Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

বাঁধের ২১ স্থানে ভাঙন

ফেনীতে লাখো মানুষ পানিবন্দি ভিড় আশ্রয়কেন্দ্রে

Icon

যুগান্তর ডেস্ক

প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ফেনীতে লাখো মানুষ পানিবন্দি ভিড় আশ্রয়কেন্দ্রে

ছবি : যুগান্তর

টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ফেনীর মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ২১ স্থানে ভাঙনের কারণে শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ। ঘরে পানি ঢুকে পড়ায় গবাদি পশুসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে অনেকে ছুটছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। সেখানে শুকনা খাবার ও সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। তবে বৃষ্টি কমায় কয়েকটি এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতিও হয়েছে।

জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে বর্ন্যাত এলাকায় সেনাবাহিনী উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করেছে। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ, সেনবাগ, সুবর্ণচর ও কবিরহাটে তীব্র জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। অনেকে ঠাঁই নিয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রে।

চার দিন ধরে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলা সদরসহ চার ইউনিয়ন। খাগড়াছড়ির দীঘিনালার মেরুং ইউনিয়নের নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। রাঙামাটির লংগদুর সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া বরিশালের গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, ভোলা ও বান্দরবানে টানা বর্ষণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

ফেনী : ছাগলনাইয়ার দক্ষিণ সতর এলাকার বাসিন্দা সাংবাদিক আবুল কাসেম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, বৃহস্পতিবার আমাদের অঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তীব্র স্রোতে পানি প্রবেশ করে ঘরবাড়িসহ সবকিছু তলিয়ে যাচ্ছে। দেশে ক্ষমতা আর সরকারের পরিবর্তন হলেও আমাদের ভাগ্য কখনো পরিবর্তন হয় না।

কোহিনুর আক্তার নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, সড়কে পানি থাকায় যানচলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ ও নেটওয়ার্কেও সমস্যা। এখনো শুকনা খাবার বা কোনো ধরনের প্রশাসনিক সহায়তা পাইনি।

ফুলগাজী উপজেলার আনন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা আলাউদ্দিন বলেন, গত বছরও এমন অবস্থায় প্রতিবেশীর ছাদে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। এবারও একইভাবে জিনিসপত্র নিয়ে ছাদে উঠেছি। একই উপজেলার পূর্ব ঘনিয়ামোড়ার বাসিন্দা মোজাম্মেল হোসেন স্বপন যুগান্তরকে বলেন, আমাদের ঘরে দুদিন ধরে পানি।

তবে বৃহস্পতিবার থেকে ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। এছাড়া বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই পাওয়া লোকজন জানিয়েছেন, সেখানে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির অভাব রয়েছে।

ফেনী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মজিবুর রহমান বলেন, জেলায় টানা চার দিন মাঝারি ও ভারি বৃষ্টি হচ্ছে। বৃহস্পতিবার বেলা ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৫০ দশমিক ৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আজও হালকা বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকার আশঙ্কা রয়েছে।

ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আবুল কাশেম বলেন, বৃহস্পতিবার বেলা ১টার দিকে নদীর পানি বিপৎসীমার ২ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। নদীতে পানি কমলেও ভাঙনের স্থান দিয়ে পানি ঢুকে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। পানি কমলে বাঁধ মেরামতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সেনাবাহিনী উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করেছে। জেলার ছয় উপজেলায় ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য সাড়ে ১৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

তিনি জানান, ফুলগাজীতে ৯৯, পরশুরামে ৩২, ফেনী সদরে ২২ এবং ছাগলনাইয়ায় ১১টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৭১টিতে আশ্রয় নিয়েছেন ৮ হাজার ২০০ জন। যেখানে রান্নার সুযোগ রয়েছে, সেখানে রান্না করে খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। এছাড়া শুকনা খাবার দেওয়া হচ্ছে।

নোয়াখালী, কোম্পানীগঞ্জ ও সেনবাগ : জেলার বেশির ভাগ সড়ক ও অলিগলির রাস্তাঘাট ডুবে গেছে এবং বাসাবাড়িতে পানি ঢুকেছে। একদিকে ভারি বর্ষণ, অন্যদিকে পানি আটকে থেকে সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা। কোম্পানীগঞ্জে ৪০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ইতোমধ্যে সেখানে ১৪১৯ জন আশ্রয় নিয়েছেন। সুবর্ণচর, কবিরহাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ১২৩ বস্তা শুকনা খাবার এবং প্রতি উপজেলায় ২ লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে জেলা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ২৪ ঘণ্টায় নোয়াখালীতে ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জানান, সুবর্ণচর, কবিরহাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জলাবদ্ধতার কবলে পড়েছে। বিদ্যালয়ে যাতায়াতের রাস্তাঘাট ডুবে গেছে।

কুমিল্লা : কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপপরিচালক আইউব মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, গোমতী নদীর চরে প্রায় ১১ হাজার হেক্টর ফসলি জমি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি। সরকার যদি এসব ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের জন্য বরাদ্দ দেয়, তাহলে তারা পাবেন।

রাঙ্গাবালী (পটুয়াখালী) : টানা চার দিন বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন উপজেলা সদরসহ চারটি ইউনিয়ন। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন হাজারো মানুষ। থমকে গেছে জীবনযাত্রা, ব্যাহত হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির পটুয়াখালী জেনারেল ম্যানেজার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আবুল কাশেম বলেন, ২৮ জুন একটি চক্র সাবমেরিন কেবল কেটে ফেলে। পরে ১ জুলাই তা জোড়া লাগিয়ে বিদ্যুৎ চালু করা হয়।

ধারণা করা হচ্ছে, সেই জোড়া অংশেই ত্রুটি দেখা দিয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করতে চেষ্টা চলছে। বাহেরচর বাজারের বাসিন্দা গোলাম রাব্বানি বলেন, ফ্রিজের মাছ-মাংস অনেকের নষ্ট হয়ে গেছে। সন্ধ্যার পর বাসাবাড়ি এবং দোকানপাট অন্ধকার হয়ে যায়। এ কারণে দোকানপাটের বেচাকেনা কমে গেছে। অনেকে বাসা কিংবা প্রতিষ্ঠানের ট্যাংকে পানি ওঠাতে না পেরে খুব কষ্ট করছে।

খাগড়াছড়ি : দীঘিনালার মেরুং ইউনিয়নের নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে মেরুংপাড়া, সোবাহানপুর, চিটাইগ্যাংয়াপাড়ায় ঘরবাড়িতে পানি ঢুকেছে। দীঘিনালার মেরুং ও কবাখালি ইউনিয়নের অন্তত ৫৫ পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছে। দীঘিনালা-লংগদু সড়কের হেডকোয়ার্টার এলাকায় সড়ক ডুবে যাওয়ার রাঙামাটির লংগদুর সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।

দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) সুজন চন্দ্র রায় বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রে রান্না করে খাবার দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া প্রতিটি পরিবারকে ৩০ কেজি করে চাল দেওয়া হচ্ছে। জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার বলেন, পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের সরে আসার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। যেহেতু টানা বৃষ্টি হচ্ছে, পাহাড়ধসের আশঙ্কা রয়েছে।

গৌরনদী (বরিশাল) : পৌর এলাকাসহ উপজেলার বেশকিছু নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ভোগান্তির কথা চিন্তা করে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাসিন্দারা বাইরে বের হচ্ছেন না। উপজেলার ব্যস্ততম টরকী বন্দর, গৌরনদী বাসস্ট্যান্ড ও উপজেলা চত্বরে লোকজনের আনাগোনা কমে গেছে। ফলে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন শ্রমজীবীরা। আবহাওয়া বিভাগের তথ্যমতে, আরও কয়েকদিন বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে।

বান্দরবান (দক্ষিণ) : বৈরী আবহাওয়ায় প্রাণহানির ঝুঁকি এড়াতে বান্দরবানের লামায় ৭৫টি রিসোর্ট ফের বন্ধ ঘোষণা করেছে উপজেলা প্রশাসন। বৃহস্পতিবার উপজেলা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা প্রস্তুতি কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

আগৈলঝাড়া (বরিশাল) : টানা বৃষ্টিতে উপজেলার জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সড়কে যানবাহন কম। ফলে জরুরি প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হওয়া মানুষকে রাস্তায় হাঁটতে দেখা গেছে। উপজেলার বেশির ভাগ নিচু এলাকায় বৃষ্টির পানি জমে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। মাছের ঘেরেও পানি ঢুকে পড়েছে।

ভোলা : জেলায় টানা ৭ দিন বৃষ্টির পর বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সূর্যের মুখ দেখা গেছে। এরপর ফের নামে বৃষ্টি। ভোলা-লক্ষ্মীপুর, মনপুরা-হাতিয়া-ঢাকা, বেতুয়া-ঢাকাসহ ১০ রুটের লঞ্চ চলাচল বিকাল ৪টা পর্যন্ত বন্ধ ছিল। চট্টগ্রামগামী কয়েকশ যাত্রীকে ইলিশা ঘাটে ভিড় জমাতে দেখা যায়।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম