জুয়ার বিজ্ঞাপনে সয়লাব সামাজিক মাধ্যম তরুণরা পড়ছে প্রতারণার ফাঁদে
কৌতূহল থেকে আকৃষ্ট হন অনেকেই
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতিতে বদলেছে বিনোদন ও খেলাধুলার সংজ্ঞা। এখন অনলাইনেই কেনাকাটা, পড়ালেখা এমনকি বিনোদনও খুঁজে নিচ্ছেন সবাই। যাতে আবার জুয়ার আসরও জমজমাট। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিকমাধ্যম প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে জুয়ার আসর সরগরম হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
এক সময়ে তাসের মাধ্যমে জুয়া খেলাকে অপরাধ বলে গণ্য করা হতো, তা থেকে হাউজি, লাইভ ক্যাসিনো হয়ে এখন ঘরে বসেই মিলছে জুয়ার আসর। হাতে কেবল একটা মোবাইল ফোন থাকলেই হলো।
অনলাইন জুয়ার ফাঁদে পড়ে দিনে দিনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বহু মেধাবী ছেলেমেয়ে। ওই জুয়ার ‘স্টেক’ ধরার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে কেউ বাবার পকেট কাটছে, কেউ মায়ের গহনা ধরে টান দিচ্ছে; কেউ আবার চুরি-ডাকাতি-ছিনতাইয়ের পথ ধরছে।
এসব অনলাইন জুয়ার অ্যাপসে টাকা ভরার জন্য শহর থেকে মফস্বলে রীতিমতো ‘এজেন্ট’ নিয়োগ করা হচ্ছে। খেলার প্রতিযোগিতার মতো তরুণ-কিশোররা এসব অনলাইন জুয়ায় ভয়াবহ মাত্রায় জড়িয়ে পড়ছে। যদিও অনলাইনে জুয়া খেলে (বেটিং) জেতে খুব নগণ্য সংখ্যকই; হারেই বেশি মানুষ। অনলাইন জুয়াকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ও খুনের ঘটনাও ঘটছে। কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না অনলাইন জুয়া। এক ধরনের কৌতূহল থেকে তরুণ প্রজন্ম আকৃষ্ট হচ্ছে বিভিন্ন জুয়ার সাইটে। পাঁচ-দশ হাজার টাকা বিনিয়োগ দিয়ে শুরু করে লোভে পড়ে একপর্যায়ে হারাচ্ছে লাখ লাখ টাকা। জুয়ার এসব সাইটের অধিকাংশই পরিচালনা করা হচ্ছে বিদেশ থেকে। আর দেশে এসব সাইট পরিচালনা করছে বাংলাদেশের এজেন্টরা। স্মার্টফোনের এক ক্লিকে অনেকে পৌঁছে যাচ্ছেন জুয়ার রাজ্যে। রয়েছে নানান ধরনের প্রলোভন।
ফেসবুকে জুয়ার বিজ্ঞাপন মডেল সেলিব্রিটিরা : সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের টার্গেট করে জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে বাংলায়। অনলাইন এসব অ্যাপ ইনস্টলের জন্যও দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন অফার। এমনকি বিজ্ঞাপনে দেশের অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের ছবিও ব্যবহার করা হচ্ছে কখনো। এ ছাড়া ফেসবুকে পেজ, আইডি ও চ্যানেলে লাইক বা সাবস্ক্রাইব করা না থাকলেও এসব কনটেন্ট সামনে চলে আসে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ও আগ্রহের ধরন বুঝে সাইটগুলো একই ধরনের পোস্ট ব্যবহারকারীদের সামনে আনছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অসাধু চক্র জুয়ায় উদ্বুদ্ধ করছে তরুণদের।
খবর পেলে তাৎক্ষণিক বন্ধ করা হয় জুয়ার সাইট
ইতোমধ্যে ছয় হাজার জুয়ার সাইট বন্ধ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। তিনি বলেন, সমস্যা হলো এগুলো খুঁজে পাওয়াটা একটু কঠিন। লিঙ্ক পেলে আমরা তা বন্ধ করতে পারি। যেদিন যে লিঙ্ক পাব, সেদিন তা বন্ধ করব। আমাদের যারা লিঙ্কগুলো মনিটর করেন তারা হয়তো সব লিঙ্ক দিতে পারেন না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় হলে ধরা সম্ভব।
জুয়ার সাইট বন্ধ করেও মিলছে না সমাধান। ২০১৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) এক বিজ্ঞপ্তিতে অনলাইনে জুয়া খেলার ১৭৬টি সাইট বন্ধ করার কথা বলা হয়। ২০২২ সালের ১০ অক্টোবর ৩৩১টি অনলাইন জুয়ার সাইট বন্ধ করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা সেল’। সেলটির নিয়মিত নজরদারির অংশ হিসাবে এসব অবৈধ সাইট বন্ধ করা হয়।
অ্যাপসও বন্ধ করা হচ্ছে : গুগল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে অনলাইন জুয়া বা বাজিসংক্রান্ত ১৫০টি গুগল অ্যাপস বন্ধের জন্য রিপোর্ট করা হলে এরই মধ্যে গুগল কর্তৃপক্ষ প্লে স্টোর থেকে ১৪টি অ্যাপ বন্ধ করেছে এবং অবশিষ্ট অ্যাপস বন্ধের জন্য যাচাই-বাছাইসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে।
একইসঙ্গে ফেসবুক ও ইউটিউবের মাধ্যমে জুয়া খেলার ওয়েবসাইট ও গুগল অ্যাপসের প্রচার এবং অনলাইন জুয়াসংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেওয়ায় এ ধরনের ২৭টি ফেসবুক লিঙ্ক ও ৬৯টি ইউটিউব লিঙ্ক বন্ধের জন্য রিপোর্ট করা হয়। এর মধ্যে ১৭টি ফেসবুক লিঙ্ক ও ১৭টি ইউটিউব লিঙ্ক বন্ধ করা হয়েছে। অবশিষ্ট লিঙ্ক বন্ধের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
যা বলছেন জুয়াড়িরা : অনলাইনে জুয়া খেলেন এমন কয়েকজন কথা বলেন যুগান্তরের সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, দেশে এ মুহূর্তে সবচেয়ে জনপ্রিয় অনলাইন জুয়ার সাইট ওয়ানএক্সবেট (1xbet)। এ ছাড়া বেটউইনার, বেট৩৬৫, মেলবেট, প্যারিম্যাচ সাইটও বেশ জনপ্রিয়। এগুলোর বিজ্ঞাপন নিয়মিত দেওয়া হয় ফেসবুকে, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবসহ অন্য সামাজিক মাধ্যমে। দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত এ সাইটগুলোতে ফুটবল, ক্রিকেটসহ বিভিন্ন খেলা নিয়ে বাজি ধরা যায়। ক্রিকেটে প্রতি বলে বলে, ম্যাচের প্রথম ওভারের প্রথম বলে, প্রতি ওভারে, প্রতি ম্যাচের প্রথম ছয় ওভার, পরবর্তী ওভারে উইকেট যাবে কিনা ও কোন দল জিতবে এমন করে জুয়ার ক্যাটাগরি সাজানো। এখান থেকেই উৎসাহিত হয়ে জুয়ায় আসক্ত হয় দেশের লাখো তরুণ।
গ্রেফতার হলেও থামছে না : আটক হচ্ছেন জুয়াড়িরা, তবুও থামছে না এ খেলা। চলতি বছরের এপ্রিলে রাজশাহী থেকে অনলাইন জুয়া প্ল্যাটফরমের পাঁচ সদস্যকে আটক করেছে অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের (এটিইউ) একটি দল। এ সময়ে তাদের কাছ থেকে ৯টি মুঠোফোন, একটি সিঙ্গার অ্যান্ড্রয়েড টিভি, একটি রাউটার, একটি ডায়েরি এবং একটি মিনি প্যাড ও এক লাখ ১৭ হাজার ২০০ টাকা জব্দ করেছে এটিইউ। আটককৃতরা সংঘবদ্ধ বিভিন্ন অনলাইন জুয়া সাইট এবং অনলাইন জুয়া অ্যাপ ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে অনলাইন ক্যাসিনো জুয়া খেলার প্রলোভন দেখিয়ে এবং অনলাইনে জুয়া খেলায় উদ্বুদ্ধ করে মোবাইল ব্যাংকিং (নগদ/বিকাশ/রকেট) ব্যবহার করে অবৈধ ই-ট্রানজেকশন এবং লেনদেনের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা অবৈধভাবে হাতিয়ে নিচ্ছিল।
প্রয়োজন সচেতনতা : বিশেষজ্ঞদের মতে, এ জাতীয় জুয়ার সাইটগুলো নির্ণয় করার জন্য ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স খুব প্রয়োজন। এ ছাড়া বেশি করে সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার, (সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন) নাজমুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, অনলাইন জুয়া বর্তমানে সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির সহজ লভ্যতার কারণে এটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা সাইবার পুলিশ এ বিষয়ে কাজ করছি। ইতোমধ্যে আমরা কমপক্ষে ত্রিশটিরও বেশি ঘটনায় প্রায় ৪০ জনকে গ্রেফতারও করেছি এবং তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন সরঞ্জামাদি বিশেষ করে এ কাজে ব্যবহৃত ল্যাপটপ, ডিভাইস, রাউটার জব্দ করেছি। সরকারের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশ এটি নিয়ে কাজ করছে। তবে এ জুয়ার বিষয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যেটি তা হলো, সচেতনতা। পুলিশ তো অ্যাকশন নিচ্ছেই, পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা খুব জরুরি। সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায় থেকে এগিয়ে আসতে হবে।

