Logo
Logo
×

২৩ বছরে যুগান্তর

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাঙালির অনন্য অর্জন

Icon

রুশো তাহের

প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাঙালির অনন্য অর্জন

বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এ দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। বস্তুত দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের সরবরাহ অপরিহার্য। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের সোপানে পদার্পণ করেছে। এদিকে ভিশন-২০৪১ তথা উন্নত সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত হতে হলে বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে প্রায় ষাট হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্নের ক্ষমতা অর্জন করতে হবে।

উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং সেটাকে ধরে রাখতে বিদ্যুতের বিকল্প নেই। এ পরিপ্রেক্ষিতে দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদার আলোকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ২০১০ সালে পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান হালনাগাদ করে। হালনাগাতকৃত পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী একক কোনো উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিবর্তে মিশ্র উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বা মিশ্র জ্বালানি উৎস নীতি গ্রহণ করা হয়। বস্তুত বিদ্যুৎ উৎপাদনে মিশ্র জ্বালানি উৎস নীতিতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকে অন্যতম উৎস হিসাবে ধরা হয়।

পারমাণবিক বিদ্যুৎ, পেছনে ফিরে দেখা

স্বাধীনতার পূর্ব ১৯৬১ সালে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়ার পর ১৯৬৩ সালে প্রস্তাবিত ১২টি এলাকার মধ্য থেকে বেছে নেওয়া হয় রূপপুরকে। সেখানে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ২৬০ একর এবং আবাসিক এলাকার জন্য ৩২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিমাতাসুলভ আচরণের জন্য তা আমাদের অধরাই থেকে যায়। ১৯৬৪ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য যন্ত্রপাতি তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য তা শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরে না-এনে করাচিতে নিয়ে যায়। এদিকে পরবর্তী সময়ে রূপপুর নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও কার্যক্রম আর এগোয়নি। বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রায় ৫০ বছর আগের নেওয়া উদ্যোগটি সক্রিয় করে তোলা হয়। দ্রুত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য ২০১০ সালে সংসদে প্রস্তাব পাস করে গঠন করা হয় একটি জাতীয় কমিটি। পরে ২০১৩ সালের ২ অক্টোবরে রূপপুরে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিত্তি স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাবনার ঈশ্বরদীতে রূপপুরস্থ পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প মাঠে আয়োজিত ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বিভিন্ন উৎস থেকে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য ঠিক করেছি। শুধু গ্যাস নয় কয়লা, পারমাণবিক শক্তি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে জোর দেওয়া হচ্ছে। ১৯৯৬ সালে আমরা ক্ষমতায় এসে জ্বালানি নীতিতে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিই। এবার দায়িত্ব পাওয়ার পর নতুন করে কাজ শুরু করি। তিনি বলেন, পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইন্টারন্যাশনাল এটমিক এনার্জি এজেন্সি বা আইএইএর দিকনির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে টেকসই ও কম দামে বিদ্যুৎ পাবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এখন পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কেন্দ্র স্থাপন করছে। কেন্দ্র স্থাপনের কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। রূপপুরে বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনায় কোম্পানি গঠন করতে সংসদে বিল পাস হয়। আইন অনুযায়ী, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকানা থাকবে বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি কমিশনের হাতে। আর কেন্দ্রটি পরিচালনার দায়িত্ব পাবে ‘নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ’।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অন্দরমহল

২৫ ডিসেম্বর ২০১৫ রুশ ফেডারেশনের রোসাটম স্টেট এনার্জি করপোরেশন ‘রোসাটম’র সহযোগী প্রতিষ্ঠান এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট এবং বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের মধ্যে এ কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি বা জেনারেল কন্ট্রাক্ট সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী রূপপুর পারমাণবিক বিদুৎ কেন্দ্র স্থাপনে ব্যয় হবে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা। যার নব্বই শতাংশ রুশ ফেডারেশন ঋণ হিসাবে দেবে। বাকি দশ শতাংশ বাংলাদেশ অর্থায়ন করবে। নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুর তিনগুণের বেশি বাজেটের এ প্রকল্প বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ প্রকল্প।

২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াটের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করবে রুশ ফেডারেশন। নির্মাণ শুরু সাত বছরের মাথায়-২০২৩ সালে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের ভিভিইআর-১২০০ মডেলের (জেনারেশন থ্রি-প্লাস) প্রথম রি-অ্যাক্টরটি উৎপাদনে আসবে। তার এক বছর পর, ২০২৪ সালে উৎপাদনে আসবে দ্বিতীয় রি-অ্যাক্টরটি। দ্বিতীয়টির উৎপাদন ক্ষমতাও ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ ২০২৪ সাল নাগাদ আমাদের জাতীয় গ্রিডে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎ যোগ হবে। আমাদের দেশের বিদ্যুতের যে চাহিদা রয়েছে, তার অন্তত দশ ভাগ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পূরণ করতে সক্ষম হবে। এ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ৬০ বছর ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। এটি শুধু বিনিয়োগের দিক থেকে নয়, একই সঙ্গে উচ্চতর ও সংবেদনশীল সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মিশেলে দেশের একমাত্র প্রকল্প। যা আবার বাংলাদেশের জন্য প্রথমও। কারণ পারমাণবিক বা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন ও পরিচালনার বাস্তব অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। তবে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের রিসার্চ রি-অ্যাক্টর পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে। রয়েছে পরমাণু প্রকৌশলীও।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে পারমাণবিক নিরাপত্তার বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, নির্বাচন করা হয়েছে রুশ ফেডারেশন নির্মিত বর্তমান প্রজন্মের সবচেয়ে নিরাপদ ও সর্বাধুনিক রি-অ্যাক্টর-ভিভিইআর-১২০০। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সব বাধ্যবাধকতা প্রতিপালন এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করা হচ্ছে। মানবসম্পদ উন্নয়ন, রি-অ্যাক্টরের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, পরিবেশের ভারসাম্য সংরক্ষণ প্রভৃতি কাজ যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নির্বাচিত পারমাণবিক চুল্লিতে নিুবর্ণিত পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য থাকবে।

ফুয়েল পেলেট : নিউক্লিয়ার রি-অ্যাক্টরের পাঁচ স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থার প্রথমটি হচ্ছে ফুয়েল পেলেট। সাধারণত ইউরেনিয়াম অক্সাইড ফুয়েল পেলেট হিসাবে ব্যবহার করা হয়। যা অতি উচ্চ তাপমাত্রায় তার জ্বালানি বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে পারে। ফুয়েল পেলেট সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি করা হয়, ফলে তেজস্ক্রিয়তা পেলেটের ভেতরে অবস্থান করে।

ফুয়েল ক্ল্যাডিং : ফুয়েল পেলেটগুলো জিরকোনিয়াম অ্যালয়ের তৈরি ফুয়েল ক্ল্যাডিং দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে। ফলে ফুয়েল পেলেটগুলো চারপাশের উষ্ণ পানির সংস্পর্শ থেকে মুক্ত থাকে। বিশেষ কোনো কারণে যৎসামান্য তেজস্ক্রিয়তা ফুয়েল পেলেট থেকে বের হয়ে এলেও তা এ ক্ল্যাডিং ভেদ করতে পারবে না।

রি-অ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল : নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য বিশেষ মান নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পুরু ইস্পাতের প্রেশার ভেসেল তৈরি করা হয় যা, উচ্চ তেজস্ক্রিয় অবস্থাতেও দীর্ঘস্থায়ী হয়।

প্রথম কন্টেইনমেন্ট বিল্ডিং : ভারী ধাতব বা রিইনফোর্সমেন্ট কনক্রিট দিয়ে ১.২ মিটার পুরুত্বের প্রথম কন্টেইনমেন্ট বিল্ডিং তৈরি করা হয়। যা প্রথমত ফিশন বিক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন তেজস্ক্রিয়তা পরিবেশে ছড়িয়ে পড়া থেকে বিরত রাখে এবং দ্বিতীয়ত বাইরের বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিমান দুর্ঘটনা ইত্যাদি থেকে প্ল্যান্টকে রক্ষা করে।

দ্বিতীয় কন্টেইনমেন্ট বিল্ডিং : নিরাপত্তাব্যবস্থা অধিকতর জোরদার করার জন্য নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে প্রথম কন্টেইনমেন্ট বিল্ডিং-এর পর ০.৮ মিটার পুরুত্বের আরও একটি কন্টেইনমেন্ট বিল্ডিং যুক্ত করা হয়, যা যে কোনো পরিস্থিতিতে তেজস্ক্রিয়তাকে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়া থেকে বিরত রাখে।

উপর্যুক্ত পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যের কারণে মনুষ্যসৃষ্ট ঘটনা ও দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন-শাক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, বন্যা ইত্যাদির প্রভাব মোকাবিলায় সক্ষম থাকবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।

রূপপুর সাইট পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য কতটা উপযোগী

ভূতাত্ত্বিক তথ্য-উপাত্তের ইতিহাস থেকে জানা যায়, রূপপুর সাইটের নিকটবর্তী স্থানে রিখটার স্কেলে সর্বোচ্চ মাত্রার ভূকম্পনের রেকর্ড হচ্ছে ১৮৮৫ সালে রূপপুর সাইট থেকে ৯০.৯২ কিলোমিটার দূরে ৬.৯১ মাত্রা এবং ১৯৩৫ সালে রূপপুর সাইট থেকে ৪৯.২৪ কিলোমিটার দূরে ৬.২৫ মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে। তবে রাশিয়ান ফেডারেশনের রোসাটমের মাধ্যমে নির্মিতব্য রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিভিইআর-১২০০ টাইপ রি-অ্যাক্টরে রিখটার স্কেলে সর্বোচ্চ ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল নিরাপত্তাব্যবস্থা সংযুক্ত থাকবে। উপর্যুক্ত তথ্য-উপাত্তের আলোকে বলা যায়, রূপপুর সাইটটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য যথোপযুক্ত। এ ছাড়া বিগত জুলাই, ২০১১ সময়ে আন্তর্জাতিক এটমিক এনার্জি এজেন্সি বা আইএইএ কর্তৃক পরিচালিত ‘সাইটিং মিশন’-এ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ‘রূপপুর সাইটকে উপযোগী সাইট বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রূপপুর উঁচু পলল ভূমি বিধায় এ এলাকা বন্যায় তলিয়ে যাওয়ার কোনো রেকর্ড নেই।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাঙালির অনন্য এক অর্জন রূপপুর

রাজধানী ঢাকা থেকে দুইশ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে পাবনা জেলার ঈশ্বরদীতে-পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত রূপপুর চল্লিশ হাজার মানুষ অধ্যুষিত এক জনপদ। ১৯১৫ সালে লর্ড হার্ডিঞ্জ পদ্মা তীরের ওই জনপদে একটি রেল সেতু নির্মাণ করেন। যার নামানুসারে সেতুটির নামকরণ করা হয় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। তখন থেকেই এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখে আসছে এ হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। দীর্ঘকাল পর-পদ্মা তীরের ওই জনপদে আবারও উন্নয়ন ও অগ্রগতির বারতা নিয়ে নির্মিত হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টদের মতে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে দেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে নব এক বাতায়ন খুলে যাবে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ ও বাঙালির অর্জন অনেক-পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী নদীতে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, মেট্রোরেল, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ, পরমাণু বিদ্যুৎ, যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক উন্নয়ন, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রভৃতি। বস্তুত এর মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের পূর্তিতে বাঙালির তথা রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় অনন্য এক সংযোজন-মাইলফলক অর্জন।কারণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ৩৩তম পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছে। পারমাণবিক উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন উচ্চতর ও সংবেদনশীল প্রযুক্তিঘন এক কর্মযজ্ঞ। এদিকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনায় আমাদের কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা না-থাকলেও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনায় আমরা পাশে পেয়েছি মুক্তিযুদ্ধকালীন অকৃত্রিম বন্ধুরাষ্ট্র সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, আজকের রুশ ফেডারেশনকে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য, মূল্যসাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ প্রাপ্তিই শুধু নিশ্চিত হবে না, বরং এর মাধ্যমে দেশে পারমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনায় দক্ষ জনবল গড়ে উঠেছে। যারা বিশ্ব নিউক্লিয়ার ইন্ডাস্ট্রিতে অবদান রাখার মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে সক্ষম হবে। যার ফলে আমাদের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা তথা আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে বৈকি। অধিকন্তু বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হবে।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যু কেন্দ্র নির্মাণ তথা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে বাংলাদেশের পারমাণু বিশ্বে পদার্পণ অন্য আরেকটি কারণে মূল্যপ্রাপ্ত। আর তা হলো পারমাণবিক কূটনীতিতে বাংলাদেশের বিজয়। কারণ কোনো দেশ চাইলেই অর্থাৎ আর্থিক সামর্থ্য ও দক্ষ জনবল থাকলেও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে পারে না। এক্ষেত্রে ওই দেশকে তার প্রতিবেশী দেশ, আন্তর্জাতিক মহল ও আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থাকে (আইএইএ) বিশেষত এ নিশ্চয়তা দিতে হয় যে, তারা পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার করবে। আর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের ক্ষেত্রে এ নিশ্চয়তা প্রদান করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় সমর্থন আদায় অর্থাৎ পারমাণবিক কূটনীতিতে বিজয় অর্জন অপেক্ষাকৃত কঠিন একটি কাজ। কিন্তু এ কাজটি-ই করতে সক্ষম হয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব। তিনি ইতোমধ্যে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আরেকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের ঘোষণাও দিয়েছেন। যেটির সাইট নির্বাচনের কাজও অনেকদূর এগিয়েছে।

স্বল্প আয়তনের ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হিসাবে বাংলাদেশ টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পারমাণবিক উৎসের ওপর নির্ভর করা অনেকাংশেই সমীচীন। কারণ, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আয়ুষ্কাল সাধারণত ষাট বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। পরে তা আশি বছর পর্যন্ত বাড়ানো যায়। সেখানে জীবাশ্ম জ্বালানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আয়ুষ্কাল সর্বোচ্চ পঁচিশ বছর হয়ে থাকে। তাই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের ব্যয় প্রাথমিকভাবে বেশি হলেও দীর্ঘদিন বিদ্যুৎ উৎপাদনের কারণে সাশ্রয়ী মূল্যে এ কেন্দ্র থেকে জনগণ বিদ্যুৎ পেয়ে থাকে। এদিকে ফুয়েল ব্যবহারের ক্ষেত্রেও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অনেক সাশ্রয়ী। যেমন একগ্রাম ইউরেনিয়াম ব্যবহারে প্রায় চব্বিশ হাজার কিলোওয়াট আওয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। অন্যদিকে সমপরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে তিন টন কয়লার প্রয়োজন হয়। এদিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য যে পরিমাণ জায়গার প্রয়োজন হচ্ছে সে পরিমাণ স্থানে আমরা যদি সৌর প্যানেল বসাই, তাহলে মাত্র আট মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। অথচ দুটি রি-অ্যাক্টর থেকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা দুই হাজার চারশ মেগাওয়াট। এতদবিবেচনায় বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশের বিদ্যুতের নিদেনপক্ষে শতকরা পঁচিশ ভাগ পারমাণবিক উৎস থেকে উৎপাদনের নীতিমালা করা এখন সময়ের দাবি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের পারমাণবিক বিদ্যুতের যুগে যে পদার্পণ, তা ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়ন তথা উন্নত সমৃদ্ধ দেশের কাতারে শামিল হওয়ার পথযাত্রাকে বেগবান করবে।

লেখক : বিজ্ঞান লেখক ও নির্মাতা

অর্জন

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম