Logo
Logo
×

২২ বছরে যুগান্তর

সামাজিক মাধ্যমের অসামাজিকতা

Icon

রাজীব সরকার

প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সামাজিক মাধ্যমের অসামাজিকতা

বিখ্যাত ‘দৃষ্টিপাত’ বইয়ে যাযাবর লিখেছিলেন, ‘আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ।’ এ অকাট্য উচ্চারণের যথার্থতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক শেষ করে তৃতীয় দশকে উপনীত হয়েছি আমরা। বিজ্ঞানের অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে। সেই অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে প্রযুক্তির বহুমাত্রিক ব্যবহারে। চিন্তা-চেতনায় আমরা বিজ্ঞানমনস্ক হয়েছি কিনা, কুসংস্কার ও গোঁড়ামি থেকে মুক্ত হয়েছি কিনা সেটি ভিন্ন প্রশ্ন। তবে প্রযুক্তির ব্যবহারে আমরা অনেক অগ্রসর হয়েছি এবং ইন্টারনেটের আওতায় এদেশের সিংহভাগ জনগোষ্ঠী চলে এসেছে। ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অধিকাংশ শিক্ষিত ব্যক্তি সক্রিয়।

ইংরেজি শব্দ সোশ্যাল মিডিয়াকে বাংলা ভাষায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসাবে অভিহিত করা হয়। বর্তমান নিবন্ধে সোশ্যাল মিডিয়াকে সামাজিক মাধ্যম হিসাবে উল্লেখ করা হবে। ইমেইল, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ভাইবার, লিংকডইন জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম। এদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ফেসবুক। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির যোগাযোগ বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে সামাজিক মাধ্যমের ভূমিকাকে অস্বীকার করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। সামাজিক মাধ্যমের অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তাই-এর প্রমাণ।

কিন্তু যোগাযোগ ও বন্ধন এক নয়। সামাজিক মাধ্যম যোগাযোগ ঘটিয়ে দিচ্ছে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এ যোগাযোগে কোনো বন্ধন তৈরি হচ্ছে না। বরং পারিবারিক, আত্মীয়তা ও বন্ধুত্বের সম্পর্কে যে বন্ধন রয়েছে সেই বন্ধনেও শৈথিল্য দেখা দিয়েছে। প্রযুক্তির প্রতি আসক্তি তৈরি হয়েছে, মানুষে মানুষে সম্পর্কের ভিত দুর্বল হয়ে পড়েছে। সভ্যতার আদি যুগ থেকেই মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক মাধ্যমের দৌরাত্ম্য মানুষের এ চিরন্তন পরিচিতির সামনে প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দিয়েছে।

সামাজিকতার অনুষঙ্গ হচ্ছে ভদ্রতা, সভ্যতা, আনন্দ, বেদনা ও সমবেদনায় পারস্পরিক বোঝাপড়া। ব্যক্তি নয়, সমষ্টিই এখানে বড় কথা। সামাজিক মাধ্যমগুলো এ সত্যকে অস্বীকার করে চলেছে। বিচ্ছিন্ন দ্বীপের অধিবাসী যেন প্রত্যেক ব্যক্তি। একঘরে থেকেও তারা বিচ্ছিন্ন, এক আড্ডায় থেকেও সবাই সবার কাছ থেকে দূরে। ইমেইল, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবে বুঁদ হয়ে আছে প্রতিটি প্রাণ। কেউ কারও সঙ্গে ভাববিনিময় করছে না, কথা বলছে না। এতে কারও কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তারা যেন বিশ্বাস করে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের দর্শনে-‘সহেনা সহেনা জনতার জঘন্য মিতালী।’

এভাবে সমাজে জন্ম নিচ্ছে বিচ্ছিন্নতা ও অসহিষ্ণুতা। সামাজিক মাধ্যমেও এরই প্রতিফলন দেখা যায়। ফেসবুকের কথাই ধরা যাক। সবচেয়ে জনপ্রিয় এ সামাজিক মাধ্যমের শক্তিমত্তা সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এ শক্তির অপব্যয়ই বেশি হচ্ছে। বিদ্বেষ, রুচিবিকৃতি ও উগ্রবাদ ছড়ানোর হাতিয়ার হয়ে উঠেছে ফেসবুক। মতভিন্নতাকে স্বীকৃতি জানিয়ে মাওসেতুং বলেছিলেন, ‘শত ফুল ফুটতে দাও।’ মতের ও সৌন্দর্যের বৈচিত্র্যের সহাবস্থানেই সভ্য হয়ে উঠে সমাজ। শত ফুলের বদলে শত হুল ফুটছে ফেসবুকের অবয়বজুড়ে। রুচিশীল তর্ক সেখানে বিরল। যে কোনো বিষয়ে মতভিন্নতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পর্যবসিত হয় কদর্য গালমন্দে। ধর্ম ও জেন্ডারের মতো সংবেদনশীল বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে অনেকেই শালীনতার সীমা অতিক্রম করেন। তারকা বা বিশিষ্ট কোনো ব্যক্তির চরিত্র হননের পালা শুরু হলে বিপুল উৎসাহে সেখানে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েন। ট্রলের মাধ্যমে বিপন্ন করে তোলেন সেই ব্যক্তির জীবন। ব্যক্তিটি যদি নারী হন, তাহলে আক্রমণের মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ‘ট্রল’ নামে অভিহিত এ অনাচারকে ‘ভার্চুয়াল গণপিটুনি’ আখ্যা দেওয়াই সঙ্গত।

এ অনাচার বহু ক্ষেত্রে অপরাধ সংগঠনে ভূমিকা পালন করে। কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে দিতে সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করা হয়েছে। ঘৃণা ও উগ্রবাদকে মনুষ্যত্বের বিরুদ্ধে কীভাবে লেলিয়ে দেওয়া যায় এর কলঙ্কিত উদাহরণ হয়ে আছে এ ঘটনাগুলো। গোয়েবলস বলেছিলেন, একটি মিথ্যা কথা দশবার বললে এটি সত্য হয়ে যায়। গোয়েবলসের তত্ত্ব প্রচারের ধারক হয়ে উঠেছে সামাজিক মাধ্যমগুলো। তাদের পরিবেশিত সত্যে আলোর উদ্ভাসন কতটুকু ঘটে জানা নেই। তবে তাদের প্রচারিত মিথ্যার কুহেলিকায় প্রায়ই সত্যের মৃত্যু ঘটে।

ফেসবুক এক অর্থে সমাজের দর্পণ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। সমাজে ইতিবাচকের চেয়ে নেতিবাচক চিন্তার মানুষ যে বেশি এটি ফেসবুকের বদৌলতে আরও স্পষ্ট হয়েছে। নেতিবাচক চিন্তার ধরন প্রায় ক্ষেত্রেই পশ্চাৎপদ এবং প্রগতি ও নারীবিরোধী। কারও কারও মন্তব্যে স্যাডিস্ট চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। কিছুদিন আগে কলাবাগানের এক ফ্ল্যাটে আনুশকা নামে এক কিশোরীর মৃত্যু হয়েছে। দিহান নামে এক তরুণ তাকে ফ্ল্যাটে ডেকে নেয়। গণমাধ্যমের কল্যাণে একাধিক কারণ উঠে এসেছে তার মৃত্যুর জন্য। যৌন সম্পর্কের কারণে মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে। সে ধর্ষণ বা সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার, বিকৃত যৌনাচারের শিকার- এ ধরনের অভিযোগ এসেছে। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত কারণ উদঘাটিত হবে এবং দোষী ব্যক্তি সাজা পাবে এটি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিমাত্রেরই প্রত্যাশা। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতোমধ্যেই বিচার শুরু হয়ে গেয়েছে। আনুশকা এবং তার মা সম্পর্কে অত্যন্ত অশালীন মন্তব্য করা হয়েছে। অভিযুক্ত দিহানের জন্মপরিচয় নিয়ে কটাক্ষ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় আনুশকা, তার মা এবং দিহানের মা ঘুরেফিরে রুচিহীন আক্রমণের শিকার হয়েছেন। অর্থাৎ মন্তব্যকারীদের অধিকাংশ কুরুচিপূর্ণ ও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা দ্বারা আক্রান্ত।

প্রকৃত গণমাধ্যমও ম্লান হয়ে যাচ্ছে অনলাইন সাংবাদিকতার দৌরাত্ম্য। ন্যূনতম যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ছাড়াই কোনো কোনো ব্যক্তি অনলাইন সাংবাদিকতার প্লাটফর্ম খুলে বসেছেন। ভিত্তিহীন সংবাদ, গুজব এবং অপপ্রচারই এদের মূলধন। তাদের পরিবেশিত সংবাদে চটকদার উপাদানের প্রাধান্য থাকায় বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করে। প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়।’ সংক্রামক ব্যাধির মতোই অপসাংবাদিকতা ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমের দেয়ালজুড়ে।

পারস্পরিক ভাববিনিময়ের ক্ষেত্রে একসময় চিঠি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। চিঠি, হলুদ খাম, পোস্টকার্ড এখন জাদুঘরে। প্রিয়জনকে লেখা চিঠি, প্রিয়জনের কাছ থেকে পাওয়া চিঠি ছিল অপার আবেগের আধার। এর জায়গা নিয়েছে এখন টেক্সট মেসেজ কিংবা ফেসবুক মেসেঞ্জার। মা-বাবা, প্রিয়জন, আত্মীয়স্বজনকে আগে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে শুভেচ্ছা জানানো হতো তাদের সঙ্গে হৃদয়ের উষ্ণতা বিনিময় করে। তখন দেখা-সাক্ষাৎ হতো, কার্ড, চিঠি, ফুল বা অন্য কোনো উপহার দিয়ে বিশেষ মুহূর্তটিকে উদযাপন করা হতো। এখন সবকিছু চলে গেছে সামাজিক মাধ্যমের অধিকারে। ফেসবুক, টুইটারে শুভেচ্ছা জানিয়েই দায়িত্ব শেষ। একটি নতুন পোশাক পরিধান, কোনো রেস্টুরেন্টে যাওয়া, নিজের হাতে কোনো খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুত করার মতো সাধারণ বিষয়গুলো উদযাপনের উপলক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে ফেসবুকের কল্যাণে। সে ক্ষেত্রে কতজন লাইক করল, লাভ রিঅ্যাকশন দিল, কমেন্ট করল-এর ওপরে ব্যক্তিসম্পর্কের পারদ ওঠানামা করে। এতে যোগাযোগ ত্বরান্বিত হয়েছে; কিন্তু সম্পর্কের গভীরতা বিদায় নিয়েছে।

তথ্যপ্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত উত্থান এক কল্পিত জগৎ তৈরি করেছে। ছবি, শব্দ, লেখার সাহায্যে সামাজিক মাধ্যমে যে জগৎ তৈরি হচ্ছে সেটি কৃত্রিম। এটি গ্রাস করে নিচ্ছে বাস্তব জগৎকে। ভার্চুয়ালের গহবরে হারিয়ে যাচ্ছে রিয়াল। এভাবেই মানুষ অসামাজিক হচ্ছে। ছবি দেখে, ভিডিওকলে কথা বলে যোগাযোগ রক্ষা করা যায়, সম্পর্ক বাঁচানো যায় না। এক বছর ধরে পৃথিবী নিশ্চল হয়ে আছে করোনা মহামারির কারণে। এর আগেই মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধন দুর্বল হয়েছে, করোনার আগমন এ বিচ্ছিন্নতাকে তীব্রতর করেছে। করোনা সংক্রামক ব্যাধি। সংক্রমণের আশঙ্কায় সন্তান রাতের আঁধারে মাকে জঙ্গলে রেখে পালিয়েছে, স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে ছেড়ে চলে গেছে। প্রিয়জনরা চোখের নিমেষে চেহারা পাল্টে ফেলেছে। মানুষ সামাজিক জীব-চিরায়ত এ সত্য মুখ থুবড়ে পড়েছে মহামারির সময়। সম্ভবত গত কয়েক বছর ধরে ভার্চুয়াল জগৎ এ নির্মম বাস্তবের জন্যই মানুষকে প্রস্তুত করেছে।

করোনা এক সময় চলে যাবে; কিন্তু অসামাজিকতার ব্যাধি কি বিদায় নেবে? স্পর্শ, আলিঙ্গনের বিকল্প স্বাদে যেভাবে অভ্যস্ত হয়েছে মানুষ সেই অভ্যাস কি ত্যাগ করতে পারবে? করোনা প্রমাণ করেছে, মানুষের ভেতরে একটি স্বার্থপর প্রাণী বাস করে, সুযোগ পেলে সেই প্রাণী আত্মপ্রকাশ করে। কোনো সন্দেহ নেই, সামাজিক মাধ্যমের অপব্যবহার এ স্বার্থপরতাকে বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে। সামাজিক মাধ্যমে কোনো ইতিবাচক চর্চা যে হচ্ছে না এমন নয়। কিন্তু নেতিবাচক ভূমিকার কাছে সেটি ম্লান হয়ে যাচ্ছে।

রবীন্দ্রনাথের ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকে উদয়াদিত্য বলেছিলেন, ‘রাজার ঘরে উত্তরাধিকারীই জন্মায়, পুত্র জন্মায় না।’ কথাটির তাৎপর্য অসামান্য। বিত্তবান পরিবারে সন্তানের চেয়ে উত্তরাধিকারীই বেশি কাঙ্ক্ষিত। এ ধরনের পরিবারে প্রাচুর্যের ফলে অভিভাবকরা সন্তানদের ইচ্ছাপূরণে কার্পণ্য করেন না। কেউ কেউ ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছেন। মধ্যবিত্ত পরিবারেও সন্তানের যে কোনো আবদার মেটানোর প্রবণতা রয়েছে বহু অভিভাবকের। অথচ অভিভাবকের কাছে সন্তানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাপ্তি হচ্ছে সময়। সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিলে তাদের সঙ্গে মানসিক বন্ধন শক্তিশালী হয়। এর ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হয়।

অধিকাংশ অভিভাবকেরই সময়ের অভাব। এ ঘাটতি পূরণ করার জন্য সন্তানের বস্তুগত চাহিদা মেটান তারা। সৃজনশীল বই পড়া বা খেলার মাঠে যাওয়ার কোনো তাগিদ যেন শিক্ষার্থীদের নেই। ঘরে অভিভাবকরা যে যার ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত, সন্তানরাও তাই শিখছে। এ দৃশ্য এখন দুর্লভ নয় যে, একটি পরিবারের প্রত্যেক সদস্য নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত; কেউ কম্পিউটারে, কেউ ল্যাপটপে, কেউ মোবাইল ফোনে। ইমেইল, ফেসবুক, টুইটারে, হোয়াটসঅ্যাপে সরগরম সবাই, কারও সঙ্গে কথা বলার সময় নেই। এ বিচ্ছিন্নতা পরিবারের প্রত্যেকটি ব্যক্তিকে পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে।

প্রযুক্তি যত উৎকর্ষই অর্জন করুক না কেন, যন্ত্র কখনো মানুষের বিকল্প হতে পারে না। সামাজিক মাধ্যমে ব্যক্তি যতই তৎপর থাকুক না কেন, সামাজিক দায়িত্ব ও সচেতনতার ক্ষেত্রে তার মধ্যে জন্ম নেয় প্রচণ্ড অনীহা ও উদাসীনতা। এটি এক সময় হতাশায় পর্যবসিত হয়। সামাজিক মাধ্যম এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। এর প্রতি আসক্তি-মাদকাসক্তির চেয়ে কম বিপজ্জনক নয়। তরুণ প্রজন্মের জন্য এ পরিস্থিতি আসলেই অশনি সংকেত। মাদক, যৌন হয়রানি, নারী নির্যাতন, জঙ্গিবাদের মতো অপরাধে তরুণরা কেন ঝুঁকে পড়ছে এ নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীরা গবেষণা করেছেন। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, বিচ্ছিন্নতা এবং আত্মকেন্দ্রিকতা তরুণদের বিপথগামী হওয়ার অন্যতম কারণ। অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অসামাজিকতা অপরাধপ্রবণতার জন্ম দিচ্ছে।

রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতায় আছে, ‘প্রেমের আনন্দ থাকে শুধু স্বল্পক্ষণ/প্রেমের বেদনা থাকে সমস্ত জীবন।’

কীটসের বিখ্যাত উক্তি,‘Our sweetest songs are those which tell us of saddest thoughts.’একটি জনপ্রিয় গানে মান্না দে’র অনুভূতি, ‘ ক’ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ যে তুমি ভালোবাসবে/পথের কাঁটায় পায়ে রক্ত না ঝরালে/কী করে এখানে তুমি আসবে?’ প্রেমের চিরন্তন অনুভূতি আনন্দ ও বেদনার যৌথ অস্তিত্বে গঠিত। যুগে যুগে, দেশে দেশে প্রেমের এ রূপই বহমান। সামাজিক মাধ্যম প্রেমের এ চিরন্তন রূপকে পাল্টে দিচ্ছে। সহজলভ্যতা ও স্থূল দৃষ্টিভঙ্গি প্রেমকে লঘু করে ফেলছে। তরুণ-তরুণীরা সহজেই নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শারীরিক সম্পর্কও তৈরি হচ্ছে। এক সময় মোহভঙ্গ হলে সম্পর্কের অবসান ঘটছে। কখনো কখনো বিক্ষুব্ধ পক্ষ প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নিজেদের অথবা প্রেমিক বা প্রেমিকার অন্তরঙ্গ ছবি ভাইরাল করে দিচ্ছে, যা একটি নতুন অপরাধের জন্ম দিচ্ছে। কিছুদিন পর অবলীলায় তারা নতুন কাউকে বেছে নিয়ে সম্পর্ক গড়ে তুলছে। এরপর আবারও সেই পুরনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি। প্রকৃত প্রেমের পরিবর্তে সাময়িক মোহের এ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে সামাজিক মাধ্যমের বদৌলতে।

সৃজনশীলতা ও মননশীলতা অন্য প্রাণী থেকে মানুষকে আলাদা করেছে। সামাজিক মাধ্যম এক্ষেত্রেও হানা দিয়ে মানুষকে অনুভূতিহীন করে তুলছে। আনন্দ, বেদনা, ভালোবাসা, অভিমানের মতো মানবীয় অনুভূতি গুরুত্ব হারাচ্ছে। জ্ঞানের পরিধিও সংকুচিত হচ্ছে। নতুন শব্দ, শব্দের অর্থ জানার জন্য অভিধানের সাহায্য এখন কেউ নেয় না। গুগল ট্রান্সলেটরের সাহায্য নিতে অভ্যস্ত হচ্ছে সবাই। এমনকি অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকাও ডিজিটাল ডিভাইসে শব্দার্থ দেখে শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন। এটি শিশুদের সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়। এভাবে একটি অর্ধশিক্ষিত প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে।

সৌন্দর্যের বদলে প্রচারসর্বস্বতা প্রাধান্য পাচ্ছে। খুব সুন্দর একটি স্থানে গিয়ে এর নয়নাভিরাম রূপ উপভোগ করার সময় কারও নেই। সবাই ব্যস্ত ছবি তোলা নিয়ে। কে কত দ্রুত ছবি বা সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড করতে পারবে এ নিয়ে প্রতিযোগিতায় মত্ত সবাই। ‘সেলফি’ শব্দটির অর্থ হতে পারে ‘নিজস্বী’। অর্থাৎ আত্মকেন্দ্রিকতাই এ ধরনের ছবির বিষয়বস্তু। কাশবন বা সরিষা ক্ষেতের সৌন্দর্য নিয়ে কখনো আমাদের মাথাব্যথা ছিল না। ফেসবুক ও সেলফি সংস্কৃতির কল্যাণে দলে দলে নারী-পুরুষ সেখানে গিয়ে ছবি তুলছেন। কেউ কেউ এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে যান, কৃষকের শ্রমে-ঘামে নির্মিত সরিষা ক্ষেত মাড়িয়ে ধ্বংস করে দেন শুধু ছবি তোলার জন্য।

শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিও ক্ষয়িষ্ণু রূপ ধারণ করেছে সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে। সমালোচনা সাহিত্য বরাবরই দুর্বল আমাদের। উৎকৃষ্ট বইয়ের পাঠক সাধারণত কম হয়, সেই বই সম্পর্কে গঠনমূলক সমালোচনা হয় আরও কম। একজন লেখক নিজের নতুন বই সম্পর্কে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার পর অনেকে লাইক, কমেন্ট করেন। এটি লেখকের জন্য কোনো সুসংবাদ নয়। কারণ তাদের মধ্যে অধিকাংশই বইটি পড়েন না। কবিতা বা অন্য কোনো সাহিত্যসংক্রান্ত পোস্ট পড়েও মন্তব্যকারীর সংখ্যাকম নয়। তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই প্রকৃত পাঠক কিংবা বইয়ের ক্রেতা।

আমাদের দেশে মানসম্পন্ন চলচ্চিত্র ও টিভি নাটকের সংকট রয়েছে। এমন একটি ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে গেছে, প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে ‘ভিউ’ বাড়ানো। শিল্পী হওয়ার দিকে ঝোঁক নেই, সবাই তারকা হতে চায়। সস্তা জনপ্রিয়তা তৈরির বিশাল প্লাটফর্ম তৈরি করেছে সামাজিক মাধ্যম। প্রতিভাবান ব্যক্তিদের পদচারণা যে সেখানে নেই তা নয়। সামাজিক মাধ্যম অজস্র কবি, সংগীতশিল্পী, অভিনেতা, নির্মাতার জন্ম দিচ্ছে, অগণিত ‘ভিউ’ ও ‘শেয়ার’ হচ্ছে। তাদের মধ্যে কত শতাংশ আসলেই প্রতিভাবান সেটি কি আমরা ভেবে দেখেছি? অযোগ্যদের প্রাদুর্ভাবে প্রকৃত প্রতিভা যে আড়ালে চলে যাচ্ছে সেটি কম দুশ্চিন্তার বিষয় নয়।

গভীরভাবে চিন্তা করার, কোনো কিছু তলিয়ে দেখার অবকাশ নেই সামাজিক মাধ্যমে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াই এর মূলধন। এভাবে একটি অস্থির জনগোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে এদেশে। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের প্রতিষ্ঠাতা দেশগুলোর নাগরিকরা কিন্তু এ মাধ্যম নিয়ে এত অস্থিরতা প্রদর্শন করে না। তারা বই পড়ে, গান শোনে, বাগান করে বা অন্য কোনো সৃজনশীল কাজ করে। সামাজিক মাধ্যমে মাত্রাতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে গিয়ে প্রতি বছর কত বইয়ের পাঠক, গানের শ্রোতাও মাঠের খেলোয়াড় এদেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে তা গবেষণার দাবি রাখে।

অথচ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হতে পারত সামাজিকীকরণের শক্তিশালী হাতিয়ার। সেটি হয়নি। শুধু যোগাযোগ তৈরি করে দিচ্ছে এ মাধ্যম। এরপর এর হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে সবাই। বিশ্বায়ন যে বিশ্বগ্রামের কথা বলে সেই গ্রাম সীমায়িত হয়ে পড়েছে ভার্চুয়াল জগতে। সাক্ষাৎ, স্পর্শ, ঘ্রাণের চেয়ে কাচের পর্দায় চোখ রেখে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি আমরা। পণ্যভোগবাদের নতুন লীলাভূমি এ কাচের ভূখণ্ড। এ ভূখণ্ডের জাতীয় সংগীত, ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও, আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি...।’ সামাজিক মাধ্যম ও আত্মকেন্দ্রিকতা এভাবে একাকার হয়ে গেছে।

সামাজিক মাধ্যমের দৌরাত্ম্য কতদূর পৌঁছেছে এর একটি উদাহরণ দিয়ে বর্তমান আলোচনার সমাপ্তি টানা যায়। এক ব্যক্তি অফিস থেকে বাড়ি ফিরে সেল ফোনে কথা বলতে বলতে নিজের ফ্ল্যাটের পরিবর্তে অন্য ফ্ল্যাটের ড্রয়িং রুমে ঢুকে পড়লেন। ওই ফ্ল্যাটের গৃহিণী ইউটিউবে এত বুঁদ হয়ে পড়েছিলেন, তিনি লক্ষ করলেন না তার স্বামী নয়, অন্য কোনো ব্যক্তি বাসায় এসেছেন। গৃহপরিচারিকা দিয়ে যথারীতি তিনি নাস্তা পাঠালেন। কিছুক্ষণ পর সেই ফ্ল্যাটের মালিক ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে চ্যাট করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে এলেন। নিজের ড্রয়িংরুমে অচেনা ব্যক্তিকে বসে থাকতে দেখে তিনি ‘সরি’ বলে উপরের তলায় চলে গেলেন নিজের ফ্ল্যাট খুঁজতে। নিজের ঘর, নিজের মানুষ অচেনা হয়ে যাচ্ছে সামাজিক মাধ্যমের বদৌলতে। যদি এ ধারা অব্যাহত থাকে, তবে ‘মানুষ অসামাজিক জীব’- এ নতুন পরিচিতি পেতে মানুষের দেরি হবে না।

লেখক : রম্যলেখক, প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক

সামাজিক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম