ভয়াল দুর্ঘটনার বর্ণনা মানুষের মুখে মুখে
আসাদুল্লা লায়ন
প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের পর শিক্ষার্থীরা মানসিক অস্থিরতা কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। ফলে ঘটনার পাঁচ দিন পরও শুরু করা যায়নি স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষার্থীদের বিপর্যস্ত মানসিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ধাপে ধাপে শিক্ষা কার্যক্রম চালুর কথা ভাবছে প্রতিষ্ঠানটি। অন্যদিকে দুর্ঘটনাস্থলে প্রতিদিনই ভিড় করছেন কৌতূহলী মানুষ, শিক্ষার্থীদের স্বজন ও সাধারণ মানুষ। তাদের কেউ কেউ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন। আগত মানুষজন মন ভার করে সেই ভয়ের গল্প শুনছেন, কোমলমতি শিশুদের জন্য সমবেদনা প্রকাশ করছেন। শনিবার দুপুর থেকে উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা যায়।
দুর্ঘটনাস্থল ঘিরে অসংখ্য মানুষের ভিড় এড়িয়ে মাঠের পাশে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন ব্যবসায়ী মনোয়ার হোসেন। ভয়াবহ এই বিমান দুর্ঘটনায় তার আত্মীয়ের মেয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। নিহত নুসরাত জাহান আনিকা স্কুলটির তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত। দুর্ঘটনার পর আনিকাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এসব জানাতে গিয়ে পঞ্চাশোর্ধ্ব মনোয়ারের কথা জড়িয়ে আসছিল। তিনি অত্যন্ত ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন, ঘটনার সময় আমি ব্যবসার কাজে লালবাগ এলাকায় ছিলাম। খবর পেয়েই আমি বার্ন ইনস্টিটিউটে চলে যাই। অনেক খোঁজাখুঁজির পর জানতে পারি আনিকা সিএমএইচে আছে, কিন্তু বেঁচে নেই। এতগুলো শিশুর এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
এদিন দুপুরে স্কুলে আসেন পঞ্চম শ্রেণির নূরে জান্নাতি ইউশার দুই খালা ইশরাত জাহান মীম ও তাসলিমা বেগম। স্কুল ক্যাম্পাসে বেশ কিছুক্ষণ খোঁজার পর ইউশার ব্যাগ পান তারা। সেখানে পঞ্চম শ্রেণির অন্তত ১০০ শিক্ষার্থীর ব্যাগ সাজিয়ে রাখা ছিল। এ সময় তারা জানান, তাদের পরিবারের পাঁচ সন্তান এই প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে। ইউশাকে সেদিন তার একাদশ শ্রেণিতে পড়ুয়া বড় ভাই তাহসিন ইসলাম রোহান গ্রিল ভেঙে উদ্ধার করে। মুহূর্তেই তার শরীরের ১০ শতাংশ পুড়ে যায়। এখন সে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ইউশার খালা ইশরাত জাহান মীম বলেন, পুরো পরিবার এখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছে। সবাইকে ইউশার নানা বলছেন, আমার নাতিদের ওই স্কুলে আর কখনো পাঠাব না। কোনো স্কুলেই পাঠাব না। তারা শুধু বেঁচে থাকুক, এটুকুই যথেষ্ট।
ব্যাগ নেওয়ার পর দুর্ঘটনাস্থলের পাশ দিয়ে ফিরছিলেন তারা। এ সময় সেখানে অসংখ্য মানুষের ভিড় দেখতে পান। যাদের অনেকেই ছবি তুলছিলেন, ভিডিও করছিলেন। এ সময় ইউশার খালা তাসলিমা বেগম তাদের ওপর বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, এটা কি কোনো শুটিং স্পট? তারা যেন তামাশা দেখতে এসেছেন। এদিকে দিনভর অতিরিক্ত মানুষের ভিড় নিয়ে নিরাপত্তাকর্মীদের মাঝেও ক্ষোভ দেখা গেছে। তারা বলছেন, সারাক্ষণ কাণ্ডজ্ঞানহীনভাবে মানুষ ভিড় করছেন, এমনকি অনেকেই এখানে এসে টিকটক করছেন।
সেখানে উপস্থিত ব্যক্তিদের একজন কেরানীগঞ্জের মো. শাওন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, কীভাবে এত ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটল সেই কৌতূহল থেকে এসেছি। আমি কেরানীগঞ্জ থেকে অফিসের কাজে উত্তরায় এসেছিলাম। কাজ শেষ করেই এখানে এসেছি, সেদিন কী ঘটেছিল তা শুনছি প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে। সেদিন উদ্ধার কাজে অংশ নেওয়া অনেকেই তাদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা বলছেন।
এদিন স্কুলে আসেন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র জুনায়েদ সিদ্দিক। দুর্ঘটনার ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলে, ওইদিন বিমান দুর্ঘটনার সময় বিকট শব্দ হয়েছিল। মনে হয়েছিল কানের পর্দা ফেটে যাবে। আতঙ্কে সবাই ছোটাছুটি করি। একপর্যায়ে শান্ত হয়ে স্কুলের যে ভবনটিতে বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে সেখানে আসি। দেখি শিশু শিক্ষার্থীদের হাত-পা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। বহু শিক্ষার্থী আগুনে পুড়ে গেছে। এমন করুণ দৃশ্য বলে বোঝানো যাবে না। এখন রাতে ঘুমাতে গেলে ওই দৃশ্য চোখে ভেসে ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে ক্লাস-পরীক্ষা দেব মাথায় আসে না।
এদিকে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে রোববার থেকে সীমিত পরিসরে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের জনসংযোগ কর্মকর্তা শাহ বুলবুল বলেন, পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ধাপে ধাপে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করব। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও মানসিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে সোমবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানো হবে। তবে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষতি যেন দীর্ঘস্থায়ী না হয়, সেটিই আমাদের অগ্রাধিকারে থাকবে।
শাহ বুলবুল আরও বলেন, দুর্ঘটনার পর আমরা প্রথমেই শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছি। কারণ এমন এক ভয়াবহ ঘটনার পর শিক্ষার্থীদের মনে যে ভয়, আতঙ্ক ও অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে, তা সময় ও সহানুভূতির মাধ্যমে কাটিয়ে উঠতে হবে। আমরা অভিভাবক, শিক্ষক ও প্রশাসনের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছি এবং ধাপে ধাপে শিক্ষা কার্যক্রম চালুর বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
প্রসঙ্গত, গত সোমবার দুপুরে বিমানবাহিনীর এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান বীর উত্তম একে খন্দকার বিমান ঘাঁটি থেকে উড্ডয়নের পর দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন ক্যাম্পাসে বিধ্বস্ত হয়। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, কারিগরি ত্রুটির কারণে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। এ ঘটনায় প্রায় ৪০ জন রোগী এখনো বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি রয়েছে, যাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এছাড়াও শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ৩৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
