যেখানে ভাবনা বদলায় বাস্তবতায়
বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক ইনোভেশন হাব
মনজূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার
প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
এক সময় চায়ের দোকানে বসে নিজের স্টার্টআপ আইডিয়া নিয়ে কথা বললে তির্যক হাসি বা ঠাট্টা শুনতে হতো। সেই চিত্র এখন বদলে যাচ্ছে। তরুণরা আজ শুধু ভাবছেই না, ভাবনাকে রূপ দিচ্ছে বাস্তবে, আর এ বাস্তবতার মঞ্চ হয়ে উঠেছে ইউনিভার্সিটি ইনোভেশন হাব।
সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীন বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ‘ডিজিটাল উদ্যোক্তা এবং উদ্ভাবন ইকোসিস্টেম উন্নয়ন প্রকল্পের (DEIED)’ আওতায় দেশের দশটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এ ইনোভেশন হাবগুলো। এগুলো শুধু কাজ করার জায়গা নয়, এগুলো হচ্ছে তরুণদের চিন্তা ও উদ্ভাবনের ল্যাবরেটরি, যেখানে থার্মোমিটার বা টেস্ট টিউবের বদলে আছে ল্যাপটপ, ৩ডি প্রিন্টার, কাটিং মেশিন আর অন্তহীন কল্পনা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রুয়েট, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই হাবগুলো চালু হয়েছে।
প্রতিটি হাবে তরুণদের উদ্ভাবনী ধারণাকে ব্যবসায় রূপ দিতে ১৪ সপ্তাহব্যাপী একটি কাঠামোবদ্ধ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এতে অংশ নেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা দলগতভাবে আবেদন করে। যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে সম্ভাবনাময় দলগুলোকে নির্বাচন করা হয়। তারা প্রশিক্ষণ পায় ব্যবসায়িক পরিকল্পনা, বাজার বিশ্লেষণ, ব্র্যান্ডিং, প্রোটোটাইপ তৈরি ও উপস্থাপন দক্ষতার ওপর। প্রতিটি কোহর্টে নির্দিষ্ট সময় ধরে মেন্টরিং, ওয়ার্কশপ ও প্রজেক্ট ডেভেলপমেন্টের মধ্য দিয়ে দলগুলো তাদের ধারণাকে রূপ দিতে শেখে।
এ পর্যন্ত ৩০টি কোহর্ট সম্পন্ন হয়েছে, অংশ নিয়েছে ৩৫৬টি দল এবং ১৪৭০ জন শিক্ষার্থী। বর্তমানে আরও ২১টি কোহর্টে ১০৮৩ জন শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে। প্রকল্প মেয়াদ শেষে ৬০টি কোহর্টে প্রায় ৩০০০ জন তরুণ এ ইনোভেশন হাব কার্যক্রমে যুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রশিক্ষণের শেষ ধাপে শিক্ষার্থীরা তাদের উদ্ভাবিত প্রোটোটাইপ উপস্থাপন করে জুরি বোর্ডের সামনে। বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রি-সিড মানি দেওয়া হয় নির্বাচিত দলগুলোকে। যেসব টিম আরও পরিণত হতে চায়, তাদের জন্য আছে অতিরিক্ত কাউন্সেলিং ও পরামর্শ সুবিধা। এরপর চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় বিজয়ী দলগুলো পায় সিড মানি, যা দিয়ে তারা বাজারে প্রবেশের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করে।
উদ্যোগটি শুধু ফান্ডিং বা প্রশিক্ষণেই সীমাবদ্ধ নয়। এখানে রয়েছে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি অবকাঠামোও। ইনোভেশন হাবে আছে আধুনিক ডিজিটাল বোর্ড, প্রেজেন্টেশন থিয়েটার, ভিডিও রেকর্ডিং সুবিধা, থ্রিডি প্রিন্টিং কক্ষ, লেজার কাটিং ও এনগ্রেভিং মেশিন, আর রয়েছে ফ্যাব্রিকেশন ল্যাব যেখানে তৈরি হচ্ছে ড্রোন, ভিআর গিয়ারস কিংবা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি।
তরুণরা এখানে কাজ করছে কৃষি, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, স্মার্ট ট্রাফিক, পরিবেশ বান্ধব যানবাহনসহ শতাধিক উদ্ভাবনী প্রকল্পে। একজন ছাত্র যে এখনো ক্লাস করছে, সেই একই সময়ে তার হাতে গড়ে উঠছে একটি সম্ভাবনাময় স্টার্টআপ। এখানকার লাইব্রেরি প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতি, ব্যবসা, উদ্ভাবন ও স্টার্টআপ নিয়ে বইয়ে ঠাসা-যেখানে প্রযুক্তি আর ব্যবসার ভবিষ্যৎ পথনির্দেশনা খুঁজে পাওয়া যায়।
এ ইনোভেশন হাবে ঢুকলেই যেন কল্পনার চোখে ভবিষ্যৎ দেখতে পাওয়া যায়। কাচেঘেরা একটা কক্ষ, যেখানে থ্রিডি প্রিন্টিং হচ্ছে নিঃশব্দে। পাশেই কাটিং ও এনগ্রেভিং মেশিনে তরুণেরা তৈরি করছে তাদের নিজস্ব উদ্ভাবন, কখনো ড্রোনের খুচরা যন্ত্রাংশ, কখনোবা ভিআর গিয়ারস। পুরো জায়গাটা যেন এক মায়াবী জাদুঘর, যেখানে বস্তু নেই চিন্তাই আসল সম্পদ।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এখানে তরুণরা শিখছে নিজেকে তৈরি করতে, নিজের চিন্তাকে পণ্য বা সেবায় রূপান্তরের প্রক্রিয়াগুলো আত্মস্থ করছে। একজন তরুণ যদি স্বাস্থ্যসেবাকে সহজলভ্য করতে চায়, সে তার পরিকল্পনার জন্য প্রয়োজনীয় টেক ও বিজনেস মডেল সহায়তা এখানেই পাচ্ছে। কারও যদি চিন্তা থাকে কৃষিতে ড্রোন ব্যবহারের, তাও এখানে বাস্তবায়নের সুযোগ পাচ্ছে।
সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পখাতের সম্মিলিত উদ্যোগে গড়ে তোলা এ ইনোভেশন হাবগুলো হচ্ছে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের সূতিকাগার। যেখানে তরুণদের হাতে শুধু ডিগ্রি নয়, যুক্ত হচ্ছে কোডিং, মেকানিক্স, সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার, ব্যবসা পরিকল্পনা এবং নেতৃত্ব গড়ার অনুশীলন।
এ ইনোভেশন হাবগুলোর মাধ্যমে গড়ে উঠছে দেশের একটি শক্তিশালী উদ্ভাবন ও স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম, যা ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতিকে প্রযুক্তিনির্ভর ও উদ্যোক্তাকেন্দ্রিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে। এখানে প্রতিটি চিন্তা, প্রতিটি প্রয়াসই এক একটি পরিবর্তনের বীজ। এবং এ বীজ থেকেই একদিন জন্ম নেবে বিশ্বমঞ্চে নেতৃত্ব দেওয়া একেকটি বাংলা স্টার্টআপ।
লেখক : প্রকল্প পরিচালক, ডিজিটাল উদ্যোক্তা ও উদ্ভাবন ইকো সিস্টেম উন্নয়ন প্রকল্প
