Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

আলোচনা সভায় তারেক রহমান

ভুল সিদ্ধান্তে যেন ফ্যাসিবাদ পুনর্বাসনের সুযোগ না পায়

কিছু ঘটনায় সরকারের সক্ষমতা ক্ষেত্রবিশেষে জনমনে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে * সরকারের একটি অংশের সহায়তায় কেউ কি দেশে উদ্দেশ্যমূলক পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে-জনমনে জিজ্ঞাসা * সরকারের পক্ষে আদৌ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব কিনা-এমন প্রশ্ন বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ভুল সিদ্ধান্তে যেন ফ্যাসিবাদ পুনর্বাসনের সুযোগ না পায়

কোনো আবেগতাড়িত কিংবা ভুল সিদ্ধান্তের কারণে যেন চরমপন্থা কিংবা ফ্যাসিবাদ পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ না পায়-সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে দেশে সংঘটিত কিছু নৃশংস এবং অনাহুত ঘটনা জনমনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সক্ষমতাকে ক্ষেত্রবিশেষে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো একটি অংশের সহায়তায় কেউ কেউ কি দেশে উদ্দেশ্যমূলক পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে কিনা-সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় মানুষের কথা শুনলে বোঝা যায়-এই বিষয়টিও জনমনে জিজ্ঞাসা রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে আদৌ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব কিনা-কোনো কোনো মহল থেকে এমন ধরনের প্রশ্ন উপস্থাপন বিচ্ছিন্ন বক্তব্য হিসাবে বোধহয় দেখার আজ কোনো সুযোগ নেই।’ শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানী ফার্মগেটের কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে এক আলোচনা সভায় (ভার্চুয়ালি) বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন। ‘গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪ : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অবদান ও শহীদদের স্মরণে স্মরণসভা’ শীর্ষক এই সভা হয়।

সরকারের সম্ভাব্য প্রতিশ্রুতির সময় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে কেউ সময়ক্ষেপণ করতে চাইছে কিনা সে ব্যাপারেও সজাগ দৃষ্টি রাখার জন্য গণতন্ত্রকামী জনগণ, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ও আন্দোলনরত দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান তারেক রহমান। তিনি বলেন, ‘সরকারকে বলব, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আরও স্বচ্ছ এবং সাহসী ভূমিকা রাখুন। বাংলাদেশের গণতন্ত্রে বিশ্বাসী জনগণ আপনাদের পাশে থাকবে। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলো আপনাদের পাশে থাকবে।’

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা রাষ্ট্রের অপব্যবহার কিংবা প্রশাসনিক কূটকৌশলের পরিবর্তে কারও রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণের প্রধান মাধ্যম হওয়া দরকার জনগণের রায়, আস্থা এবং বিশ্বাস। দেশে জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা না গেলে আমাদের কোনো আয়োজনই শেষ পর্যন্ত কিন্তু কোনো কাজে আসবে না, টেকসই হবে না।

তিনি বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় জীবনে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। হাজারো শহীদের কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার পূর্ব শর্তই হচ্ছে জনগণের সরাসরি ভোটে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ এবং জবাবদিহিমূলক একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা। জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে দেশে এমন একটি গণতান্ত্রিক নিরাপদ নির্বাচনি ব্যবস্থা থাকা জরুরি, যেখানে প্রতিটি ভোটার নির্ভয়ে ও নিশ্চিন্তে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের কাঠামো সম্পূর্ণরূপে ভেঙে দিতে হলে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা প্রয়োগ এবং চর্চার কোনোই বিকল্প নেই।’

দেশের শিক্ষার্থী এবং তরুণ-তরুণীদের উদ্দেশে তারেক রহমান বলেন, ‘আজকের তারুণ্যই আগামীর বাংলাদেশ। ছাত্র-তরুণদের সাহসী অংশগ্রহণ ছাড়া বিশ্বের কোনো দেশেই স্বৈরাচার কিংবা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থান সফল হওয়ার উদাহরণ খুবই বিরল। তবে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য আপনাদের সবার আগে জ্ঞান-বিজ্ঞানে, মেধা-মননে, প্রজ্ঞা-অভিজ্ঞতায় আরও সমৃদ্ধ হতে হবে। আপনাদের মনে রাখতে হবে-জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রসরমান বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে শুধু স্লোগাননির্ভর কিংবা প্রচলিত প্রথাগত রাজনৈতিক সংস্কৃতি দিয়ে ২০২৪ সালের শহীদ, ১৯৭১ সালের শহীদ কারোই কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়। শহীদদের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গড়তে চাইলে অবশ্যই নিজেদের যোগ্য মানুষ এবং যোগ্য নেতা হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। সেই মহান লক্ষ্যকে সামনে রেখে সরকারি কিংবা বেসরকারি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসগুলোকে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত রাখতে হবে। আপনাদের অবশ্যই পালন করতে হবে অগ্রণী ভূমিকা। রাজনৈতিক কার্যক্রমের পাশাপাশি লেখাপড়াই হতে হবে প্রথম এবং প্রধান অগ্রাধিকার।’

বক্তব্যের শুরুতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ, আহত এবং যারা এখনো চিকিৎসাধীন আছেন তাদের প্রত্যেকের অবদানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। তারেক রহমান বলেন, ‘দৃঢ়ভাবে একটি কথা বিশ্বাস করি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা যেভাবে জনগণের হৃদয়ে স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে রয়েছেন এবং থাকবেন, ঠিক একইভাবে ২০২৪ সালে দেশ এবং জনগণের স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধে শহীদরাও আজীবন জনগণের হৃদয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যেভাবে রাজপথে সাহসের সঙ্গে নেমে এসেছিলেন, যেভাবে রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন, একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে সেদিন থেকেই আমার চূড়ান্ত বিশ্বাস জন্মেছিল এ মাফিয়া সরকারের পতন এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। সেই উপলব্ধি এবং বিশ্বাস থেকেই ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী আন্দোলনকে ফ্যাসিস্ট পতনের একদফা আন্দোলনে পরিণত করে, ফ্যাসিস্টের পতন নিশ্চিত করতে বিএনপিসহ দেশের সব গণতান্ত্রিক দল পরিকল্পনা এবং কৌশল অবলম্বন করেছিল। তবে কোটা সংস্কারের পথ ধরে ফ্যাসিস্ট পতনের আন্দোলন যাতে দেশে বা বিদেশে কোনোভাবেই কোনো একটি পার্টিকুলার বা কোনো একক রাজনৈতিক দলের আন্দোলন হিসাবে পরিচিতি না পায় সেটিও নিশ্চিত রাখা ছিল রাজনৈতিক কৌশলের একটি অংশ।

তিনি বলেন, কোটা সংস্কারের বিষয়টি বিএনপির কর্মপরিকল্পনায় অনেক আগে থেকেই ছিল অন্তর্ভুক্ত। ২০১৪ সালের ১৫ জুলাই লন্ডনে বিএনপি আয়োজিত এক আলোচনা সভায় দেশবাসীর উদ্দেশে কিছু বিষয় বিএনপির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরেছিলাম। বলেছিলাম স্বাধীনতার এত বছর পরেও সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা পদ্ধতি সম্পূর্ণভাবে অযৌক্তিক। জনগণের রায়ে বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পেলে চাকরিতে কোটা পদ্ধতি ৫৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে, পরিবর্তন করে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনবে বা আনার পরিকল্পনা রয়েছে। সেদিনই বলেছিলাম ২০১৪ সালে। পরে দেখেছি ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলন চলাকালেই কোটা সংস্কারের দাবিতে ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে আসেন। এবং শেষ পর্যন্ত কোটা সংস্কার আন্দোলনের পথ ধরে হাজারো শহীদের মৃত্যুর সিঁড়ি বেয়ে দীর্ঘ দেড় দশকের বেশি সময় ধরে চলা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন সফল হয়। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন সফল হয়েছিল সেদিন শহীদ ইমতিয়াজ আহমেদ জাবির, সাজ্জাদ হোসেন সজল, মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধসহ আরও প্রায় ২ হাজার শহীদের আত্মদানের মাধ্যমে। সুতরাং গণ-অভ্যুত্থানে বীর শহীদরা জাতির গৌরব। তারা গণতন্ত্রকামী মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণা।

তারেক রহমান বলেন, ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে শহীদদের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গড়ার মাধ্যমে তাদের (শহীদদের) রক্তের ঋণ পরিশোধ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। একটি ইনসাফ, ন্যায়ভিত্তিক এবং তাঁবেদারমুক্ত গণতান্ত্রিক মানবিক বাংলাদেশ গড়ার মাধ্যমে আজ আমরা শহীদদের প্রতি সত্যিকারভাবে সম্মান এবং শ্রদ্ধা জানাতে পারি।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনার কাছে অনুরোধ, নির্বাচনের পরে যদি জনগণের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেন তাহলে আমাদের প্রথম কাজ হওয়া উচিত-যে পরিবারগুলো তাদের সন্তানকে হারিয়েছে, অসহায় হয়েছে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য, শিক্ষার্থী ও বিএনপি নেতাকর্মীদের একটি ফান্ড গঠন করতে প্রস্তাব করবেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, এই ফান্ড দিয়ে পরিবারগুলোকে সহায়তা করা হবে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, আজকে এই অবস্থার মাঝে ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকার’ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা এটাকে রোধ করব।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তৌফিকুল ইসলাম মিথিলের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন- বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, বিএনপির জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান, শোক ও বিজয়ের বর্ষপূর্তি পালন কমিটির আহ্বায়ক ও দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী, কমিটির সদস্য সচিব ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল হান্নান চৌধুরী। এছাড়াও বক্তব্য দেন-ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রকিব, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আবু হোরায়রা, গণ-অভ্যুত্থানের শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ, ইমতিয়াজ আহমেদ আবির, সাজ্জাদ হোসেন সজলের স্বজন এবং গণ-অভ্যুত্থানে আহত আল মিরাজসহ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ আরও অনেকে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম