ট্রাইব্যুনালে ‘রাজসাক্ষী’ মামুন
আইজিপির মেয়াদ বৃদ্ধিতে আগ্রহী ছিলাম না
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে জেরা করেছেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন।
জবাবে মামুন বলেছেন, ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্রিক যে সব পদক সরকার দিয়েছিল, সেই পদক তিনিও পেয়েছিলেন। আমাকে দেওয়া পদকটি ২০১৮ সালের নির্বাচনের কারণে কিনা, তা এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলন দমনে নির্দেশনা দেওয়া বৈধ ছিল, তবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে কাউকে গুলি করে হত্যা করা বৈধ নয়। অপর প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ছাত্রদের আন্দোলন বৈধ ছিল। বৈধ জেনেও সরকারি দায়িত্ব পালনে তাদের বিরোধিতা করতে হয়েছে।
মামুন বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে যখন দ্বিতীয়বারের মতো আইজিপি হিসাবে আমার মেয়াদ বাড়ানো হলো তাতে আমি আগ্রহী ছিলাম না। এটা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবকে জানিয়েছিলাম। বৃহস্পতিবার ট্রাইব্যুনাল-১-এ চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন জেরার জবাবে এসব কথা বলেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগে করা মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনও আসামি। মামুন এই মামলায় দোষ স্বীকার করে ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হয়েছেন। মঙ্গলবার তিনি এই মামলার ৩৬তম সাক্ষী হিসাবে জবানবন্দি দেন। বুধবার তাকে জেরা করা হয়।
বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে এগারোটা থেকে বিকাল পৌনে পাঁচটা পর্যন্ত তার জেরা রেকর্ড করা হয়। মাঝখানে এক ঘণ্টার বিরতি দেওয়া হয়। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের প্যানেলে জেরা রেকর্ড করা হয়। ট্রাইব্যুনালের বাকি দুই সদস্য হলেন-বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। আগামী সোমবার পর্যন্ত এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ মুলতবি করেন ট্রাইব্যুনাল।
জেরায় আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, সে সময় গোপালগঞ্জকেন্দ্রিক গ্রুপিংয়ের কারণে আইজিপি হিসাবে তার মেয়াদ বৃদ্ধি হওয়ার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন, যা অসত্য। জবাবে মামুন বলেছেন, তিনি জবানবন্দিতে এ বিষয়ে সত্য কথা বলেছেন। আমির হোসেন বলেন, গোপালগঞ্জকেন্দ্রিক গ্রুপিংয়ের জন্য নয়, তিনি তদবির করে নিজের স্বার্থে এক্সটেনশন নিয়েছেন।
আমির হোসেন বলেন, “এক্সটেনশন নেওয়ার সময় ‘না’ করেছেন?” জবাবে মামুন বলেন, তিনি প্রথম এক্সটেনশনে রাজি হয়েছিলেন। তবে দ্বিতীয়বার এক্সটেনশনের সময় তিনি আগ্রহী ছিলেন না। আমির হোসেন প্রশ্ন করেন, তিনি যে আগ্রহী ছিলেন না, এ কথা কাকে বলেছেন? জবাবে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবকে তার অনাগ্রহের কথা মৌখিকভাবে জানান।
আমির হোসেন বলেন, এ কথা তিনি মিথ্যা বললেন। মামুন বলেন, তিনি সত্য বলেছেন। ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আইজিপির দায়িত্ব নেন মামুন। ২০২৩ সালের ১১ জানুয়ারি তার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। ২০২৩ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ১১ জুলাই পর্যন্ত তাকে চুক্তিভিত্তিক আইজিপি নিয়োগ দেয় তৎকালীন সরকার। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে তার মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়েছিল।
জেরায় মামুন বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে আইজিপি থাকা অবস্থায় সে সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ধানমন্ডির বাসায় রাত্রীকালীন বৈঠকে তিনি থাকতেন না। তাকে ওই বৈঠক সম্পর্কে কোনো তথ্য জানানো হতো না, কারণ এসব বৈঠক ছিল ‘ইনফরমাল‘ বৈঠক।
তিনি বলেন, আমার অধস্তন যে সব অফিসার ওইসব বৈঠকে অংশগ্রহণ করত তাদের আমি নিবৃত করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা আমার কথা মানেননি। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেইনি, কারণ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নেতৃত্বেই এসব বৈঠক হয়েছে।
মামুন বলেন, বন্দিশালা (টিএফআই) সেলে থাকা ব্যারিস্টার আরমানের বিষয়টি আইনি সমাধানের চেষ্টা করেছি। দায়িত্বে অবহেলা করেছি, এ কারণেই দোষ স্বীকার করেছি। উক্ত অপরাধ হওয়ার পরেও আমি পদত্যাগ করিনি। তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় যেসব বৈঠক হতো প্রথম দিকে গুলি করার কোনো নির্দেশনা ছিল না, তবে পরবর্তীতে গুলির নির্দেশনা আসতে থাকে। পুলিশ বলপ্রয়োগ কখন করে?
এমন জেরার জবাবে মামুন বলেন, যখন পুলিশ আক্রান্ত হয়, সেই আক্রান্তের মাত্রা বা আনুপাত দেখে বল প্রয়োগ করা হয়। তিনি বলেন, স্নাইপার অস্ত্রটি পুলিশে নতুন এসেছে। আমি আইজিপি হওয়ার আগেই এসেছে। এটা ‘সোয়াত’ টিমকে দেওয়া হয়েছিল। আমার জানা মতে জুলাই আন্দোলনে এই অস্ত্রটি ব্যবহার হয়নি। তিনি বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল হেলিকপ্টার, ড্রোন বা লেথাল উইপন (মরণাস্ত্র) ব্যবহারের নির্দেশ দেয়নি, এটা সত্য নয়। এসব ব্যবহারের কোনো লিখিত নির্দেশ আমি পাইনি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি জুলাই আন্দোলনে সংঘটিত অপরাধের অংশীদার।
আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট চেয়েছিলেন সালমান এফ রহমান : প্রথম দফা জেরা শেষে পুনরায় জবানবন্দি দেন সাবেক আইজিপি মামুন। পরে ট্রাইব্যুনাল অনুমতি দিলে তিনি জবানবন্দি পেশ করেন। জবানবন্দিতে মামুন বলেন, বেরোবির ছাত্র আবু সাঈদ নিহত হওয়ার পর তার ময়নাতদন্ত রিপোর্ট চেয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।
সালমান রহমান ফোনে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট বিলম্বের কারণ জানতে চান। আমি রংপুর পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। পুলিশ কমিশনার আমাকে জানান, যথাযথ কর্তৃপক্ষ ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রদানে বিলম্ব করছে। তবে এর স্বপক্ষে কোনো দালিলিক সাক্ষ্য ট্রাইব্যুনালে দেখাতে পারেননি সাক্ষী মামুন। ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। সঙ্গে ছিলেন বিএম সুলতান মাহমুদ, প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, মঈনুল করিম, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্যরা।
অনেক কিছুর ক্ষমা হয়, তবে হত্যা মামলার ক্ষমা হয় না: সাবেক আইজিপি মামুনকে জেরার প্রথমার্ধ শেষে আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, সাবেক আইজিপি মামুন যদি হত্যা করেই থাকেন কিংবা স্বীকার করেন; তাহলে তারও বিচার হওয়া উচিত। বর্তমানে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করছেন চৌধুরী মামুন। কিন্তু আমি জেরার মাধ্যমে আনার চেষ্টা করছি তিনি নির্দোষ নন।
এ ছাড়া, তিনি যাদের অপরাধী ভাবছেন; আমি মনে করি তারা কোনো অপরাধ করেননি। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এই আইনজীবী বলেন, আমার মক্কেল তথা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল কোনো অপরাধ কিংবা কোনো হত্যার সঙ্গে জড়িত নন। এ ছাড়া, তারা কোনো নির্দেশও দেননি।
