গাজায় গণহত্যা ও ত্রাণ-খাদ্যে ভয়ংকর মাদক
মুফতি আ. জ. ম ওবায়দুল্লাহ
প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গাজা একটি খোলা কারাগার। এখানে অবরুদ্ধ হয়ে লাখ লাখ মানুষ বাস করছে। যেখানে প্রতিদিন সূর্য ওঠে রক্তে ভেজা শিশুর করুণ আর্তনাদে। একদিকে ইসরাইলি বিমান ও ট্যাংক হামলা; অন্যদিকে খাদ্য, পানি, ওষুধের ওপর সর্বাত্মক অবরোধ। তবে এখানেই শেষ নয়। এই গাজা আজ এক ভয়ংকর চক্রান্তেরও শিকার। ত্রাণের আটায় মেশানো হচ্ছে এমন মাদক ও রাসায়নিক পদার্থ, যা ধীরে ধীরে মানুষকে দুর্বল করছে দেহে ও মনে। এটি শুধু নিছক সামরিক আগ্রাসন নয়, বরং একটি জাতিকে ধ্বংসের পূর্ণাঙ্গ নীলনকশা। এই নৃশংসতার বিপরীতে বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্র ও নেতৃত্ব যেভাবে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে, তা ইতিহাসের পাতায় এক কালিমালিপ্ত অধ্যায় হয়ে থাকবে।
গাজায় ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হওয়া নিপীড়নের ইতিহাস ২০২৫ সালে এসে এক নিষ্ঠুরতম অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে। ইসরাইলি বাহিনী ৭ অক্টোবর ২০২৩-এর পর থেকে গাজা উপত্যকার ওপর নজিরবিহীন বোমা হামলা চালিয়েছে, যার শিকার হয়েছে শিশুসহ হাজার হাজার নিরীহ মানুষ। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, এ আগ্রাসনের শিকারদের ৭০ শতাংশই শিশু ও নারী। ইসরাইলি বাহিনী যুদ্ধের সব আন্তর্জাতিক আইনকে ভেঙে কেবল হামলাই চালায়নি, বরং লক্ষ্যভেদী বোমা মেরে টার্গেট করেছে হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ, বিশ্ববিদ্যালয় ও সাংবাদিকদের। এটি নিছক কোনো প্রতিশোধ নয়; বরং এটি একটি পরিকল্পিত গণহত্যা, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যায় শারীরিক, মানসিক ও নৈতিকভাবে।
গাজায় একদিকে ইসরাইল আগুন বর্ষণ করছে, আরেকদিকে ত্রাণের নামে আসছে নতুন আগ্রাসন, মনস্তাত্ত্বিক ও রাসায়নিক চক্রান্ত। আন্তর্জাতিক কিছু সংস্থা ও অনলাইনে ফাঁস হওয়া তথ্যমতে, গাজার জন্য পাঠানো ত্রাণ বিশেষ করে আটা, বিস্কুট ও শিশুখাদ্য ইত্যাদিতে মেশানো হচ্ছে মাদক ও রাসায়নিক পণ্য, যা স্নায়ুতন্ত্রকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে, ঘুমের প্রবণতা বাড়ায়, মানসিক স্থবিরতা সৃষ্টি করে, দীর্ঘমেয়াদে প্রজন্মকে কর্মক্ষমতাহীন বানায়। উদ্দেশ্য স্পষ্ট-ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধক্ষমতা হ্রাস করা, যুবসমাজকে দুর্বল ও মানসিকভাবে ভঙ্গুর করে দেওয়া। এ যেন আধুনিক যুগের ‘ত্রাণবিষ’! ইসরাইল বহু আগে থেকেই মুসলিম নিধনকল্পে পরিকল্পিত দীর্ঘমেয়াদি চক্রান্ত করে আসছে। এরই অংশ হিসাবে তারা ‘বায়োপলিটিক্যাল কন্ট্রোল’ (জৈব-রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ)-এর দিকে এগোচ্ছে। যেখানে শত্রুপক্ষকে সামরিকভাবে মোকাবিলা না করে তাদের শরীর, খাদ্য, পানি, ওষুধ ও পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। গাজার সাহসী মুসলিম তরুণদের মনোবল ভেঙে ফেলতে, শিশুদের মনে ভয় ঢুকাতে, নারীদের ধৈর্য ভঙ্গ করতে এবং পরবর্তী প্রজন্মকে মানসিক দাসে পরিণত করতেই এ কৌশল। দখলকারী শক্তি চায়-তরুণরা জিহাদের শক্তি হারাক, বাচ্চারা মস্তিষ্ক বিকল অবস্থায় বেড়ে উঠুক, নারী-পুরুষ সবাই আত্মসমর্পণ মানসিকতায় অভ্যস্ত হোক।
জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক রেডক্রস, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এসব সংস্থা গাজার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও তারা বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ। পশ্চিমা বিশ্ব যারা নিজেদের ‘মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা’ বলে দাবি করে, তারাই একদিকে অস্ত্র বিক্রি করছে ইসরাইলের কাছে, অপরদিকে ত্রাণ পাঠানোর নামে মাদক-চক্রান্তে অংশ নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। সম্প্রতি গাজায় প্রতিদিন যা হচ্ছে, তা ইউক্রেন বা ইসরাইলে হলে গোটা দুনিয়া কাঁপত। অথচ গাজার বেলায় বিশ্বনেতৃত্ব ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো কেবল দু-চারটা বিবৃতি দিয়েই ক্ষান্ত থাকছে। আফসোসের বিষয় হলো, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বহু দেশ ইসরাইলের এই ভয়াবহতার বিপরীতে কার্যকরী কোনো ভূমিকা রাখছে না।
কিন্তু আর কত দিন? এভাবে তো চলতে দেওয়া যায় না। আমাদেরকে সোচ্চার হতে হবে। ত্রাণের নামে যে মরণফাঁদ শুরু হয়েছে, তা বন্ধ করতে হবে। এজন্য কতগুলো কর্মসূচি নিয়ে সামনে এগোতে হবে। যেমন, ১. বিশ্বস্ত উৎস থেকে ত্রাণ পাঠাতে হবে। যেসব সংগঠন সরাসরি গাজায় প্রবেশ করতে পারে এবং স্থানীয় লোকদের মাধ্যমে বিতরণ করে, সেসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই সাহায্য পাঠাতে হবে। ২. প্রযুক্তিগত পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যেতে হবে। বিশ্বজুড়ে মুসলিম বিজ্ঞানী ও গবেষকদের একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে খাদ্যপণ্যের রাসায়নিক পরীক্ষা করতে হবে। ৩. বয়কট ও সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। যারা এ মরণফাঁদের সঙ্গে জড়িত, তাদের পণ্য বর্জন ও জনমত সৃষ্টি আজ জরুরি।
গাজার রক্ত আজ আমাদের আত্মাকে নাড়া দিয়েছে। ওখানে শিশুরা বোমার শব্দে ঘুমায়, পানি খোঁজে ধ্বংসস্তূপে, আর মুখে বলে, ‘আম্মু, শহীদ হয়ে গেলে মন খারাপ করো না।’ এই বাচ্চার কথায় যদি আমাদের হৃদয় না কাঁপে, তবে মনে করতে হবে যে, আমাদের মনুষ্যত্ববোধ হয়তো হারিয়ে গেছে চিরতরে। গাজার এ ভয়াবহ গণহত্যা ও ত্রাণের নামে চালানো মাদকচক্র আমাদের সামনে এক কঠিন প্রশ্ন তুলে ধরেছে-আমরা কি কেবল চোখের পানি ফেলেই দায়িত্ব শেষ করব, নাকি এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করব? মনে রাখতে হবে, গাজা কেবল একটি ভৌগোলিক অঞ্চল নয়; এটি মুসলিম উম্মাহর সম্মানের প্রতীক, সাহসের প্রতিচ্ছবি এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে জিহাদী চেতনার নাম। আজ যদি আমরা না জাগি, কাল ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। আমাদের দ্বীন, আমাদের অমানবিকতা, আমাদের নীরবতা-সব কিছুর একদিন জবাবদিহি হবে। গাজা আজ চিৎকার করে বলছে : হে উম্মাহ, আমাদের রক্ত দেখে অন্তত জেগে ওঠো!
প্রাবন্ধিক, কবি ও গবেষক
