চানখাঁরপুল মামলার অভিযোগপত্রে গণহত্যার চিত্র
পুলিশ পরিদর্শক জাকিরের গুলিতে শহীদ হন তায়িম
ওয়ারী বিভাগের ডিসি ইকবাল হোসেন ও যাত্রাবাড়ী থানার ওসি (তদন্ত) জাকির হোসেনসহ চারজন পলাতক
প্রতীকী ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রক্তাক্ত জুলাই গণ-অভ্যুত্থান। ২০ জুলাই বেলা ১২টা থেকে দুপুর ২টা। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, কাজলা ও শনির আখড়া, রায়েরবাগসহ বিভিন্ন এলাকা তখন বিক্ষোভে উত্তাল। ওইদিন ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের ডিসি ইকবাল হোসেনের নির্দেশে যাত্রাবাড়ী থানার ওসি (তদন্ত) জাকির হোসেন ও তার সঙ্গীরা বিক্ষোভ দমনে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করে। আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট, বেপরোয়া গুলি ও হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালায়। প্রাণভয়ে আন্দোলনকারীরা দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন। একপর্যায়ে জাকির হোসেন খুব কাছ থেকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে শিক্ষার্থী ইমাম হাসান তায়িম ভূঁইয়াকে (১৯)।
নিহত তায়িম নারায়ণগঞ্জ সরকারি আদমজী নগর এমডব্লিউ কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তায়িম রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের উপপরিদর্শক মো. ময়নাল হোসেন ভূঁইয়ার ছেলে। রাজধানীর চানখাঁরপুলে পুলিশের গুলিতে ৬ আন্দোলনকারীকে হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে যাত্রাবাড়ীর এমন তথ্য উঠে এসেছে। অভিযোগপত্রটি চানখাঁরপুলের সিক্স মার্ডারকে কেন্দ্র করে দেওয়া হলেও প্রাসঙ্গিক কারণে এতে যাত্রাবাড়ীসহ রাজধানীজুড়ে পুলিশের তাণ্ডবের বেশকিছু চিত্র বেরিয়ে আসে।
এদিকে এ মামলায় সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আটজনকে আসামি করে ২১ এপ্রিল চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। সেই প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আকারে ২৫ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ দাখিল করে প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ)। মামলাটি বর্তমানে অভিযোগ গঠন শেষে সূচনা বক্তব্যের জন্য ১০ আগস্ট দিন ধার্য আছে।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই রাতে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের বৈঠক থেকে দেখামাত্রই গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই নির্দেশ বাস্তবায়নে ২০ জুলাই ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান তার অধীনস্থ পুলিশ সদস্যদের দ্বারা হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করেন। এদিন রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, বাড্ডা, উত্তরা, আজমপুর, শনির আখড়া, রায়েরবাগ, কাজলাসহ বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের বেপরোয়া গুলি ও হেলিকপ্টার থেকে গুলির মাধ্যমে শতাধিক নিরীহ ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়। যাত্রাবাড়ীতে শিক্ষার্থী ইমাম হাসান তায়িম ভূঁইয়াকে খুব কাছ থেকে যাত্রাবাড়ী থানার ওসি জাকির হোসেন গুলি করে হত্যা করে। একইভাবে গুলি করে হত্যা করা হয় শিশু ইমাদ হাসানকেও।
অভিযোগে জানা যায়, ১৬ জুলাই পূর্বনির্ধারিত শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের উদ্দেশ্যে ঢাকার ১৬টি স্থানে শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেন। এদিন ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানের নির্দেশে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ এবং দলটির অঙ্গসংগঠনের সন্ত্রাসীদের সমন্বয়ে একযোগে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালানো হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় দুজন সাধারণ মানুষ মারা যান। একইভাবে ১৭ জুলাই শহীদ আবু সাঈদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠানে পুলিশ বাধা দেয়। এতে ডাকসুর সাবেক সমাজকল্যাণ সম্পাদক আখতার হোসেনকে নির্মম নির্যাতনের পর গ্রেফতার করে পুলিশ।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘২১ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, বাড্ডা, উত্তরা, আজমপুর, শনির আখড়া, রায়েরবাগ, কাজলা, সায়েদাবাদ, মালিবাগ, বারিধারা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, প্রগতি সরণি, মোহাম্মদপুর, বেড়িবাঁধ, মিরপুর-১০ বেনারসি পল্লী, সাইনবোর্ড, ডেমরাসহ বিভিন্ন স্থানে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর ডিএমপির পুলিশ সদস্যরা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ৯ জনকে হত্যা করে।’ এতে কয়েক শ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা গুরুতর আহত হন।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ৪ আগস্ট দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা। এদিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ গুলি চালিয়ে শতাধিক মানুষকে হত্যা করে। ওইদিন ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় মেধবী ছাত্র গোলাম নাফিসকে গুলি করে অর্ধমৃত অবস্থায় রাস্থায় ফেলে রাখা হয়। এরপর গোলাম নাফিসকে রিকশায় তুলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় আওয়ামী লীগ সন্ত্রসীরা চিকিৎসা দিতে রিকশাচালককে বাধা দেয়। এর ফলে চিকিৎসা না পেয়ে নাফিস রিকশাতেই মারা যান।
এদিকে শিক্ষার্থী ইমাম হাসান তায়িম ভূঁইয়াকে হত্যার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একটি অভিযোগ দায়ের হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত সংস্থা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। তদন্ত কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, এ মামলার আসামি ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের ডিসি ইকবাল হোসেন ও যাত্রাবাড়ী থানার ওসি (তদন্ত) জাকির হোসেনসহ চারজন এখনো পলাতক। ট্রাইব্যুনাল থেকে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রয়েছে।

