বাংলাদেশে ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পের বিকাশ অত্যাবশ্যকীয়
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মানুষের অর্থনৈতিক চাহিদার জন্য পণ্য ও সেবার উৎপাদন দরকার। তদুপরি জনগণের সামাজিক উন্নয়ন অর্থনৈতিক চাহিদার বাইরে অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতে দরকার জনসম্পদ বা মানবসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার। প্রথমটি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সম্পৃক্ত, দ্বিতীয়টি মানুষের কর্মসংস্থান ও আয়ের উৎসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পরিচালিত ছোট ও মাঝারি শিল্পের ভূমিকা প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। বৃহৎ শিল্প, সুবিশাল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নিঃসন্দেহে অবদান রাখে তবে পৃথিবীর উন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশেই মোট দেশজ উৎপাদন এবং কর্মসংস্থানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অবদান কম না।
বাংলাদেশে অবশ্য এই অবস্থান থেকে দূরে, অর্থাৎ এসব শিল্প ও ব্যবসার অর্থায়ন কম এবং এগুলো কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালনে তেমন ভূমিকা রাখছে না।
বড় বড় শিল্পের সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে কোনোভাবেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) অবহেলিত। আমরা যে আর্থসামাজিক পটভূমিতে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে এসএমই হতে পারে আমাদের এক বিরাট চালিকাশক্তি। আমার পরামর্শ থাকবে, নানা কথাবার্তার পরও কেন এ খাত অবহেলিত এবং এর বিকাশে কী কী করা প্রয়োজন সেদিকে মনোযোগ দিতে। একই সঙ্গে এসএমই খাতের গুরুত্ব উপলব্ধি করাটাও জরুরি।
এসএমই শব্দসংক্ষেপ দিয়ে সাধারণত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোগকে বোঝালেও এর সংজ্ঞায় কটেজ ইন্ডাস্ট্রি বা কুটির শিল্প এবং মাইক্রো ইন্ডাস্ট্রি বা অতি ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোগকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ জন্য এসএমইকে অনেক সময় সিএসএমই- কটেজ, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ, আবার কিছু ক্ষেত্রে কটেজ, মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ বা সিএমএসএমইও বলা হয়। তবে মোটা দাগে আমরা এটাকে স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ বা এসএমই বলে থাকি। যদিও সেবা খাত ও উৎপাদন খাতের জন্য এর সংজ্ঞায় কিছু পার্থক্য আছে।
অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সার্বিকভাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ খুব একটা ঘটেনি। বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের জিডিপিতে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ অবদান এসএমই খাতের। কিন্তু আমাদের এসএমই খাত আদৌ ২০ শতাংশ অবদান রাখছে কি না আমার সন্দেহ আছে। ওইসিডিভুক্ত ইউরোপীয় সদস্য দেশগুলোর জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান ৫৫ শতাংশ। এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এর অবদান ৪৫ শতাংশের মতো। চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার জিডিপিতে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ অবদান রাখছে এসএমই খাত। বেশিরভাগ কর্মসংস্থানও তাদের এসএমই খাতে। সুতরাং বৃহৎ শিল্প বা বৃহৎ বাণিজ্যের অবদানকে আমরা যেভাবে বড় করে দেখি বা নির্ভর করি তা ভুল। আর বৃহৎ শিল্পের প্রতি সাধারণ ঝোঁকটা এসএমই খাতের প্রতি অবহেলাও একটা কারণ। বাংলাদেশে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ শ্রমিক এসএমই খাতে জড়িত। সুতরাং এসএমই খাত যত বড় হবে, কর্মসংস্থান পরিধিও তত বড় হবে। তারপরও আমরা যেভাবে এসএমই খাতকে অবহেলা করি, তা উন্নত দেশগুলো করে না।
এবার আমাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সমস্যাগুলো কী, সেদিকে নজর দেওয়া যাক। এ খাতে আমাদের একটা সমস্যা হচ্ছে অর্থায়ন সংকট। এর উদ্যোক্তারা ব্যাংক ঋণ কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ খুব কম পায়। বেশিরভাগ সময় তারা মাইক্রো ফাইন্যান্স ইনস্টিটিউশন তথা এনজিওর ওপর নির্ভরশীল। অবশ্য কিছু ব্যাংকের এসএমই সেক্টর কর্মসূচি তাদের কিছু সহায়তা করে থাকে। এর বাইরে গতানুগতিক ভাবধারায় চলা ব্যাংকগুলো তাদের অর্থায়ন করতে চায় না। তাদের ঋণ দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ, অল্প অল্প করে অধিক মানুষকে ঋণ দিতে হয়, সুপারভিশন করতে প্রচুর সময় ব্যয় হয়-এ রকম নানা অজুহাত দেখিয়ে থাকে ব্যাংকগুলো। অথচ এই যুগে নানা তথ্যভাণ্ডার বিবেচনায় নিলে আধুনিক কৌশল ও সৃজনশীল উপায় চিন্তা করলে এসব যুক্তি মোটেও ধোপে টেকে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক, পিকেএসএফ এবং এসএমই ফাউন্ডেশন মূলত এসএমইতে ঋণ বিতরণের কাজ করছে। এক্ষেত্রে বিসিকেও একটা ভূমিকা আছে। কিন্তু সার্বিকভাবে অর্থায়নের মেইন স্ট্রিম বা মূল স্রোতধারায় এসএমই আসতে পারেনি। এসএমই উন্নয়নের মূলধারায়ও আসতে পারেনি। লক্ষ করলে দেখা যাবে, ২০২০ সালের জুলাইয়ে কোভিড-১৯ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর যে প্যাকেজ দেওয়া হয়, সেটা একটা সমন্বিত পদক্ষেপ ছিল। সব সেক্টরকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয় ছিল এবং ছোট-বড় সবার অংশ রাখা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে রপ্তানি খাত, বিশেষ করে আরএমজি এক্সপোর্ট সেক্টর, তারপর বৃহৎ শিল্পের অন্যান্য সেক্টরে অতি দ্রুত প্যাকেজের টাকা শেষ হয়ে যায়; কিন্তু এসএমই খাতে ব্যাংকগুলো বরাদ্দ টাকা দিতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে তারা সে চেষ্টা করেনি। এই খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া আর কিছু নেই। জয়েন্ট স্টক কোম্পানি বা চেম্বার বডিগুলোতে তাদের সদস্য হিসাবে দেখা যায় না। ফলে অর্থনীতির মূলধারায় তারা আসে না।
এখানে কৃষিঋণের উদাহরণটা টানা যেতে পারে। আমাদের কৃষি খাত কিছুটা ঋণ পায়। এর কারণ হচ্ছে, এর সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তার সম্পর্ক রয়েছে। এবং সরকারেরও নীতিগত অবস্থান ও মনোযোগ রয়েছে। কৃষি ঋণ নিয়ে পাবলিক সেন্টিমেন্টের একটা ব্যাপারও আছে। আমাদের গণমাধ্যমগুলোও বেশ সজাগ। কিন্তু এসএমই খাতের ঋণ নিয়ে এখনো পাবলিক সেন্টিমেন্ট তৈরি হয়নি, কেউই সোচ্চার নয় এবং মিডিয়াও খুব বেশি কথাবার্তা বলে না। সুতরাং এ জিনিসটা নিয়ে আমাদের নতুন করে বাবার সময় এসেছে। সামনে যেহেতু কোভিড প্যাকেজগুলো রিনিউ করা হবে, তাতে নতুন ভাবনার প্রতিফলন থাকা উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে, এই খাতে ঋণপ্রবাহে যেসব ব্যাংক ভালো করবে তাদের পুরস্কত করা এবং যারা খারাপ করবে তাদের তিরস্কারের ব্যবস্থা করা।
এসএমইতে আমরা কেন এত গুরুত্ব দেব? এর কারণগুলো হচ্ছে- প্রথমত, এসএমএই খাতে বর্তমানে একটা বিশাল জনগোষ্ঠী জড়িত। দ্বিতীয়ত, এই খাতের দ্রুত বিকাশ লাভ করার সম্ভাবনা রয়েছে। তৃতীয়ত, এসএমই খাতের পণ্য গুণে-মানে কোনো অংশেই কম নয়। এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রযুক্তি নির্ভর। এ খাত আয়বর্ধক খাত হিসাবে চিহ্নিত। যারা চাকরি করতে চায় না বা করে না, শিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত-তাদের সবারই একটা সুযোগ থাকে এখানে কিছু করার। চতুর্থত, কর্মসংস্থান সৃষ্টির একটা বড় সুযোগ ও ক্ষেত্র হচ্ছে এসএমই খাত। সার্বিকভাবে দারিদ্র্য বিমোচনের বড় একটা হাতিয়ার এটা। আমাদের সর্বশেষ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং প্রেক্ষিত পরিকল্পনাও এই খাতের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে আমাদের করণীয় কী? আমি প্রথমেই বলব, যথাযথ নীতিকৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। আমাদের রাজস্ব নীতিতেই এসএমইকে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয় না। আমরা বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কর অব্যাহতি, কর হ্রাসসহ নানা দাবিদাওয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকি। এটা ভালো; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে যদি এসএমইর ওপর গুরুত্বটা দেওয়া হয়, সেটা হবে উপকারী। এ জন্য রাজস্ব নীতি এসএমইমুখী করতে হবে। তদারকি পর্যবেক্ষণ বাড়াতে হবে। প্রাইভেট সেক্টরে ঋণ বাড়ানো মানে বড় বড় শিল্পে ঋণ বাড়াতে হবে, এমন চিন্তা থেকে সরে আসতে হবে। দ্বিতীয়ত, নীতিমালা ও পদ্ধতিগুলোর সহজীকরণ। অনেক সময় দেখা যায়, সরকার ঢালাওভাবে কিছু নিয়ম করে, যা ছোটদের ওপরও একইভাবে প্রযোজ্য হয়। এটা করা যাবে না। ছোট ও মাঝারি উদ্যোগকে যেন সহজেই এগিয়ে নেওয়া যায়, সে ধরনের নীতিগত সহযোগিতা লাগবে। তৃতীয়ত, তথ্য সংগ্রহ ও প্রচারের ব্যর্থতা কাটিয়ে ওঠা। এ খাতে সরকারের কিছু নীতি ও প্রণোদনার বিষয় রয়েছে। কিন্তু সরকারের উন্নয়ন এজেন্সিগুলো-বিসিক, এসএমই ফাউন্ডেশন বা বেসরকারি সংস্থা রয়েছে, এরা এসএমই-সংক্রান্ত তথ্যগুলো ঠিকঠাকভাবে প্রচার করে না। মানে ছোট ব্যবসায়ীদের সব তথ্য জানাতে হবে এবং তাদের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে। চতুর্থত হলো প্রশিক্ষণ। একটা নতুন ব্যবসায় কী কৌশল লাগবে, ঝুঁকি বা সম্ভাবনা কেমন তা উদ্যোক্তাদের জানাতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় থেকে এসব বিষয়ে কিছু ব্যবস্থা রয়েছে বটে; তবে পর্যাপ্ত নয়।
পঞ্চমত, বাংলাদেশে বড় শিল্পের সঙ্গে ক্ষুদ্র বা কুটির শিল্পের ব্যবসায়ী সংযোগ গড়ে ওঠেনি। এটি তৈরি করতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশেই দেখবেন, ছোট শিল্পগুলো বড়দের থেকে সাবকট্রাক্ট নেয়। এই অর্থে বড় বড় শিল্পের সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসাবে ক্ষুদ্র বা মাঝারি শিল্প গড়ে ওঠে। যেমন-টয়োটার মতো বড় বড় কোম্পানি বা জাহাজ নির্মাণ শিল্পে বড় কোনো কোম্পানি ছোট ছোট শিল্প-কারখানা দিয়ে অনেক কাজ করিয়ে নেয়। আমাদের এখানে সে অর্থে এ যোগসূত্রটা তৈরি হয়নি। আরেকটা হলো বহির্বিশ্বের বাজারের সঙ্গে আমাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলোর সংযোগ নেই। এক্ষেত্রে সরকারের সহায়তা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। বাংলাদেশের হাজারের কাছাকাছি পণ্য বাইরে রপ্তানি হয়। কিন্তু এর পরিমাণ কম। বহির্বিশ্বের বাজারের সঙ্গে লিংক স্থাপনের অভাবে এমনটা হয়। ওয়ালমার্টে একবার আমি একটি অত্যাধুনিক বড়শি দেখে এর উৎস জানতে চেয়েছিলাম। আমাকে জানানো হলো, ওটা চীনের রুরাল ইন্ডাস্ট্রিতে তৈরি। চীনে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সাধারণত রুরাল ইন্ডাস্ট্রি হিসাবে পরিচিত। চীনে রুরাল ইন্ডাস্ট্রির জন্য ফরেন ট্রেড ও ফেসিলেশনের যথেষ্ট ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের বহির্বাণিজ্যের এত ব্যাপকতার এটাও একটা কারণ। আমি ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প দেখার জন্য একবার ফিলিপাইনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়েছিলাম। সেখানে আলাপকালে এক নারী উদ্যোক্তা আমাকে জানালেন, পরের দিন তিনি সিঙ্গাপুর যাবেন। সেখানে তার একজন ক্রেতা আছে। তার কাছ থেকে সরবরাহ আদেশ আনতে যাবেন। ভাবা যায়, একজন নারী উদ্যোক্তা গ্রাম থেকে সিঙ্গাপুরে ব্যবসা করছেন? আমাদের এখানে কয়েকটি চেইনশপ এবং সুপারস্টোর গ্রামে নারীদের দিয়ে পোশাক এবং অনেক সামগ্রী তৈরি করিয়ে নেয়। পণ্যের মূল্য সংযোজন প্রক্রিয়ায় এসব মহিলা কোনো আর্থিক সুবিধা পায় না। এভাবে আমাদের না হয় নারীর ক্ষমতায়ন, না ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের সত্যিকার উন্নয়ন।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া খুব দরকার। এর সঙ্গে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নতুন নতুন সেবা তাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারের নীতিগুলো বিশেষ করে প্রণোদনা, ট্যাক্স/ট্যারিফ এবং প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা সম্পৃক্তগুলো এসব শিল্পের জন্য যথাপোযোগী করে তুলতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, সাবেক গভর্নর বাংলাদেশ ব্যাংক
