Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

সৃষ্টিতে অমর শিল্পের মহানায়ক

যমুনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা নুরুল ইসলামের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

Icon

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সৃষ্টিতে অমর শিল্পের মহানায়ক

স্বপ্নজয়ী শিল্পবিপ্লবের মহানায়ক। নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম। সাহসের বাতিঘর। ১৯৭১-এর রণাঙ্গনের সম্মুখসারির এই যোদ্ধা যমুনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তবে সব পরিচয় ছাপিয়ে তিনি দেশের অর্থনীতির সফল আইকন। জীবদ্দশায় সৃষ্টি করে গেছেন শিল্পবিপ্লবের অবিশ্বাস্য মহাকাব্য। দেশপ্রেমিক স্বপ্নজয়ী এই উদ্যোক্তার পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে ২০২০ সালের এই দিনে (১৩ জুলাই) তিনি চিরবিদায় নেন। পরদিন ১৪ জুলাই গভীর শোক, বিনম্র শ্রদ্ধা এবং হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় (গার্ড অব অনার) রাজধানীর বনানী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।

নিজের মেধা, সততা, পরিশ্রম ও সাহসিকতার সঙ্গে একে একে ৪২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়েছিলেন আপসহীন এই কর্মবীর। দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ এই কণ্ঠস্বর আজীবন নির্দ্বিধায় কালোকে কালো ও সাদাকে সাদা বলে গেছেন। গত পাঁচ বছরে শিল্প খাতে তার শূন্যতাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করছে দেশ। কর্মই চিরকাল তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। অপ্রতিরোধ্য এই উদ্যোক্তার মৃত্যুতে দেশের সর্বস্তরে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল সেদিন। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে ও তিন মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তার স্ত্রী বর্তমানে যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও যুগান্তর প্রকাশক অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম। ছেলে শামীম ইসলাম যমুনা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিন মেয়ে সোনিয়া সারিয়াত, মনিকা ইসলাম এবং সুমাইয়া রোজালিন ইসলাম যমুনা গ্রুপের পরিচালক। জন্ম নিলে মৃত্যু নিশ্চিত, এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম সত্য। কিন্তু কিছু মানুষের মৃত্যু যেন একটি বিপ্লবকে থামিয়ে দেয়। ব্যক্তি যখন একটি ‘ইনস্টিটিউশন’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তার মৃত্যু হাজারো মানুষের স্বপ্নকে করে দেয় ক্ষতবিক্ষত। তেমনই এক সিংহপুরুষ ছিলেন নুরুল ইসলাম। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এই উদ্যোক্তার কঠিন পরিশ্রমের কাছে স্বপ্ন এসে ধরা দিত। তিনি স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারতেন। তাই তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যেন একটি শিল্পবিপ্লব থমকে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য এ কথা সত্য যে, তার রেখে যাওয়া যাবতীয় কাজ পিতার পথ ধরে অত্যন্ত সুনিপুণভাবে এগিয়ে নিচ্ছেন পরিবারের সদস্যরা।

জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম। তিনি শিল্প খাতের একটি বিপ্লবের নাম। একজীবনে দুই হাত ভরে দেশকে শুধু দিয়েই গেছেন। যৌবনে অস্ত্র হাতে ১৯৭১ সালে দেশমাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন রণাঙ্গনের প্রথম সারির এই যোদ্ধা। আর স্বাধীনতার পর দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য শুরু করেন নতুন যুদ্ধ। এ যেন অবিরাম পথচলা। মেধা, সততা, পরিশ্রম ও সাহসিকতার সঙ্গে একে একে ৪২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন আপসহীন এই কর্মবীর। তার মালিকানাধীন যমুনা ফিউচার পার্ক এশিয়ার সবচেয়ে বড় শপিংমল। রয়েছে সুনাম অর্জনকারী যমুনা ইলেকট্রনিক্স। এছাড়া মিডিয়া খাতে বিনিয়োগের মধ্যে দৈনিক যুগান্তর ও যমুনা টেলিভিশন দেশজুড়ে অনন্য অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষ করে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে যমুনা টেলিভিশনের সাহসী ও পেশাদারত্বের ভূমিকা কোটি কোটি মানুষের কাছে বিশেষভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সৃষ্টি করেছেন অর্ধলক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান। দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ এই কণ্ঠস্বর আজীবন নির্দ্বিধায় কালোকে কালো ও সাদাকে সাদা বলে গেছেন। কারও রক্তচক্ষুর ভয়ে নীতি থেকে কখনো একচুলও পিছপা হননি। এজন্য জীবনে তিনি জেল-জুলুম থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। কিন্তু সত্য প্রকাশে কারও কাছে মাথা নত করেননি।

২০২০ সালের ১৪ জুন নুরুল ইসলামের করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। ওইদিনই তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। করোনায় তার কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশিষ্ট এই শিল্প উদ্যোক্তার চিকিৎসায় এভারকেয়ারে ১০ সদস্যবিশিষ্ট মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। এর বাইরে চীনের ৪ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং সিঙ্গাপুর মাউন্ড এলিজাবেথ হাসপাতালের দুজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে পরামর্শ দেন। কিন্তু মহান আল্লাহর ইচ্ছা ছিল অন্যরকম। সব চেষ্টা ব্যর্থ করে সংগ্রামী মানুষটি ওই বছরের ১৩ জুলাই না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।

জন্ম ও পারিবারিক জীবন : নুরুল ইসলাম ১৯৪৬ সালের ৩ মে ঢাকার নবাবগঞ্জের চুড়াইন ইউনিয়নের কামারখোলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আমজাদ হোসেন এবং মাতা জোমিলা খাতুন। বিশিষ্ট শিল্পপতি নুরুল ইসলাম যেমন দেশকে ভালোবাসতেন, তেমনি ভালোবাসতেন জন্মদাত্রী জননীকেও। স্রষ্টা তাকে মায়ের প্রতি সেই অগাধ ভালোবাসার প্রতিদানও দিয়েছেন অকুণ্ঠ হস্তে। দেশের শিল্প খাতে মহিরুহ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন মায়ের দোয়া ও নিজের প্রচেষ্টায়।

কর্মজীবন : তিনি যে শিল্পই গড়ে তুলতে চেয়েছেন, সেখানেই সফল হয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত দূরদর্শী ছিলেন। দেখতেন অনেক বড় স্বপ্ন। ব্যবসায়িক জীবনে অত্যন্ত সফল মানুষটি উদ্যোক্তা হয়ে মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির চিন্তা লালন করতেন। শিক্ষাজীবনে এসব স্বপ্নের কথা শেয়ার করতেন সহপাঠীদের সঙ্গে। তবে কর্মজীবনের শুরুতে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। এর মধ্যেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দেশমাতৃকার টানে অস্ত্র হাতে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে বঙ্গবন্ধু যখন সবাইকে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগের আহ্বান জানান, সেই ডাকে সাড়া দিয়ে শুরু করেন ব্যবসা। বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যেমন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তেমনই যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের জন্য গভীর দেশপ্রেম নিয়ে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন তার বহুমাত্রিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন কর্মমুখর একজন মানুষ। সপ্তাহে সাত দিন কাজ করতেন এই মানুষটি। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও সড়কপথে ছুটে যেতেন ফ্যাক্টরি পরিদর্শনে।

শিল্প খাতে একটি বিপ্লবের নাম নুরুল ইসলাম : দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং মানুষের কর্মসংস্থান তৈরিতে নুরুল ইসলাম একজন আধুনিক চিন্তার সাহসী উদ্যোক্তা। স্বাধীন বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প খাতের আলোচিত ও উজ্জ্বল মুখ তিনি। ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন যমুনা গ্রুপ। তারপর সব বাধা উপেক্ষা করে এগিয়ে গেছেন শিল্প খাতের এই আপসহীন উদ্যোক্তা। এশিয়ার সর্ববৃহৎ শপিংমল যমুনা ফিউচার পার্ক, যমুনা ইলেকট্রনিক্স, যমুনা ডিস্টিলারি, বস্ত্র, ইলেকট্রনিক্স, ওভেন গার্মেন্টস, রাসায়নিক, চামড়া, বেভারেজ, টয়লেট্রিজ, মোটরসাইকেল এবং আবাসন খাত ব্যবসাসহ যেখানেই হাত দিয়েছেন, সেখানেই সফলতার স্বর্ণশিখরে পৌঁছেছেন কর্মবীর। যমুনা গ্রুপে বর্তমানে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ কাজ করছে। এই গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো শিল্প ও সেবা খাতে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। অন্যান্য শিল্পের পাশাপাশি দেশের গণমাধ্যমেও তিনি বিশাল বিনিয়োগ করেছেন। পঁচিশ বছর আগে প্রতিষ্ঠা করেন পাঠকপ্রিয় দৈনিক যুগান্তর। এছাড়া বাংলাদেশে বিশ্বমানের একটি টিভি চ্যানেল প্রতিষ্ঠা করা ছিল তার বিশাল এক স্বপ্ন। যা বাস্তবায়নে ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন যমুনা টেলিভিশন। এছাড়া যমুনা ফিউচার পার্ক প্রাঙ্গণে গড়ে তোলা হচ্ছে নুরুল ইসলামের স্বপ্নের বিশ্বমানের হাসপাতাল।

নুরুল ইসলাম মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন বাংলাদেশ স্বাবলম্বী হবে, মাথা তুলে দাঁড়াবে। শুরু থেকেই তার আগ্রহের পুরোটাই ছিল ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। তাই যমুনা ফ্যান, অ্যারোমেটিক সাবান এবং পেগাসাস কেডসের মতো জনপ্রিয় বাংলাদেশি ব্র্যান্ড তৈরি করেছেন তিনি। কেবল গার্মেন্টস বা ডেনিম নয়, উৎপাদনে নানা বৈচিত্র্য এনেছিলেন স্বপ্নবান এই মানুষটি। গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন ফ্রিজ ও মোটরসাইকেলসহ নানা প্রয়োজনীয় সামগ্রী। পণ্যের মানের ব্যাপারে কখনো আপস করতেন না। সব সময় বলতেন, যে পণ্যই তিনি বানাবেন, সেটি হতে হবে নাম্বার ওয়ান। গুণগত মানের কারণে যিনি একবার যমুনার পণ্য ব্যবহার করবেন, তিনি পণ্যের সুনাম ছড়াবেন। এজন্য ‘দেশের জন্য যমুনার পণ্য’ বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের দেওয়া ব্র্যান্ডিং এ স্লোগান সবার কাছে সমাদৃত হয়।

পরিচ্ছন্ন ব্যবসায়ী : ব্যক্তিগত জীবনে নুরুল ইসলাম ছিলেন একজন পরিচ্ছন্ন ব্যবসায়ী। তার সব অর্থ, মেধা ও পরিশ্রম দেশেই বিনিয়োগ করেছেন। খেলাপি ঋণ এবং বিদেশে টাকা পাচারের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার ছিলেন তিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কোনো ব্যাংকে তিনি এক টাকাও ঋণখেলাপি ছিলেন না। বিদেশে টাকা পাচারের কোনো অভিযোগ নেই তার বিরুদ্ধে। এ কারণে তার মালিকানাধীন দুটি গণমাধ্যম দৈনিক যুগান্তর ও যমুনা টিভি খেলাপি ঋণ ও টাকা পাচারের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার ভূমিকা রেখেছে এবং এখনো সে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখে এ বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচার করছে।

মৃত্যুবার্ষিকীর কর্মসূচি : এই বীর মুক্তিযোদ্ধার পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে যুগান্তর ও যমুনা পরিবার আজ স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে। যুগান্তর ভবনে দুপুর ১২টায় আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আগে সকাল ৭টায় যুগান্তরের যমুনা ফিউচার পার্কের মসজিদে পবিত্র কুরআন খতম এবং সকাল ৯টায় বনানী কবরস্থানে কবর জিয়ারত করা হবে। স্মরণসভায় যমুনা গ্রুপের বর্তমান চেয়ারম্যান যুগান্তর প্রকাশক অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম, যমুনা গ্রুপের পরিচালকবৃন্দ, যুগান্তর সম্পাদক আবদুল হাই শিকদার এবং যমুনা পরিবারের অনেকে উপস্থিত থাকবেন।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম