শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর
দেড় হাজার ছাত্র জনতা হত্যার দায় হাসিনার
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
জুলাই অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আবেদন করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন। অন্য দুই আসামি হচ্ছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। মঙ্গলবার চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম পাঁচটি ঘটনায় অভিযোগ গঠনের পক্ষে শুনানি করেন। তিনি বলেন, ১৪ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় দেড় হাজার মানুষ হত্যা এবং ২৫ হাজারের বেশি মানুষকে গুলি করে আহত করার দায় শেখ হাসিনার। তার নির্দেশ, উসকানি, প্ররোচনায় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ। পরে আসামিদের আইনজীবী সময়ের আবেদন জানালে সোমবার দিন ধার্য করা হয়।
মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ এ আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। এদিন এই ট্রাইব্যুনালে দ্বিতীয় দিনের মতো বিচারকাজ সংবাদমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। এর আগে তদন্ত শেষে ১২ মে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ এনে এ মামলার প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। সেখানে শেখ হাসিনাকে জুলাই-আগস্টের নৃশংসতার ‘মাস্টারমাইন্ড, হুকুমদাতা ও সুপিরিয়র কমান্ডার’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়।
আদালতে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এ সময় তাকে সহায়তা করেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, গাজী মোনাওয়ার হুসাইন, বিএম সুলতান মাহমুদ ও এসএম মঈনুল করিম। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। মামলার আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন কারাগারে আছেন। এদিন তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তার আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন। তবে তিনি মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের শুনানি না করে পরবর্তী তারিখে অংশ নেবেন বলে জানান।
শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের সময় দেশব্যাপী সংঘটিত হত্যাকাণ্ড, গুলি করে আহত করা, লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার মতো অমানবিক কর্মকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রধান মাস্টারমাইন্ড, হুকুমদাতা ও সুপিরিয়র কমান্ডার শেখ হাসিনা। জুলাই ও আগস্টে যত মানুষ শহীদ হয়েছেন, যত মানুষ আহত হয়েছেন, প্রতিটি ঘটনায় তার (শেখ হাসিনা) জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে। তাজুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন কলরেকর্ড, অসংখ্য ভিডিও ফুটেজ, অডিও ক্লিপ, আহতদের শরীর থেকে উদ্ধার হওয়া গুলি, যেসব হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলোর ফ্লাইট শিডিউল (উড্ডয়ন-অবতরণ সূচি), হেলিকপ্টার থেকে ব্যবহার করা অস্ত্র, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে পাওয়া তথ্য সাক্ষ্য-প্রমাণ হিসাবে যুক্ত করেছে তদন্ত সংস্থা। আহতদের সাক্ষ্য, গ্রেফতার হওয়া আসামিদের স্বীকারোক্তি অভিযোগে রয়েছে।
শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর পাঁচটি অভিযোগ তুলে ধরে বলেন, ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান কামাল, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা ও সহায়তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আওয়ামী সন্ত্রাসীরা নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে হামলা চালায়। এর মাধ্যমে হত্যা, হত্যার চেষ্টা, নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক আচরণ করা হয়।
তিনি বলেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি আন্দোলনকারীদের দমনে হেলিকপ্টার, ড্রোন এবং লেথাল উইপন (মারাত্মক মারণাস্ত্র) ব্যবহারের নির্দেশ দেন। আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন এই নির্দেশ বাস্তবায়নে তাদের অধীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেন। এর মাধ্যমে আসামিরা অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ প্রদান, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছেন।
রংপুরে ছাত্র আবু সাঈদ হত্যা নিয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এই হত্যাকাণ্ডে তাদের নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, ষড়যন্ত্র, অন্যান্য অমানবিক আচরণের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন হয়েছে। চানখাঁরপুলে ছাত্র হত্যা নিয়ে তিনি বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঢাকার চানখাঁরপুল এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে ছয় ছাত্র নিহত হন। এই ঘটনায়ও শেখ হাসিনাসহ তিনজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
সর্বশেষ আশুলিয়ায় হত্যা ও লাশ পোড়ানোর ঘটনায় চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আশুলিয়ায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যা, তাদের মধ্যে পাঁচজনের লাশ পুড়িয়ে দেওয়া এবং একই সঙ্গে গুরুতর আহত একজনকে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। এই ঘটনায় তিন আসামি কর্তৃক হত্যার নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, ষড়যন্ত্র, অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।
শুনানি শেষে শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের আইনজীবী আমির হোসেন ট্রাইব্যুনালে বলেন, এটি একটি ঐতিহাসিক মামলা। তিনি এই মামলার নথিপত্র ২৫ জুন পেয়েছেন। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পাননি, তা ছাড়া তিনি অসুস্থ ছিলেন। তাই তার প্রস্তুতির জন্য ১৫ দিন সময় প্রয়োজন। ট্রাইব্যুনাল ৬ দিন সময় মঞ্জুর করে সোমবার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেন। সেদিন আসামিপক্ষ যুক্তি তুলে ধরবে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা ৫ অভিযোগ সঠিক নয় : সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা মামলায় আনা পাঁচটি অভিযোগ সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। মঙ্গলবার দুপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন বিষয়ে শুনানি শেষে আমির হোসেন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে একথা বলেন। মামলায় আসামিদের মধ্যে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান পলাতক। তাদের পক্ষে আমির হোসেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী।
ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের আমির হোসেন বলেন, এই মামলা থেকে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানকে খালাস করার জন্য তার আপ্রাণ চেষ্টা থাকবে। তিনি মনে করেন, শেখ হাসিনা বিরুদ্ধে যে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে, সেগুলো সঠিক নয়। অভিযোগগুলো সঠিক না বিধায় তিনি ট্রাইব্যুনালে ডিসচার্জের (অব্যাহতির) আবেদন করবেন। এ ধরনের বড় মামলায় রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীর কাউকে মুক্ত করার নজির আছে কিনা তা জানতে চাইলে তিনি বলেন নজির নেই। কিন্তু নজির তো যে কোনো সময় হতে পারে।
