Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

শিক্ষা উপদেষ্টা ও সচিবের পদত্যাগের দাবি

শিক্ষার্থী-পুলিশ সংঘর্ষে সচিবালয় রণক্ষেত্র

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষার্থী-পুলিশ সংঘর্ষে সচিবালয় রণক্ষেত্র

ছবি: সংগৃহীত

শিক্ষা উপদেষ্টা, শিক্ষা সচিবের পদত্যাগসহ বেশকিছু দাবিতে সচিবালয় ঘিরে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার দুপুর থেকে শত শত শিক্ষার্থী সচিবালয় এলাকায় সমবেত হয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। একপর্যায়ে তারা তিন নম্বর গেট টপকে জোর করে সচিবালয়ের ঢুকে পড়েন। সেখানে তারা স্লোগান দেন এবং গাড়ি ভাঙচুর করেন। এতে সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ লোকজনের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সচিবালয়ের ভেতর থেকে শিক্ষার্থীদের বের করতে সেনাবাহিনী ও পুলিশ সেখানে প্রবেশ করে। তারা শিক্ষার্থীদের ওপর বেধড়ক লাঠিচার্জ করে। এ সময় শিক্ষার্থীরা চারদিকে ছোটাছুটি করতে থাকে। একপর্যায়ে তারা বাইরে এসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর চড়াও হন। চারদিক থেকে এলোপাতাড়ি ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। তারা আবারও সচিবালয়ে প্রবেশের চেষ্টা চালান। এ সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দফায় দফায় পালটাপালটি ধাওয়া হয়। সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে পল্টন, জিরো পয়েন্টসহ সচিবালয়ের আশপাশের এলাকায়। পুলিশ শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে একের পর এক সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। ফলে সচিবালয়ের আশপাশের এলাকা ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। এ সময় শিক্ষার্থীরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। সব মিলে সচিবালয় ঘিরে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। একপর্যায়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ধাওয়ায় শিক্ষার্থীরা সচিবালয় এলাকা ছেড়ে জিরো পয়েন্টের দিকে সরে যান। বিকাল পর্যন্ত চলতে থাকে পালটাপালটি ধাওয়া ও সংঘর্ষ। এতে ৮০ জন শিক্ষার্থী আহত হন। তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়েরকে প্রত্যাহার করা হয়।

অভিযোগ উঠেছে, ছাত্রদের এই আন্দোলন ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার লক্ষ্যে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কর্মীরাও শিক্ষার্থীদের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। সন্দেহভাজন হিসাবে চারজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের ভেতর একজন নরসিংদী ছাত্রলীগের নেতা বলে ধারণা করা হচ্ছে। পুলিশ বিষয়টি যাচাই-বাছাই করছে। পুলিশ বলছে, যেভাবে আন্দোলনকারীরা হামলা চালিয়েছে, এতে নিষিদ্ধ গোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতাই প্রমাণ করে। এরই মধ্যে একজন ছাত্রলীগ নেতার ভিডিও পাওয়া গেছে, তা পর্যালোচনা চলছে।

জানা যায়, উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে সোমবার বিমান বিধ্বস্তে হতাহতের ঘটনায় মঙ্গলবারের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিতের দাবি ওঠে। মন্ত্রণালয়ের দীর্ঘসূত্রতায় সেই পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা আসে সোমবার রাত ৩টায়। পরীক্ষা স্থগিতের খবর না পাওয়ায় অনেকেই মঙ্গলবার সকালে পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে ফিরে আসেন। এসব শিক্ষার্থী ক্ষোভে ফেটে পড়েন। মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকার বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ, ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ, আইডিয়াল কলেজ, নূর মোহাম্মদ কলেজ, মিরপুর বাঙ্লা কলেজ, কমার্স কলেজ, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, মিরপুর কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের চলমান এইচএসসি পরীক্ষার্থীসহ আরও কিছু শিক্ষার্থী প্রথমে সায়েন্স ল্যাব মোড় সড়কে একত্রিত হয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ঘেরাও করতে যান। সেখান থেকে দুপুর দেড়টার দিকে সচিবালয়ের সামনে আসেন তারা। প্রথমে শিক্ষার্থীরা সচিবালয়ের তিন নম্বর ফটকের সামনে বিক্ষোভ করেন। এরপর তারা সচিবালয়ের প্রতিটি গেটের সামনে অবস্থান নেন। ‘ভুয়া ভুয়া’ ও ‘আমার ভাই মরল কেন, প্রশাসন জবাব চাই’-এমন স্লোগান দেন। শিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিসহ বিভিন্ন স্লোগানে প্রকম্পিত হতে থাকে চারপাশ। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে শিক্ষা সচিব সিদ্দিক জুবায়েরকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় সরকার। এরপরও শিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে সচিবালয়ের সামনে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ চলতে থাকে। সচিবালয়ের সামনে পুলিশ প্রহরা থাকলেও একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা তিন নম্বর গেট টপকে ভেতরে ঢুকে পড়েন। তারা বিভিন্ন যানবাহন ভাঙচুর করেন। এ সময় পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও সচিবালয়ের ভেতরে প্রবেশ করে। বিকাল ৫টার দিকে পুলিশ টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে বের করে দেয়। পরে বাইরে এসে আন্দোলনকারীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান। সচিবালয়ের আশপাশ, পল্টন জিরো পয়েন্ট এলাকায় দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে। একপর্যায়ে সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে আন্দোলনকারীদের সেখান থেকেও সরিয়ে দেয় পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, পুরো এলাকা এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে।

বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান আরেফিন বলেন, প্রশ্নপত্রে ভুল, দায়িত্বে অবহেলাসহ বিভিন্ন কারণে আমরা শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষা সচিবের পদত্যাগ চাইছি। শিক্ষা বোর্ড সংক্রান্ত সব দায়িত্বশীলকে বহিষ্কার করতে হবে। সব শিক্ষা বোর্ডে একই প্রশ্নে পরীক্ষা হতে হবে। মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং সঠিক তথ্য প্রকাশ করতে হবে। ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী জোনায়েদ আহমেদ বলেন, মাইলস্টোন কলেজে এত বড় বিপর্যয়ের পরও আজকের এইচএসসি পরীক্ষা প্রথমে স্থগিত করা হয়নি। রাত ৩টার দিকে কেন এ সিদ্ধান্ত নিতে হবে? সকালে ঘুম থেকে উঠে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে বাসা থেকে বের হওয়ার পর তিনি শুনেছেন পরীক্ষা স্থগিত। এমন অবিবেচক শিক্ষা উপদেষ্টা ও সচিবকে আর দেখতে চাই না। তাই তাদের পদত্যাগের দাবিতে সচিবালয়ের সামনে আন্দোলনে আসেন তারা। সিটি কলেজের শিক্ষার্থীর তানভীর বলেন, গোপালগঞ্জের সামান্য কারণে এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করেছে। অথচ কাল এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল, বারবার বলার পরও তারা এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করেনি। রাত ৩টা যখন বাজে, তখন স্থগিত করেছে। ততক্ষণে সব শিক্ষার্থী জানতেও পারেনি। সকালে অনেকে পরীক্ষা দিতে বেরিয়েছেন। এগুলো স্পষ্ট দায়িত্বে অবহেলা এবং একঘেয়েমি। আমরা এই শিক্ষা সচিব ও শিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগ চাই। তাদের পদত্যাগ নিশ্চিত না করে ঘরে ফিরে যাব না। সচিবালয়ের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ উপকমিশনার মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বলেন, পরিস্থিতি বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। বিকালে আন্দোলনকারীদের সরিয়ে সচিবালয়ের ফটক খুলে দেওয়া হলে আটকা পড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেরিয়ে যেতে পেরেছেন।

৮০ শিক্ষার্থী আহত : এদিকে সংঘর্ষ চলার মধ্যে ৮০ জন শিক্ষার্থী আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান। হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মো. ফারুক বলেন, তাদের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে কয়েকজন হলেন-আশিক (১৯), রাকিবুল হাসান (২১), আসাদ আহমেদ (১৮), হাসান (১৮), আফসানা (১৮), মুগ্ধ (১৯), অন্তর (২০), শাকিল (২৩), শাওন (১৯), তানসিন (২০), সিয়াম (১৮), মাহিম (১৮), রেদোয়ান ইসলাম (২০), হাসিব (১৮) ও নেহাল (২০)।

লালবাগ মডেল কলেজের শিক্ষার্থী নাজমুস সাকিব বলেন, হাসিনা সরকারের আমলে যেভাবে পুলিশ ছাত্রদের পিটিয়েছে, আজও সেই একইভাবে আমাদের পেটানো হয়েছে। আমাকে বন্দুকের বাঁট দিয়ে পিটিয়েছে পুলিশ। পা থ্যাঁতলে দেওয়া হয়েছে। ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের শিক্ষার্থী সাইমুন বলেন, ‘সচিবালয়ের গেটের ভেতরে সুকৌশলে ছাত্রদের ঢুকিয়ে পুলিশ আমাদের ওপর লাঠিচার্জ করেছে। সচিবালয়ের কর্মচারীরা পর্যন্ত ছাত্রদের পিটিয়েছেন। অনেক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।’

এদিকে রমনা বিভাগের ডিসি মাসুদ আলম যুগান্তরকে বলেন, আন্দোলনকারীদের হামলায় বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। আন্দোলনে নরসিংদীর একজন ছাত্রলীগ নেতাসহ বেশ কয়েকজন ছিল-এমন তথ্য রয়েছে। বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ আমরা পর্যালোচনা করছি।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম