ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা
নারী আসন ও উচ্চকক্ষ নিয়ে ঐকমত্য হয়নি
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, সমাজের বিরাজমান বৈচিত্র্যকে প্রতিনিধিত্ব করতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রয়োজন। কিন্তু কী পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন হবে, সে ব্যাপারে ঐকমত্য হওয়া যাচ্ছে না। এ বিষয়ে কমিশন থেকে দুটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায়ও কিছু কিছু প্রস্তাব এসেছে। এসব প্রস্তাব নিয়ে আরও আলোচনার প্রয়োজন।
সোমবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় পর্যায়ের ১৩তম দিনের আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফকালে অধ্যাপক আলী রীয়াজ এসব কথা বলেন। এ সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ জানান, নারীর ক্ষমতায়ন এবং সংসদে প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছে বিএনপি। এক্ষেত্রে তারা বর্তমানে সংসদে নারীর জন্য সংরক্ষিত ৫০টি আসন সংখ্যা ১০০টিতে উন্নীত করার প্রস্তাব দিয়েছেন। একই সঙ্গে নারী আসনে সংবিধানে বিদ্যমান পদ্ধতিতেই ভোটের পক্ষে অবস্থান তাদের।
আলী রীয়াজ বলেন, জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য স্থায়ীভাবে ১০০ আসন করার ব্যাপারে সবাই একমত হয়েছেন। এক্ষেত্রেও পদ্ধতিগত প্রশ্ন এখনো রয়ে গেছে। এর ফলে এ পদ্ধতি নির্ধারণে আমরা এখনো একমতের জায়গায় পৌঁছাতে পারিনি। বিদ্যমান ব্যবস্থায় আসন সংখ্যার অনুপাতে ৫০ আসনকে ১০০ আসনে উন্নীত করা বা সরাসরি নারী আসনে নির্বাচন-কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত এ দুই প্রস্তাবে একমত না হওয়ায় বিগত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন থেকে বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবটি হলো-সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদের প্রয়োজনীয় সংশোধন করে ভিন্নভাবে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে যেসব রাজনৈতিক দল ২৫টির বেশি আসনে প্রার্থী দেয়, তাদের মধ্য থেকে ন্যূনতম এক-তৃতীয়াংশ নারী প্রার্থী নিশ্চিত করা। তিনি আরও বলেন, এ প্রস্তাবের বাইরেও আলোচনায় আরও কিছু প্রস্তাব এসেছে। তাই বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য কমিশন আলোচনা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বৈঠক শুরুর আগে ব্রিফিংয়ে ড. আলী রীয়াজ বলেন, গত বছরের ১৪ জুলাই ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল। ওইদিন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা মধ্যরাতেই পথে নেমে এসেছিল। নারীদের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর সেই অপমানের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে বেগবান করেছিল এবং সবার প্রতিরোধের মুখে ফ্যাসিবাদী শাসন ক্রমাগত পশ্চাৎপসরণ হতে বাধ্য হয়। তিনি বলেন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে ১৪ জুলাইকে ‘জুলাই নারী দিবস’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। রাষ্ট্র বিনির্মাণে নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। এই প্রাতিষ্ঠানিক রূপের মাধ্যমেই রাজনীতিতে, রাষ্ট্র গঠনে এবং আইনপ্রণয়নে নারীদের মর্যাদার সঙ্গে অংশগ্রহণের পথ তৈরি হবে।
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, নারী প্রতিনিধিত্ব এবং দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদে উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়ে বিএনপি তাদের সুস্পষ্ট অবস্থান তুলে ধরেছে। এ দুটি ইস্যুতে কমিশনের আলোচনায় বিএনপি গঠনমূলক প্রস্তাব দিয়েছে। বাস্তবতার নিরিখে ধাপে ধাপে সংস্কারের পক্ষে মত তাদের। তিনি বলেন, আমরা নারীর ক্ষমতায়ন ও প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর পক্ষে। এর ধারাবাহিকতায় বিএনপির পক্ষ থেকে বর্তমানে সংরক্ষিত ৫০টি নারী আসন সংখ্যা ১০০-তে উন্নীত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তবে আমরা মনে করি, এ আসনগুলো নির্বাচিত হোক বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী বিদ্যমান পদ্ধতিতে। তিনি আরও জানান, সরাসরি নারী আসনের জন্য নতুন করে ১০০টি সংসদীয় আসন নির্ধারণ করা বাস্তবভিত্তিক নয়। তাছাড়া প্রস্তাবিত রোটেশন পদ্ধতি ও নতুন সংরক্ষিত আসনের সীমারেখা নিয়েও অস্পষ্টতা রয়েছে।
কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, রাজনৈতিক দলগুলোকে ৩৩ শতাংশ আসনে নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার বাধ্যবাধকতা প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, আমরা এখনো আরপিও অনুযায়ী দলের বিভিন্ন কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখতে পারিনি। বাস্তবতা হলো, আমাদের সমাজে অধিকাংশ নারী ধর্মীয় ও সামাজিক কারণে সরাসরি রাজনীতিতে আসতে দ্বিধা অনুভব করেন। তাই আমরা ধাপে ধাপে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে চাই, ওভারনাইট কোনো বিপ্লবী পরিবর্তন নয়। তিনি আরও বলেন, নারীর সরাসরি নির্বাচন একসময় বাস্তবতা হয়ে উঠবে; কিন্তু এখন ধাপে ধাপে এগোনোই যৌক্তিক। সংবিধান অনুসারে বর্তমানে ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন রয়েছে। সংসদের আসনের সংখ্যানুপাতে নির্ধারিত এ নারী আসনে রাজনৈতিক দল বা জোটগুলো তাদের নির্ধারিত আসনের জন্য একক প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে থাকে। ফলে এখানে ভোটে নির্বাচিত হওয়ার প্রয়োজন হয় না। দ্বিকক্ষ সংসদ বা আপার হাউজ সংক্রান্ত আলোচনায় বিএনপির এ নেতা বলেন, আমরা আমাদের ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবে এরই মধ্যে আপার হাউজ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছি। আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল সমাজের বিভিন্ন সেক্টরে অবদান রাখা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মেধা, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতাকে রাষ্ট্র পরিচালনায় যুক্ত করা। সে উদ্দেশ্যে প্রতিনিধিত্বমূলক একটি উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। তবে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে ৬৪ জেলা এবং ১২ সিটি করপোরেশন থেকে প্রতিনিধি নির্বাচনের প্রস্তাবকে ‘জেলা পরিষদ বা প্রাদেশিক ব্যবস্থার মতো’ উল্লেখ করে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, বাংলাদেশ ইউনিটারি (এককেন্দ্রিক) সরকার কাঠামো অনুসরণ করে। এ ধরনের আলাদা নির্বাচনের মাধ্যমে ৭৬ সদস্যের উচ্চকক্ষ তৈরি করা উপযুক্ত বা প্রয়োজনীয় নয়।
এ সময় কমিশনের সদস্য হিসাবে বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন। সোমবারের আলোচনায় ৩০টি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ছাড়াও উল্লেখযোগ্য দলগুলো হলো-জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি।
