প্রকৃতি ও মানুষের পুনঃসংযোগ জরুরি
ড. আইনুন নিশাত
প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
অনেক সময় আমরা বলে থাকি, মানুষ হচ্ছে প্রকৃতির সন্তান। এ আপ্তবাক্য কতটা সত্য, সেটা প্রমাণের জন্য মানবজাতির উৎপত্তিসংক্রান্ত বহু প্রাচীন বিতর্কে যেতে হবে না। বরং সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান থেকেই প্রমাণিত যে, প্রাকৃতিক ব্যবস্থা সুষ্ঠু না থাকলে মানুষ বাঁচবে না। যেমন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অনিবার্য উপাদান অক্সিজেন আসে প্রকৃতি, আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে গাছপালা থেকে। যতই আমরা ‘স্মার্ট টেকনোলজি’ আবিষ্কার করি, খাদ্য ও পানীয় কিন্তু প্রকৃতি থেকেই আহরণ করতে হয়। এমনকি অন্যান্য মৌলিক চাহিদা যেমন-বস্ত্র, বাসস্থান সবই এখনো ব্যাপকভাবে প্রকৃতিনির্ভর। স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য যে ঔষধি উপকরণ, সেগুলো আমরা প্রকৃতি ছাড়া কোথা থেকে পাব? মোদ্দাকথা, জন্ম থেকে মৃত্যু-মানবজাতির অস্তিত্ব নির্ভর করছে প্রাকৃতিক ব্যবস্থা, তথা জীববৈচিত্র্যের টিকে থাকা ও সুস্থতার ওপর।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, মানবজাতি বহু শতক ধরে তার জীবন ও জীবিকায় প্রকৃতির এ অমোচনীয় অবদানের কথা ক্রমেই ভুলে যাচ্ছিল। যে প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে, সেটাকেই ধ্বংস করার তাণ্ডবে মেতে উঠেছিল। মন্দের ভালো, চূড়ান্তভাবে মানবজাতির অস্তিত্ব ধ্বংস হওয়ার আগেই কিছু কিছু মানুষের বোধোদয় ঘটেছে। অধিকাংশ মানুষ, তাদের ভোগ, লোভ, মুনাফা ও জাগতিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তাদেরই গড়ে তোলা ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলো বহুলাংশে প্রকৃতি ও পরিবেশবিরোধী; তবে, কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান গত শতকের মাঝামাঝি থেকেই প্রকৃতি ধ্বংসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জারি রেখেছে। তারা নানাভাবে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে একত্র হয় এবং অভিন্ন কণ্ঠস্বর তুলে ধরে; বিভিন্ন দিবস উদযাপন করে মানবজাতিকে প্রকৃতির গুরুত্ব মনে করিয়ে দেয়।
মনে আছে, কয়েক বছর আগে বিশ্ব পরিবেশ দিবসের বৈশ্বিক প্রতিপাদ্য ‘কানেক্ট পিপল টু নেচার’ বা প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সংযোগ ঘটাতে হবে। অর্থাৎ প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সংযোগ স্থাপনের জন্য বিশেষ তাগিদ দেওয়া হয়েছিল সেই প্রতিপাদ্যে। অন্যথায় এ সংযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন্ন হলে সমগ্র বিশ্ব তথা মানবজাতির জন্য কোনো সুখকর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করবে না।
প্রশ্ন হচ্ছে, প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের কতটুকু সংযোগ বা সম্পর্ক আছে? এখন থেকে ৪০-৫০ বছর আগে একজন বাংলাদেশি তরুণ প্রকৃতির সৌন্দর্য হয়তো কিছুটা দেখেছে। তারও ৪০-৫০ বছর আগে প্রকৃতির অপরূপ শোভা আমরা সবাই দেখেছি। দেশের কৃষি ছিল সম্পূর্ণ প্রকৃতিভিত্তিক। প্রকৃতিও উজাড় করে তার সম্পদ মানুষকে দিয়েছে এবং মানুষ তা ভোগ করেছে। সে সময় থেকে এখন আমরা যে সময়ে এসে পৌঁছেছি, তাতে চারটি প্রধান ফ্যাক্টর আমাদের প্রকৃতির কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। এ চার ফ্যাক্টরের প্রথমটি হচ্ছে জনসংখ্যার চাপ। দ্বিতীয়টি দ্রুত নগরায়ণ, তৃতীয়টি শিল্পায়ন প্রক্রিয়া এবং চতুর্থটি হচ্ছে ইলেকট্রনিক যোগাযোগ মাধ্যমের উৎপাত।
আজকের বাংলাদেশের যে ভৌগোলিক অংশ, এতে তিন-চারশ বছর আগে জনসংখ্যা ছিল দুই কোটি। একশ বছর আগে হয়তো ছিল তিন কোটি। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় সংখ্যাটি হলো চার কোটি। ১৯৭১ সাল আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের সময় ছিল সাড়ে সাত কোটি। গত চার দশকে তা বেড়ে ১৮ না ২০ কোটিতে পৌঁছেছে তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। এর মধ্যে প্রায় এক কোটি মানুষ অভিবাসী হয়ে মধ্যপ্রাচ্য, দূরপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন্ন অঞ্চলে অবস্থান করছে।
এ বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য চাই খাদ্য, বাসস্থান, কর্মসংস্থান। খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে প্রকৃতিনির্ভর কৃষিব্যবস্থা পরিণত হয়েছে প্রকৃতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া একটা ব্যবস্থায়। বাংলাদেশে এক সময় পাঁচ থেকে সাত হাজার প্রজাতির যেসব ধান প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে উৎপাদিত হতো, তা এখন অল্প কয়েকটি উচ্চফলনশীল ধানের জাতে এসে ঠেকেছে। আমন ধান ছিল আমাদের প্রধান ফসল। প্রাকৃতিক বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল ছিল ওই ধান। সাধারণত উঁচু জমিতে হতো রোপা আমন। চাষের জমির মাঝে-মধ্যে থাকত বহু ডোবা বা ডোবা আকৃতির গর্ত। বৃষ্টির পানি উঁচু আলের মাধ্যমে জমিয়ে রাখা হতো। ধানের সঙ্গে বিভিন্ন্ন প্রজাতির ছোট মাছ পাওয়া যেত প্রচুর। ধানগাছের গোড়ার শ্যাওলা বা পোকামাকড় হতো মাছের খাদ্য। বর্ষার শেষে ওইসব ডোবা থেকে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত।
অপেক্ষাকৃত নিচু জমিতে ছিটানো আউশ ও আমন ধান হতো। বর্ষার পানি এসে জমিগুলোকে ডুবিয়ে দিত। এ ধরনের জমিতে পাটও বোনা হতো। মাঠবহুল জনপদে গ্রামগুলো স্থাপিত হতো অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে যা সাধারণ বর্ষায় ডুবত না। আর খুব নিচু বা বিলাঞ্চলে মাছই ছিল প্রধান ফসল। শুকনো মৌসুমে পুরো বিলটি শুকাত না। কিন্তু যখন শুকিয়ে আসতে থাকত, তখন ঘটা করে মাছ ধরার উৎসব চলত।
আমন ধান কাটা হতো পৌষ মাসে, তখন নবান্ন উৎসব হতো। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস ছিল ফল-ফলাদির মাস। আশ্বিন-কার্তিক মাস ছিল হিন্দুদের পুজোর উৎসব। কাশবনে ছেয়ে যেত নদীর চর ও তীর। এ ছিল ষড়ঋতুর বাংলাদেশের সাধারণ চেহারা, আজ থেকে চার পাঁচ দশক আগেও। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামবাংলার চেহারা ও কর্মতৎপরতা বদলে যেত। গ্রামীণ উৎসগুলোও ছিল ঋতুবৈচিত্র্যকে কেন্দ্র করেই।
এতকিছু কথা বলছি এ কারণে যে, এখন এ ঋতুবৈচিত্র্যের দেখা মেলে বিভিন্ন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। সেখানে ষড়ঋতুকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। এখনো ঋতু পরিবর্তন হয় ঠিকই; কিন্তু তা উপভোগ করার সময় যে কারও নেই। শহুরে নাগরিকদের তো নেই-ই। আগে একটি ফসলের পর আরেকটি ফসল পর্যন্ত জমি খালি পড়ে থাকত। মানুষের হাতে কাজ থাকত না। সেসব খালি জমিতে, কর্মক্লান্ত মানুষ নানা উৎসব ও আয়োজনে মেতে উঠত। এখন আর আমন ধান কাটার পর মাঠ খালি পড়ে থাকে না। আমরা বোরো ধান চাষ শুরু করি। কারণ, এ সময় প্রকৃতি থেকে পানি পাওয়া যায় না। বোরো ধানের সেচ আসে মূলত ভূগর্ভস্থ পানি থেকে। এর প্রভাব ভূপৃষ্ঠেও পড়েছে। আগে যে অবারিত মাঠ দিগন্ত ছুঁয়ে যেত, সেখান এখন কিছুদূর পরপর শ্যালো টিউবওয়েলের জন্য নির্মিত ছোট ছোট ঘর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। অর্থাৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে বটে, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির দৃশ্যমান অদৃশ্য অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
তারপরও এখনো প্রকৃতির যে অপার সৌন্দর্য রয়ে গেছে, সেটা উপভোগ করতে আমরা কি উদগ্রীব? এখনো নদীরপাড়ে বড় কোনো গাছের নিচে দাঁড়ালে নদীটির অপরূপ শোভা দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের কি সময় আছে তা দেখার? আমরা কখনো কখনো নদীপাড়ে ঘুরতে যাই বটে, ব্যস্ত হয়ে পড়ি স্মার্টফোন নিয়ে। তরুণ সম্প্রদায়কে দেখা যায় সবসময় মাথা নিচু করে দুই আঙুল দিয়ে কী যেন করছে! এভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়তো যোগাযোগ বৃদ্ধি হয়েছে; কিন্তু হারিয়ে গেছে মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মিক যোগাযোগ, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির যোগাযোগ।
অধিক জনসংখ্যার জন্য খাদ্য উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তা যেমন বেড়েছে, তেমনই বেড়েছে তার কর্মসংস্থানের চাহিদা। বেড়েছে অর্থনৈতিক উন্ন্নতির সোপান, বেয়ে ওপরে ওঠার প্রতিযোগিতা। এ কারণে শুরু হয়েছে শিল্পায়ন। বাংলাদেশের শিল্পায়নকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এবং এটি অবশ্যই জাতির উন্নতির জন্য প্রয়োজন। কিন্তু তা করা হচ্ছে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে। কলকারখানার বর্জ্য দূষিত করছে জলাশয় ও নগরকে। যানবাহনের শব্দ পীড়িত করছে আমাদের স্নায়ুশক্তিকে। বাতাসের ধূলিকণা আক্রান্ত করছে আমাদের ফুসফুসকে।
একইসঙ্গে বিশ্বজুড়ে চলছে নগরায়ণ প্রক্রিয়া। উদ্ভিদের জঙ্গল কেটে কংক্রিটের জঙ্গল তৈরি হচ্ছে। ছোট ছোট খুপরিতে বসবাস করছে নগরের অধিকাংশ মানুষ। একটি বাড়ির জানালা খুললে তা পাশের বাড়ির দেওয়ালে আঘাত করে। নগরের বাসস্থান এখন যেন গড়ে উঠছে কেবল রাতে ঘুমানোর জন্য। বাকি সময় নগরের সবাই কেবল ছুটছে আর ছুটছে। রান্না ঘরের পাশে একটি নতুন ফুল ফুটল কিনা, ফুটলে তা কী ফুল, তা দেখার সময় নেই কারও। আমাদের দেশের নগরীতে এক সময় যতটুকু খোলা জায়গা ছিল, যেখানে মানুষ দাঁড়িয়ে একটু দম নিতে পারত, সেগুলোও হারিয়ে যাচ্ছে অবকাঠামোর তলায়। আগে দিনশেষে কর্মক্লান্ত মানুষ খোলা মাঠে হাঁটতে যেত, নদীপাড়ে বেড়াতে যেত, অল্পবয়স্ক তরুণরা ফুটবল নিয়ে মাঠে নেমে পড়ত; এখন তা আর সম্ভব হয় না।
আমরা ক্রমান্বয়ে প্রকৃতির সঙ্গে যোগসূত্র হারিয়ে ফেলছি। তারপরও নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে কিছু জায়গায় ঘটা করে বেড়াতে যাওয়ার প্রচলন হচ্ছে। কিন্তু সেটাও সীমিত। আমাদের কাছে কক্সবাজার বোধকরি প্রধান আকর্ষণ। কেউ কেউ যান সুন্দরবনে। আর যারা একটু সচ্ছল, তারা থাইল্যান্ডের ব্যাংকক, ইন্দোনেশিয়ার বালি কিংবা ভারত ও নেপালের শৈল শহরে যায়। সেসব দর্শনীয় স্থানও এখন কংক্রিটের অবকাঠামোকেন্দ্রিক।
এখন আসলে সময় এসেছে প্রকৃতির সঙ্গে যোগাযোগ বা যোগসূত্র বাড়ানোর। বাংলাদেশের প্রকৃতি এখনো সুন্দর। অভ্যন্তরে এখনো অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা রয়েছে। সেসব আনুষ্ঠানিক পর্যটনস্থল হওয়ারও দরকার নেই। প্রতিটি গ্রামের আশপাশেই চমৎকার জায়গা রয়েছে বেড়ানোর জন্য। আমরা সময় পেলেই সেখানে যেতে পারি। আর বিভিন্ন্ন উপলক্ষ্যে পর্যটন স্থলগুলোতে গিয়ে সৌন্দর্য উপভোগ করলে যেমন প্রকৃতির সঙ্গে যোগাযোগ বাড়বে, তেমন দেশীয় পর্যটন শিল্পের বিকাশেও সহায়ক হবে। সাম্প্রতিক সময়ে দেখছি খবরের কাগজগুলো দেশের ভেতরেই বেড়ানোর জায়গা চিহ্নিত করছে। তাদের এ প্রচেষ্টাকে আমি স্বাগত জানাই।
শেষ করতে চাই এ কথা বলে, ‘একটি ধানের শীষের ওপর একটি শিশির বিন্দু’ দেখার মানসিকতা উজ্জীবিত করতে হবে। তাতে মানুষ ও প্রকৃতি উভয়ই ভালো থাকবে।
লেখক : পরিবেশ বিশেষজ্ঞ; ইমেরিটাস অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
