গুলশানে সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজি
পুলিশকে পুড়িয়ে মারার হুমকি দেয় বেপরোয়া রিয়াদ
চারজন সাত দিনের রিমান্ডে * তাদের শেকড় অনেক গভীরে -উমামা ফাতেমা
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আব্দুর রাজ্জাক বিন সুলাইমান ওরফে রিয়াদ।
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সাবেক সংসদ-সদস্য (এমপি) শাম্মী আহমেদের রাজধানীর গুলশানের বাসায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজির নেতৃত্ব দেন আব্দুর রাজ্জাক বিন সুলাইমান ওরফে রিয়াদ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক রিয়াদ বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় সংসদেরও সদস্য।
পুলিশের অভিযানসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চাঁদাবাজির ঘটনায় হাতেনাতে ধরা পড়ার পর পুলিশের সঙ্গে বেপরোয়া আচরণ করেন রিয়াদ। একপর্যায়ে অভিযানে থাকা পুলিশ সদস্যদের পুড়িয়ে মারারও হুমকি দেন তিনি। থানায় আনার পরও পুলিশকে নানা হুমকিধমকি দিতে থাকেন রিয়াদ। পুলিশ জানায়, রিয়াদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির একাধিক অভিযোগ রয়েছে। শাহ আলী থানা এলাকার একটি অফিসে গিয়ে মব তৈরি করে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে রিয়াদের বিরুদ্ধে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে ছবি তুলে নিজের ফেসবুকে দিতেন রিয়াদ। সেসব ছবি দেখিয়ে উচ্চমহলে তার সখ্য আছে দাবি করে প্রভাব বিস্তার করতেন তিনি। এদিকে চাঁদাবাজির ঘটনার জেরে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ থেকে রিয়াদকে শনিবার গভীর রাতে বহিষ্কার করা হয়েছে। সাবেক এমপি শাম্মী আহমেদ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে থাকায় তার স্বামী সিদ্দিক আবু জাফরকে (৭৪) জিম্মি করেন রিয়াদ ও তার সহযোগীরা। প্রথম দফায় আবু জাফরের থেকে ১০ লাখ টাকা বাগিয়ে নেন তারা। আরও ৪০ লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে শনিবার সন্ধ্যায় গুলশানের বাসায় গেলে পুলিশের হাতে রিয়াদ ও তার চার সহযোগী গ্রেফতার হন। গ্রেফতার অন্যরা হলেন-বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঢাকা মহানগর শাখার আহ্বায়ক ইব্রাহীম হোসেন মুন্না, ঢাকা মহানগর শাখার সদস্য মো. সাকাদাউন সিয়াম ও সাদমান সাদাব এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কর্মী মো. আমিনুল ইসলাম। তাদের মধ্যে চারজনের সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
চারজনের সাত দিনের রিমান্ড : গুলশানে চাঁদাবাজির অভিযোগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক আব্দুর রাজ্জাক রিয়াদসহ চারজনের সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন আদালত। রিমান্ডে যাওয়া অন্যরা হলেন সাকাদাউন সিয়াম, সাদমান সাদাব ও মো. ইব্রাহিম হোসেন। রোববার শুনানি শেষে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জিয়াদুর রহমান এ আদেশ দেন। এদিন ৪টা ৫ মিনিটের দিকে অভিযুক্তদের একটি প্রাইভেট কারে করে সিএমএম আদালতে হাজির করা হয়। এরপর তাদের সরাসরি সিএমএম আদালতের চারতলায় জিয়াদুর রহমানের আদালতে তোলা হয়। এ সময় তাদের নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দেন আইনজীবীরা। সাজার দাবি জানান। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও গুলশান থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মোখলেছুর রহমান চারজনের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। তাদের আইনজীবী রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিনের আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষ সর্বোচ্চ রিমান্ডের আবেদন করে শুনানি করেন। শুনানি শেষে আদালত আদেশ দেন।
অপর একজনের বয়স ১৮ বছরের নিচে হওয়ায় তাকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন। অভিযুক্ত শিশুকে গাজীপুরের টঙ্গী কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. শওকত আলী।
ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা : শাম্মী আহমেদের বাসায় চাঁদাবাজির ঘটনায় গুলশান থানায় ছয়জনকে অভিযুক্ত করে মামলা করা হয়েছে। শাম্মীর স্বামী সিদ্দিক আবু জাফর বাদী হয়ে করা মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়-আসামি মো. আব্দুর রাজ্জাক রিয়াদ এবং কাজী গৌরব অপু তাকে বিভিন্ন ধরনের হুমকি-ধমকি দিয়ে বাসার মধ্যে অনধিকার প্রবেশ করে ৫০ লাখ টাকা এবং স্বর্ণালংকার দাবি করেন। পরে তাদের দাবি করা টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে তারা তাকে আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যা দিয়ে গ্রেফতার করানোর হুমকি দিয়ে টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে ১০ লাখ টাকা রিয়াদ ও অপুকে দেন। এরপর ২৬ জুলাই বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে রিয়াদের নেতৃত্বে অন্য আসামিরা আবার চাঁদার জন্য বাসার সামনে আসে এবং তাকে খুঁজতে থাকে। বিষয়টি পুলিশকে অবহিত করিলে তাৎক্ষণিক গুলশান থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পাঁচ আসামিদের হাতেনাতে আটক করে।
তাদের শেকড় অনেক গভীরে-উমামা ফাতেমা : সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজির ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। তিনি দাবি করেন-‘এদের শেকড় অনেক গভীরে’। তার এ মন্তব্য মুহূর্তেই ভাইরাল হয়। ফেসবুক পোস্টে উমামা ফাতেমা মন্তব্য করেছেন-‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত পাঁচজনের চাঁদাবাজির খবর শুনে আমার পরিচিত ব্যক্তিবর্গ এতটাই আশ্চর্যান্বিত হওয়ার অভিনয় করছেন যে, আমার মনে হচ্ছে আমিই সব থেকে কম আশ্চর্য হয়েছি। এ ছেলেগুলোকে তো নেতাদের পেছনে প্রটোকল দিতে দেখা গেছে এতদিন যাবৎ। সচিবালয় থেকে শুরু করে মিছিল-মিটিং, মারামারি সব জায়গাতেই সমন্বয়কদের ডান হাত, বাম হাত হিসাবে নির্বিঘ্নে প্রটোকল দিয়ে গেছে। গুলশান-বনানী গ্যাং কালচারের অজস্র অভিযোগ অভ্যন্তরীণভাবে তাদের বিরুদ্ধে ছিল।’ উমামা আরও মন্তব্য করেন-‘রিয়াদ নামের ছেলেটা গত ডিসেম্বরে রূপায়ণ টাওয়ারে আমার সামনে অত্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেছিল। আমরা মেয়েরা তাকে থামানোর চেষ্টা করলে আমাদের ওপর পালটা চড়াও হয়। ওই ঘটনার পর ছেলেটার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি-ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে হুমকি, মারামারি ও চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে। আমি জেনে তখন মোটেও অবাক হইনি, কারণ ততদিনে বৈষম্যবিরোধীতে এ ধরনের মানুষজনের আনাগোনাই সর্বোচ্চ টের পাওয়া যেত। ঠিকই তারা রূপায়ণ টাওয়ারে অবাধে আসা-যাওয়া করত। কারও দুর্নীতি বা অসততার ব্যাপারে অভিযোগ জানালে উত্তরে পিনড্রপ সাইলেন্স উপহার পেতে হবে। আর আমি চোখের সামনে দেখতাম এসব লোকজনই কীভাবে দিন শেষে এক্সেস করে নেয়। আজকে এত মাস পর এ প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকালে বলার ভাষা পাই না কোনো? যে যেভাবে পারছে এ প্ল্যাটফর্মকে নষ্ট করেছে।’
চাঁদাবাজির ঘটনায় সবাই অবাক হওয়ার ভান করছে মন্তব্য করে উমামা ফাতেমা আরও বলেন, ‘আজকের এ চাঁদাবাজির খবর দেখে আশপাশের সবাই এত অবাক হওয়ার ভান করছেন, বিষয়টা কিছুটা হাস্যকর বটে।’ তিনি বলেন, ‘ইশ! মানুষ কত নিষ্পাপ! সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো তারা আবিষ্কার করেছেন-এ ছেলেগুলো আজ কীভাবে চাঁদাবাজি করল? অত্যন্ত দুঃখিত বন্ধুরা, বলতে হবে-এ প্রথম কোনো চাঁদাবাজি করতে গিয়ে তারা পুলিশের হাতে ধরা খেল। ঠিকমতো খোঁজ নিলে বুঝবেন, এদের শেকড় অনেক গভীরে।’
উল্লেখ্য, শনিবার সন্ধ্যায় গুলশানের ৮৩ নম্বর রোডে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য শাম্মী আহমেদের বাসায় চাঁদার টাকা আনতে গিয়ে পাঁচজন গ্রেফতার হয়। এ ঘটনার পর শনিবার গভীর রাতে সংগঠন থেকে পাঁচজনের মধ্যে চারজনকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সুলাইমান নামে ছাত্র প্রতিনিধির অস্তিত্ব নেই-স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আব্দুর রাজ্জাক বিন সুলাইমান (রিয়াদ) নামে কোনো ছাত্র প্রতিনিধির অস্তিত্ব নেই বলে দাবি করেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। রোববার মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা (পরিচালক) ফয়সল হাসানের স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি করা হয়।
এতে বলা হয়, চাঁদাবাজি করতে গিয়ে আটক আব্দুর রাজ্জাক বিন সুলাইমান (রিয়াদ) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছাত্র প্রতিনিধি শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নজরে এসেছে। সংবাদটি সর্বৈব মিথ্যা এবং এর কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আব্দুর রাজ্জাক বিন সুলাইমান (রিয়াদ) নামে কোনো ছাত্র প্রতিনিধি বা কোনো ধরনের প্রতিনিধির অস্তিত্ব নেই। মন্ত্রণালয়ের নাম ব্যবহার করে কেউ কোনো অপরাধ বা রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হলে- তার দায়ভার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বহন করবে। এর সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তবে একই সঙ্গে গণমাধ্যমের নিকট দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করে। ভবিষ্যতে এ ধরনের সংবাদ প্রকাশ করার আগে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে যাচাই-বাছাই এবং আরও দায়িত্বশীল ও সতর্ক হওয়ার জন্য গণমাধ্যমসমূহকে অনুরোধ করা যাচ্ছে।
