Logo
Logo
×

২১ বছরে যুগান্তর

সংস্কৃতি অন্তপ্রাণ আমাদের বঙ্গবন্ধু

Icon

মিলন কান্তি দে

প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০২০, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য মুগ্ধ করেছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বাংলা ও বাঙালির জন্য তিনি যেমন আমরণ যুদ্ধ করে গেছেন, তেমনি এ দেশ ও মাটির মূল সংস্কৃতিকেও তিনি ধারণ করেছেন মনে-প্রাণে। বাংলাকে ভালোবেসেই তিনি বাঙালিকে ভালোবেসেছেন। এক কথায় তিনি ছিলেন আপাদমস্তক এক সংস্কৃতি অন্তঃপ্রাণ ব্যক্তিত্ব।

সাংগঠনিক সফরে যাওয়ার সময় মাঝেমধ্যে তিনি দু’একজন গানের শিল্পী নিয়ে যেতেন। একবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে যান কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী আব্বাস উদ্দিন, সোহ্রাব হোসেন ও বেদার উদ্দিনকে সফরসঙ্গী করে। সেই স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘পরের দিন নৌকায় আমরা রওনা করলাম, আশুগঞ্জ স্টেশনে ট্রেন ধরতে। পথে পথে গান চলল। নদীতে বসে আব্বাস উদ্দিনের ভাটিয়ালি গান তার নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলোও যেন তার গান শুনছে।... আমি আব্বাস উদ্দিন সাহেবের একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ: ১১১)।’ বাংলার মেঠো সুরে গাওয়া গানগুলোর প্রতি তার একটা প্রচণ্ড আকর্ষণ ছিল। এসব গানের আসরে প্রসঙ্গক্রমে রাজনীতির কথাও উঠে আসত। যেমন ওইদিন আব্বাস উদ্দিন বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন- ‘মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালোবাস, এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।’ অবশ্য এর আগেই ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সেই প্রথম আন্দোলন-সংগ্রামের সময় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলা পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ লোকের মাতৃভাষা। তাই বাংলাই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। তবুও আমরা বাংলা ও উর্দু দুটি রাষ্ট্রভাষার দাবি তুলেছি (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ: ৯৮)।’

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত এ দেশের নাম ছিল পূর্ব বাংলা। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় পূর্ব পাকিস্তান। নাম পরিবর্তনের যে চক্রান্ত চলছিল, এটা আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর তাই ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট করাচিতে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি জোর গলায় বলেছিলেন, ‘মাননীয় স্পিকার, আমাদের পূর্ব বাংলাকে ওরা পূর্ব পাকিস্তান বানানোর পাঁয়তারা করছে। আমরা বহুবার বলেছি, দেশটাকে আপনারা বাংলা নামেই ডাকেন।’ বঙ্গবন্ধুর কাছে খুবই প্রিয় মিষ্টি নাম ছিল বাংলা। তিনি জানতেন, হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ঘিরে মধুমাখা বাংলা শব্দটি আপামর বাঙালি জনগণের কাছে কতখানি আবেদনময়। এ সংস্কৃতি তাকে জুগিয়েছে সংগ্রামের প্রেরণা। রাজনীতির ঝড়ো হাওয়ার মধ্যেও দেশজ সংস্কৃতি নিয়ে ভাবতেন তিনি। সংস্কৃতির বিকাশ ও উন্নয়নে কী করা যায়, তা নিয়ে বিশিষ্টজনদের সঙ্গে আলোচনাও চালিয়ে যেতেন।

তার এ নান্দনিক ভাবনার প্রকাশ আমরা দেখি ১৯৫৭ সালে জাতীয় সংসদে ‘চলচ্চিত্র সংসদ বিল’ উত্থাপনের মধ্য দিয়ে। সে সময় তিনি শিল্পমন্ত্রী। তারই উদ্যোগে ও প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন এফডিসি। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে, ১৯৭৪ সালে জাতীয় সংসদে বিল পাসের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। একই বছরে তিনি বাংলা একাডেমি আয়োজিত প্রথম আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের উদ্যোগকে স্বাগত জানান এবং আন্তরিকতার সঙ্গে আয়োজনের অনুমোদন দেন। ১৯৭৫ সালে তিনি নাটকের ওপর প্রমোদকর রহিত করেন। এ প্রসঙ্গে রামেন্দু মজুমদার লিখেছেন, ১৯৭৫ সালের মে মাসে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা টেলিভিশনের রামপুরা কেন্দ্র পরিদর্শনে আসেন। সেখানে বিশিষ্ট নাট্যকার-অভিনেতা ও টিভিকর্মী আবদুল্লাহ আল মামুনকে দেখে নাটকের খবর জানতে চান। মামুন যখন ঠাট্টা করে তাকে বলেন, তিনি সব নাটক বন্ধ করে দিয়েছেন। তখন তিনি ব্যাপারটা জেনে বিস্মিত হন ও পরদিনই তার সঙ্গে দেখা করার নির্দেশ দেন। ঠিক পরদিনই মামুন এবং আমি (রামেন্দু মজুমদার) গণভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি এবং বিস্তারিতভাবে সমস্যার কথা বলি। তিনি তখনই তার একান্ত সচিব ড. ফরাস উদ্দিনকে ডেকে একটি নির্দেশ তৈরি করার জন্য বললেন। আমলাতন্ত্রের দৌরাত্ম্যের কথা তিনি জানতেন। তার উল্লেখ করে তিনি বললেন, মন্ত্রণালয়ে পাঠালে অনেক দেরি হবে। তাই রাষ্ট্রপতির আদেশেই জারি করো। ২৮-০৫-৭৫ তারিখে এ মর্মে একটি নির্দেশ জারি করা হয় যে এখন থেকে পুলিশের পরিবর্তে সেন্সর কমিটি নাটকের পাণ্ডুলিপি সেন্সর করবে এবং নাটকের ওপর কোনো প্রমোদকর প্রযোজ্য হবে না (বিষয় : নাটক, পৃ: ৪৬-৪৭)।’ কতখানি উদারমনা সংস্কৃতি ও নাট্য অন্তঃপ্রাণ ব্যক্তি হলে মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে নিজেই রাষ্ট্রপতির আদেশ জারি করতে পারেন, এ ঘটনায় তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তার এ নাট্যপ্রীতি আমাদের সংস্কৃতি ইতিহাসে স্মরণীয় ও দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সাহিত্য ও শিল্পরসিক। সেজন্য তার দরবারে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী সমাজের লোকজনের আসা-যাওয়া ছিল প্রায়ই। একটু অবসর পেলেই কবিতা আবৃত্তি করতেন। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ-জসীমউদ্দীন ছিলেন তার প্রিয় কবি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার পর তিনি বিভিন্ন বাধা অতিক্রম করে একটি বড় ধরনের কাজ করলেন। সেটি হল পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা এবং তাকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়া। কবিকে যখন বাংলাদেশে আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তখন দু’একজন বঙ্গবন্ধুর অগোচরে এটিকে অসম্ভব বলে মনে করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর জীবনে অসম্ভব বলে কোনো শব্দ ছিল না। সেটাই আবার প্রমাণ করে দেখালেন, বিদ্রোহী কবিকে নিয়ে আসার পর।

ঐতিহ্যবাহী যাত্রাশিল্পের প্রতি ছিল তার অকৃত্রিম ভালোবাসা। এ আগ্রহ ও কৌতূহল দেখা যায় কিশোর বয়স থেকেই। তার জীবনী পড়ে জানা যায়, নিজের গ্রাম টুঙ্গিপাড়া কিংবা আশপাশের কোনো পাড়াগাঁয়ে, নদীরপাড়ে যাত্রাগান হলে বন্ধুবান্ধব নিয়ে হইচই করতে করতে যাত্রাপ্যান্ডেলে ঢুকে পড়তেন। একবার এক ঘটনা ঘটেছিল- সম্ভবত ১৯৩৮ সালের দিকে হবে। মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এবং নেতাজী হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীসহ বেশকিছু নেতা আসছেন গোপালগঞ্জে। তারা স্থানীয় স্টুডেন্স মুসলিম লীগ উদ্বোধন করবেন। তাদের সম্মানার্থে এক কৃষিমেলার আয়োজন হবে গোপালগঞ্জে। এ উপলক্ষে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীও গঠন করা হল এবং সবার সমর্থনে কমিটির আহ্বায়ক হলেন আমাদের খোকা- অর্থাৎ কিশোর মুজিব। মেলা সাজানো হল রং-বেরঙের বিভিন্ন পোস্টার, ব্যানার ও নানা ধরনের স্টল দিয়ে। একজন বলল চিত্তবিনোদনের জন্য কী কী আইটেম থাকতে পারে। বঙ্গবন্ধু উত্তরে বললেন, নাগরদোলা, পুতুল নাচ, সার্কাস এবং অবশ্যই যাত্রা প্রদর্শনী। সেবার বরিশাল থেকে যাত্রাদল বায়না করে আনা হয়েছিল। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, আমার কাছে তখন হিন্দু-মুসলমান বলে কোনো জিনিস ছিল না। হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল। একসঙ্গে গান বাজনা, খেলাধুলা, বেড়ানো ইত্যাদি (পৃ: ১১)। ‘এক সঙ্গে গান বাজনা’ বলতে তিনি গ্রাম-বাংলার বিভিন্ন বিনোদন-পালাগান কিংবা যাত্রাগানের কথাই উল্লেখ করে থাকবেন।

১৯৬৯ সালের একটি অবিস্মরণীয় ঘটনার কথা এখনও আমার মনে পড়ে। সেপ্টেম্বর মাস (কয়েক মাস আগে তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হন), চট্টগ্রামের মুসলিম ইন্সটিটিউট হলে বঙ্গবন্ধু আসছেন বক্তৃতা করতে। সভা শেষে জানতে পারলেন খুব কাছেই জেএম সেন হলের মাঠে যাত্রা হচ্ছে। সফর সঙ্গীদের বললেন চল যাই, একটু যাত্রা দেখে আসি। জেএম সেন হলে তখন যাত্রাগানের আয়োজন করেছে চট্টগ্রামেরই দল বাবুল অপেরা। আমি তখন এ দলে কাজ করছি। বঙ্গবন্ধু সোজা চলে এলেন গ্রিনরুমে। মনে পড়ে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তখন চট্টগ্রামের জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরীও ছিলেন। যাই হোক বঙ্গবন্ধু কিছুক্ষণ যাত্রা দেখলেন। তারপর অমলেন্দু বিশ্বাসের পিঠ চাপড়ে বললেন, অনেকদিন পর যাত্রা দেখলামরে। তোরাইতো খাঁটি শিল্পী। তোরাই তো বাংলার সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছিস।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স মাঠে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ শোনার সুযোগ হয়েছিল আমাদের। সেই সময় আমরা বাবুল অপেরার শিল্পীরা যাত্রানুষ্ঠান করছি গাইবান্ধা জেলার ভরতখালি রেলস্টেশন বাজারে। পরদিন ৮ মার্চ রেডিওতে বজ কণ্ঠের ওই ভাষণটি শোনার পর আমাদের দেহে-মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছিল। সন্ধ্যায় আমরা যাত্রামঞ্চে গণসঙ্গীতের আয়োজন করি। নায়িকা মঞ্জুশ্রী মুখার্জী বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানিয়ে গেয়েছিলেন- ‘ধন্য বাংলা হে বিজয়ী বীর, ধরিয়া তোমায় বক্ষে/কত যে সাজালো কুসুম অর্ঘ্য তোমার চরণ লক্ষ্যে।’ গাইবান্ধার ভরতখালি থেকে শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে যাত্রাশিল্পীদের মিটিং, মিছিল ও অন্যান্য কর্মসূচি।

যুদ্ধ তুফান শেষ হল। পাকিস্তানের লৌহ কারাপ্রাচীর থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশে ফিরে এলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে যাত্রাশিল্পীরাও গেয়ে উঠল: ‘বঙ্গবন্ধুর আগমন শুভেচ্ছা স্বাগতম, শেখ শেখ শেখ মুজিব, লও লও লও সালাম।’ যাত্রাদলের মালিক-শিল্পীদের মধ্যে একটা প্রশ্নই তখন ঘুরপাক খাচ্ছে। কী হবে এখন যাত্রাশিল্পের! ২৩টি বছর অবরুদ্ধ বৈরী পরিবেশে যাত্রা করেছি। কুখ্যাত মোনায়েম সরকার একবার যাত্রামঞ্চে মহিলা শিল্পীদের অংশগ্রহণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, আরেকবার কয়েকটি দেশাত্মবোধক পালা মঞ্চায়ন নিষিদ্ধ করেছিল। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে এ শিল্পের ওপর সরকারের মনোভাবই বা কী রকম হবে- এমন সব ভাবনায় অস্থির ও উদ্বিগ্ন যাত্রাশিল্পীরা। অতঃপর স্বস্তির বাতাস বয়ে গেল। আমাদের সব দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা অমূলক প্রতিপন্ন হল। বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের শাসনামলের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৭২ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত একদিনের জন্যও কোথাও যাত্রা প্রদর্শনী বন্ধ থাকেনি। কোনো যাত্রাদলের মালিক বলতে পারবেন না যে ওই সময়ে ডিসি অফিসে কোনো আবেদন দিয়ে তারা হতাশ হয়েছেন। বরং এমন ঘটনাও ঘটেছে ১০ দিনের অনুমতির আবেদনপত্রে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন দিয়ে দিয়েছে আরও ৫ দিন অর্থাৎ ১৫ দিনের অনুমতি দেয়া হল। বাংলাদেশের মাঠ-ঘাট প্রান্তরে তখন যাত্রাগানের জোয়ার। হায়, বঙ্গবন্ধুর সেই বাংলাদেশ আর কি ফিরে পাব আমরা!

আর একটি বিষয় উল্লেখ করার মতো যে, যাত্রার নামে যে জুয়া, হাউজি ও প্রিন্সেসদের অশ্লীল নৃত্যগীতের একটি অভিযোগ প্রচলিত আছে, সেটি কিন্তু চালু হয়েছিল জিয়াউর রহমানের আমলে। ১৯৭৮ থেকে শেরেবাংলা নগরের শিল্প মেলায় প্রিন্সেসদের যে অশালীন নৃত্যগীত শুরু হয়েছিল, ক্রমে তা সারা দেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ওই বছরের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে এ অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে দেশের ২৪ বুদ্ধিজীবীর যুক্ত বিবৃতি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে যাত্রা নিয়ে কোনো বিরূপ মন্তব্য, বিবৃতি কিংবা নেতিবাচক কোনো রিপোর্ট সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি। অমলেন্দু বিশ্বাসের ‘মাইকেল মধুসূদন’ (রচনা : বিধায়ক ভট্টাচার্য), ‘লেনিন’, ‘হিটলার’ (রচনা: শম্ভু বাগ), তুষার দাশগুপ্তের ‘নটি বিনোদিনী’ (রচনা : ব্রজেন্দ্র কুমার দে), বাদল ঘোষের ‘বিয়াল্লিশের বিপ্লব’ (রচনা : প্রসাদ কৃষ্ণ ভট্টাচার্য)- এসব মানসম্পন্ন যাত্রাপালা জনতার সামনে আসতে পেরেছিল বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে কোনো প্রতিবন্ধকতা বা বৈরী পরিবেশ না থাকায়।

যাত্রাদল মালিক ও শিল্পীদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর কতখানি দরদ ও মায়া-মমতা ছিল নিম্নোক্ত একটি ঘটনার মধ্যে তা পরিষ্কার বোঝা যাবে। তার এক কর্মীর নাম ছিল মো. গিয়াসউদ্দিন। বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জে। ছোটবেলা থেকে তার একটা শখ ছিল, গ্রামে-গঞ্জে যাত্রাপালার আসর বসানো। গিয়াসের একটি গুণ ছিল বঙ্গবন্ধু কবে কোথায় কখন কোন্ মিটিং করেছেন, সন-তারিখ-বার একেবারে মুখস্থ বলে দিতে পারতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে তিনি ৩২নং ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, কিরে তোর আবার কী চাই? গিয়াস বললেন, আমি একটা যাত্রাদল করব। আপনি একটা সুন্দর নাম দিয়া দেন। বঙ্গবন্ধু হেসে বললেন, অনেক রক্ত দিয়া আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। আমরা এখন মুক্ত মানে আজাদ। তোর দলের নাম হোক ‘আজাদ অপেরা।’ সেই সময় নারায়ণগঞ্জ ছিল মহকুমা শহর। তদানীন্তন ঢাকা জেলা প্রশাসন বঙ্গবন্ধুর সেক্রেটারির লিখিত চিঠি পেয়ে যথারীতি আজাদ অপেরার লাইসেন্স দিয়েছিলেন। ২০১৬ সালে গিয়াস উদ্দিনের মৃত্যুকাল পর্যন্ত আজাদ অপেরা সচল ছিল।

অপ্রাসঙ্গিক হলেও এখানে একটি বিষয়ের অবতারণা করতে হচ্ছে। যে বিষয়টি সম্পর্কে নাগরিক জীবনের বেশিরভাগ মানুষই তেমন অবহিত নন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ৮টি এবং বাংলাদেশে ৬টি যাত্রাপালা রচিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের পালাগুলো হচ্ছে- মন্মথ রায়ের আমি মুজিব নই (১৯৭১), নরেশ চক্রবর্তীর সংগ্রামী মুজিব (১৯৭১), অরুণ রায়ের আমি মুজিব বলছি (১৯৭১), সত্যপ্রকাশ দত্তের বঙ্গবন্ধু মুজিবুর (১৯৭২), ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গবন্ধুর ডাক (১৯৭২), ব্রজেন্দ্র কুমার দে’র মুজিবের ডাক (১৯৭২), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব (মৃণাল কর) এবং সাত কোটির মুজিব। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু বিষয়ক ৬টি পালার নাম- শতাব্দীর মহানায়ক (সাধন মুখার্জী), বাংলার মহানায়ক ও মুজিবের ডাকে (মিলন কান্তি দে), জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু (ড. আমিনুর রহমান সুলতান), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব (খন্দকার হারুনুর রশিদ), রক্তাক্ত একাত্তর (এমএ মজিদ)। এর মধ্যে বাংলার মহানায়ক ও জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু প্রকাশিত হয়েছে। আসন্ন মুজিববর্ষকে সামনে রেখে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি কিছু যাত্রাপালা মঞ্চায়নের প্রস্তুতি নিয়েছেন। এ উদ্যোগকে আমরা অভিনন্দন জানাই।

যা না বললেই নয়, জীবনের কঠোর কঠিন যাত্রাপথে বাঙালি মুক্তির সঠিক পথেরই সন্ধান করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। শোষিত-বঞ্চিত এ ভূখণ্ডের মানুষগুলোকে তিনি দিয়েছেন এক স্বতন্ত্র আবাসভূমি। বাংলাকে ভালোবাসতে গিয়েই বাঙালি খলনায়কদের হাতে জীবনদীপ নির্বাপিত হল তার। লক্ষ্যচ্যুত ভ্রষ্ট রাজনীতির বলি হয়েছিলেন তিনি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মত ও পথের দোলাচলে বঙ্গবন্ধু যেখানেই থাকুন না কেন, বিকৃত ইতিহাস তৈরির প্রবণতা যতই প্রবল হোক, সূর্যের মতো একটা জ্বলন্ত সত্যকে আমরা কোনো দিনই অস্বীকার করতে পারব না। সেটি হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশপ্রীতি, মানবপ্রেম, সহজ-সরল জীবনাচরণ, দয়া-দাক্ষিণ্য, বিশ্বাস, সততা, মায়া, মমতা, করুণা তাকে এক নির্মম পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। তার অক্ষমতাও নয়, অযোগ্যতাও নয়। এ বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি-বাংলার মহানায়ক।

 

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম