায়ের সংলাপের সপ্তম দিনের প্রথম পর্ব শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি। ডা. তাহের বলেন, শতভাগ একমত হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়াটা প্রায় অসম্ভব। আমরা চেষ্টা করছি কীভাবে এই জটিলতা কমানো যায়। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে জানিয়ে ডা. তাহের বলেন, আমরা ইন প্রিন্সিপাল বাই ক্যামেরাল পার্লামেন্টের ব্যাপারে একমত আছি। তিনি বলেন, উচ্চকক্ষের সদস্যরা শুধু এমপিদের ভোটে নির্বাচিত না হয়ে জনগণের ভোটের প্রতিফলন থাকতে হবে।

রোববার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে দ্বিতীয় ধাপের সপ্তম দিনের আলোচনা শুরু হয়। প্রথমে সংবিধান ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটির প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। যা চলে দুপুর ১টা ২০ মিনিট পর্যন্ত। এরপর দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ও নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। যাতে বিএনপি এবং তাদের সমমনা এনডিএম, লেবার পার্টি, ১২ দলীয় জোট এবং জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ছাড়া অধিকাংশ দলই নীতিগতভাবে একমত ছিল। উচ্চকক্ষের বিষয়ে আপত্তি ছিল সিপিবি, বাসদ এবং আমজনতা পার্টি।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবে সংসদের মেয়াদ থাকলেও বিশেষ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংবিধান ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি বলবৎ রাখার প্রস্তাবের আপত্তি তোলেন এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাভেদ রাসিন। তিনি বলেন, কমিটি ২ জনের নাম প্রস্তাব করবে রাষ্ট্রপতি একজনকে নিয়োগ দেবেন এটাতেও তাদের আপত্তি আছে।

প্রস্তাবটির বিষয়ে আপত্তি তুলে বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ২-৩টা অধিবেশনে একই বিষয়ে অনেকবার বক্তব্য দিয়েছেন। যদি একই বিষয়ে তিন দিন আলোচনা করেন তাহলে আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ঐকমত্য প্রক্রিয়া কী। তিনি বলেন, নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব খর্ব হয় এমন বিধান সিংবিধানে যোগ করা ঠিক হবে না। তিনি বলেন, কীভাবে ঐকমত্য হবে সে প্রক্রিয়া আগে নির্ধারণ করেন। যেগুলোর বিষয়ে ঐকমত্য হবে সেগুলো নিয়ে সনদ করি, যেগুলো হবে না সেগুলো বাদ রাখি। প্রধান উপদেষ্টাও সেটাই বলেছেন।

জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, কোনো দলকে ইঙ্গিত করে এমন কমিটি করা ঠিক হবে না। কারণ এ দেশে একমাত্র ফ্যাসিবাদী দল হচ্ছে আওয়ামী লীগ। অন্যরা ক্ষমতায় থাকার সময় ফ্যাসিবাদী আচরণ করেনি। ১২ দলীয় জোটের আহ্বায়ক সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, নির্বাহী বিভাগের হাত-পা বেঁধে সমুদ্রে ফেলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত হবে না।

জামায়াত ঐকমত্য কমিশনের এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত জানিয়ে নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আজকের আলোচনা পুরোনো, এগুলো নিয়ে আগেও আলোচনা হয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এমন প্রসঙ্গে সবাই মিলে ঐকমত্যে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব। বিএনপি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে।

আলী রীয়াজ তখন অনুরোধ করেন যারা বিরোধিতা করছে তারা যেন দলে আবার আলোচনা করে দেখে। আলী রীয়াজের বক্তব্যের পরে প্রস্তাবটির বিরোধিতা করেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের পক্ষ থেকে। যদিও আগে দলটি একমত ছিল।

দুপুর ১টা ২০ মিনিটের পর দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ নিয়ে আলোচনা করা হয়। দ্বিকক্ষের বিরোধিতা করে সিপিবি ও বাসদ। এর বাইরে অধিকাংশ দল প্রস্তাবটির পক্ষে একমত প্রকাশ করে। ১০০ সদস্যের উচ্চকক্ষের বিষয়েও দলগুলোর একমত দেখা যায়। তবে জেএসডি ও বাংলাদেশ জাসদ ২০০ কক্ষের উচ্চকক্ষের দাবি করে। প্রস্তাবে অংশ নেওয়া অধিকাংশ দল সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের নির্বাচনের প্রস্তাব করে। এখানেও দ্বিমত প্রকাশ করে বিএনপি, তাদের সমমনা এনডিএম, লেবার পার্টি, ১২ দলীয় জোট এবং জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট।

এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাভেদ রাসিন বলেন, সকাল ১১টা থেকে ৩ ঘণ্টা আলোচনা করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের কাছে এসে আলোচনা আটকে যায়। বিকালেও ৩টা থেকে প্রায় ৫টা পর্যন্ত আলোচনা করে একটা জায়গায় এসে আটকে যায়। তিনি বলেন, আমি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে প্রস্তাব রাখতে চাই, আপনারা প্লিজ আগে প্রস্তাবগুলো সালাহউদ্দিন ভাই বা বিএনপির কাছে দিন। ওনারা কোনটাতে কোনটাতে একমত সেটা হাউজে (আলোচনায়) আনেন। আমরা সেটা নিয়ে আলোচনা করি। না হলে এভাবে আলোচনা করার কোনো দরকার নেই।

এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ঐকমত্যের প্রচেষ্টা কতটা সফল হবে তা নিয়ে শঙ্কা আছে। মৌলিক সংস্কারের জায়গায় বিএনপি ও তার সঙ্গে কয়েকটা দল ভিন্নমত পোষণ করছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনার পরও অমীমাংসিত থেকে যাচ্ছে।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, যদি নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষ গঠন করা হয় তাহলে এটি নিম্নকক্ষের রেপ্লিকা হবে। এ মুহূর্তে নিম্নকক্ষে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি বলছি না। তবে উচ্চকক্ষে এটা লাগবে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম