Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিলেন ট্রাইব্যুনাল

আবু সাঈদ হত্যার নির্দেশদাতা হাসিনা

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ: বেরোবির সাবেক উপাচার্যসহ ২৬ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা, পরবর্তী শুনানি ১০ জুলাই * হত্যাকাণ্ড ভিন্নখাতে নিতে সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পরিবর্তনে বাধ্য করেন আসামিরা * শেখ হাসিনার নির্দেশে লেথাল উইপন (মারাত্মক মারণাস্ত্র) ব্যবহার করা হয়েছে-চিফ প্রসকিউটর * সাক্ষী করা হয়েছে ৪৬ জনকে * জমা দেওয়া হয় ভিডিও, অডিও, পত্রিকা, বই, বিভিন্ন প্রতিবেদন

আলমগীর মিয়া

আলমগীর মিয়া

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আবু সাঈদ হত্যার নির্দেশদাতা হাসিনা

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। এ হত্যাকাণ্ডের প্রধান নির্দেশদাতা ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আর মামলার এজহারভুক্ত প্রধান আসামি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. হাসিবুর রশীদ বাচ্চুসহ চারজন ঊর্ধ্বতন অবস্থানে থেকে যৌথভাবে আবু সাঈদকে হত্যার নির্দেশনা দেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এএসআই আমীর হোসেন, কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায় ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্য সদস্যদের মাধ্যমে গুলি চালিয়ে আবু সাঈদকে হত্যা করা হয়।

এ সময় কমপক্ষে চারজন আন্দোলনকারী আহত হন। এছাড়া অন্য ২৬ আসামি তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে এ হত্যাকাণ্ড, আক্রমণ ও নির্যাতনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও সহায়তা করেন। হত্যাকাণ্ড ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পরিবর্তনে বাধ্য করেন আসামিরা।

আবু সাঈদ হত্যা মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগে (ফরমাল চার্জ সংক্রান্ত প্রতিবেদন) উঠে এসেছে এসব তথ্য। সোমবার অভিযোগটি ট্রাইব্যুনাল-২-এ দাখিল করা হয়। শুনানি শেষে সেটি আমলে আনেন আদালত। এছাড়া বেরোবির সাবেক উপাচার্যসহ পলাতক ২৬ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে লেথাল উইপন (মারাত্মক মারণাস্ত্র) ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমে শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দিয়েছেন পুলিশের আইজিপিকে, আইজিপির মাধ্যমে পুলিশের সব কমান্ডিং-অধস্তন যত কমান্ড আছে, তাদের কাছে গেছে। সেখানে বলা হয়েছে প্রাণঘাতী অস্ত্র বা লেথাল উইপন ব্যবহার করে ছাত্রদের হত্যা করার জন্য। সেই নির্দেশের ধারাবাহিকতায় আবু সাঈদকে হত্যা করা হয়েছে।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের আবু সাঈদ ১৬ জুলাই হাতে একটি মাত্র লাঠি নিয়ে আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। সেদিন সাঈদকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়কে গুলি করার ভিডিও সংবাদমাধ্যমে প্রচার হলে ছাত্র-জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

সেদিন থেকেই সারা দেশে তীব্র গতিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। পরদিন থেকে সারা দেশে ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করা হয়। এর ধারাবাহিকতার পরিণতিতে ৫ আগস্ট স্বৈরাচার সরকারের পতন হয়। পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সোমবার সকালে ট্রাইব্যুনাল-২-এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়। আনুষ্ঠানিক অভিযোগে ৩০ জনকে আসামি করা হয়। এতে সাক্ষী করা হয়েছে ৪৬ জনকে। সঙ্গে জব্দতালিকা, ভিডিও, অডিও, পত্রিকা, বই, প্রতিবেদন ও সিসিটিভি ফুটেজ জমা দেওয়া হয়। শুনানি শেষে আবু সাঈদ হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। মামলার ৩০ আসামির মধ্যে পলাতক ২৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত।

তাদের মধ্যে আছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মো. হাসিবুর রশীদ বাচ্চু। গোপনীয়তার স্বার্থে অন্য আসামিদের নাম প্রকাশ করেনি প্রসিকিউশন। ১০ জুলাই পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়। এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ২৪ জুন চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে জমা দিয়েছিল ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।

বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২ এই আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. মঞ্জুরুল বাছিদ ও বিচারপতি নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর। আদালতে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, গাজী মোনাওয়ার হুসাইন, বিএম সুলতান মাহমুদ ও এসএম মঈনুল করিম। আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী রাশেদুল হক খোকন ও দেলোয়ার হোসেন সোহেল।

৩০ আসামির মধ্যে চারজন গ্রেফতার আছেন। তারা হলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, পুলিশের সাবেক সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আমির হোসেন, সাবেক কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায় ও নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ নেতা ইমরান চৌধুরী ওরফে আকাশ। তাদের পরবর্তী শুনানির তারিখে ট্রাইব্যুনাল-২-এ হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আসামিরা ঊর্ধ্বতন অবস্থানে থেকে যৌথভাবে নির্দেশনা দেন : শুনানিতে আসামিদের ভূমিকা তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। শুনানিতে তিনি বলেন, আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. হাসিবুর রশীদ বাচ্চু, রংপুর মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান, রংপুর মহানগর পুলিশের সাবেক উপকমিশনার (অপরাধ) মো. আবু মারুফ হোসেন এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম যৌথ দায় ও ঊর্ধ্বতন অবস্থানে ছিলেন।

তাজুল ইসলাম বলেন, উল্লিখিত চার আসামি ঊর্ধ্বতন অবস্থানে থেকে যৌথভাবে নির্দেশনা দিয়ে তাদের অধীন ও নিয়ন্ত্রণাধীন আসামি এএসআই (সশস্ত্র) মো. আমির হোসেন, কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায় ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্য সদস্যদের মাধ্যমে ঘটনাস্থলে আগ্নেয়াস্ত্রের মাধ্যমে গুলি চালিয়ে নিরস্ত্র আবু সাঈদকে হত্যা করেন। সেই সঙ্গে কমপক্ষে চারজনকে আহত করা হয়।

এছাড়া অন্য আসামিরা তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে এ হত্যাকাণ্ড, আক্রমণ ও নির্যাতনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। সহায়তা করেন। হত্যাকাণ্ডকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পরিবর্তনে বাধ্য করেন বা সুবিধা করে দেন।

পরে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ তদন্ত শেষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছিল। সেই প্রতিবেদন পর্যালোচনাপূর্বক চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয় ফরমাল চার্জ দাখিল করে। আজ সেই ফরমাল চার্জ এবং অন্যান্য ডকুমেন্টের ওপর শুনানি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল ৩০ জন আসামির বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নিয়েছেন।

১০ জুলাই পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেছেন। আসামিদের মধ্যে যে চারজন অন্য মামলায় গ্রেফতার আছেন, তাদের এ মামলায় গ্রেফতার দেখানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। বাকি ২৬ জনকে গ্রেফতার করে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

তাজুল ইসলাম বলেন, সেদিন (১০ জুলাই) বিচারের যে স্বাভাবিক কার্যক্রম, সেটা গৃহীত হবে। যদি সব আসামিকে গ্রেফতার করা না যায়, তাহলে পলাতক আসামিদের ব্যাপারে স্টেট ডিফেন্স ল’ইয়ার নিয়োগ করার জন্য আদালত আদেশ দিতে পারেন এবং তার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক বিচারের যাত্রা শুরু হয়ে যাবে।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, আমরা স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছি, শেখ হাসিনার নির্দেশ লেথাল উইপন ব্যবহার করা হয়েছে, শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন প্রথমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে; স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দিয়েছেন পুলিশের আইজিপিকে, আইজিপির মাধ্যমে পুলিশের সব কমান্ডিং-অধস্তন যত কমান্ড আছে তাদের কাছে গেছে। সেখানে বলা হয়েছে প্রাণঘাতী অস্ত্র বা লেথাল উইপন ব্যবহার করে ছাত্রদের হত্যা করার জন্য। সেই নির্দেশের ধারাবাহিকতায় রংপুরে অপরাধটা সংঘটিত হয়েছে।

তাজুল বলেন, সুতরাং সুপিরিয়র দায় হচ্ছে শেখ হাসিনার, আসাদুজ্জামান খান কামালের, আইজিপির এবং তারপর রংপুরে পুলিশের যারা ঊর্ধ্বতন কর্তা ছিলেন, তাদের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন দায় এখানে পাওয়া গেছে এবং তাদের ব্যাপারে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। পাশাপাশি ‘অক্সিলারি ফোর্স’ হিসাবে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এবং বিশ্ববিদ্যালয়েরে ভিসিসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই ছাত্রদের আন্দোলন দমনের ব্যাপারে পুলিশকে সরাসরি নির্দেশনা দিয়েছেন বলে উঠে এসেছে অভিযোগপত্রে।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, সরকারের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, ওই সময়ের প্রশাসনে যারা ছিলেন তারা, সরাসরি পুলিশকে উসকানি দেন, নির্দেশ দেওয়ার কাজটা করেন। তারা যেহেতু সুপিরিয়র অবস্থানে থেকে এটা করেছেন, সেজন্য সুপরিয়র রেসপনসিবিলিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তি, যারা এ মামলার আসামি, তাদের দায়ী করা হয়েছে। তবে মূল দায়টা হচ্ছে সরকারের। শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে পরবর্তী পুলিশ অফিসারদের।

বিচারে এক দিনও বেশি সময় নিচ্ছি না : জুলাইয়ের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে যতটুকু সময় প্রয়োজন, সেই গতিতেই বিচার এগোচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমরা বিচারের জন্য এক দিনও বেশি সময় নিচ্ছি না। সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি এ কথা বলেন।

তাজুল ইসলাম বলেন, বিচারের জন্য যতটুকু সময় প্রয়োজন, বিচার সেই গতিতে আগাচ্ছে। এটাকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করা এবং পাশাপাশি ন্যায়বিচারের সব স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করা-এ দুটোকে মেইনটেইন করে আমরা চলছি। এতে কতদিন সময় লাগছে, এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই।

তিনি বলেন, বিচারকে ন্যায়বিচারের মাধ্যমে সমাপ্ত করতে হবে। সেজন্য তাড়াহুড়া করে মোবাইল কোর্টের মতো মামলার বিচার শেষ করা এখানে সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, বাকি বিচারপ্রক্রিয়া কতটা দ্রুত এগোবে, এইটা আদালত নির্ধারণ করবেন। আমরা এক দিনও বেশি সময় নিচ্ছি না, নেবও না। যথাসময়ে বিচার শেষ করার জন্য যা করা দরকার, আমরা সেটা করব। বাকিটা নির্ভর করবে আদালতের কার্যধারার ওপর।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম