|
ফলো করুন |
|
|---|---|
নির্মল পরিবেশে চনমনে মন। সবুজ চারপাশ দেহে জোগায় প্রফুল্ল বাতাস। মানুষ তার চারপাশ নিয়ে বাঁচে। আলো, হাওয়া, গাছের ছায়া, মাটির ঘ্রাণ মানুষকে সতেজ করে তোলে। প্রকৃতির বৃহৎ আঙ্গিনায় প্রাচীন মানুষ বসতি গড়েছিল শ্যামল আফ্রিকায়। তারপর বরফ যুগে হেঁটে, সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মানুষ ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। বনে বাদাড়ে বৃক্ষচারী যাযাবর মানুষ সমতলে আবাদ শিখে প্রথম থিতু হয়। ফসলের মাঠের পরিচর্চায় সমবেত বাসভূমি হিসাবে গ্রামের পত্তন ঘটে। ফলে মানুষের জীনের গভীরে খোলামেলা প্রাকৃতিক পরিবেশের উপযোগিতা রয়েছে। মানুষের কান নদীর কলকল ধ্বনির সঙ্গে অভ্যস্থ। আমাদের চোখ সবুজ দিগন্তে খুঁজে পায় অনাবিল প্রশান্তি। গ্রামীণ মানুষ নদীভাঙন, খরা বন্যায় সর্বস্বান্ত হয়ে পাড়ি জমায় দশ ফুট বাই দশ ফুটের বস্তিতে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয়। জীবিকার তাগিদে ওয়েল্ডিং, ফার্নেসচুল্লিতে পর্যাপ্ত প্রটেকশন ছাড়াই কাজ করে। ফলে অতিরিক্ত তাপের প্রকোপে ক্ষতিগ্রস্ত হয় চোখ, চামড়াসহ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। অস্বাস্থ্যকর পয়োনিষ্কাশন, দূষিত খাবার জল শহুরে জনস্বাস্থ্যকে হুমকিতে ফেলেছে। আমাদের গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ ভালো থাকলেও লোভী মানুষের হাতে খুন হচ্ছে নদী। ভরাট হচ্ছে খাল। উজাড় হচ্ছে বন। ফলে শহর বন্দরের উৎপন্ন কার্বনকে শোষণের পর্যাপ্ত বৃক্ষ নেই। আবার বাতাসকে অক্সিজেন সমৃদ্ধ করার ক্ষমতা গাছ কেটে নগরায়ণের ফলে ব্যাহত হচ্ছে ক্রমাগত। কংক্রিটের জঞ্জালে গ্রিলের খাঁচায় বেড়ে ওঠা শিশুরা চিড়িয়াখানা উদ্যানে যাচ্ছে বন্যপ্রাণী দেখতে। প্রকৃতির সান্নিধ্যবঞ্চিত শহুরে শিশুর মানসিক বিকাশ বড় আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। এসব শিশুর খাদ্যাভ্যাসে প্রাকৃতিক জৈবখাদ্যের চেয়ে কৃত্রিম রাসায়নিকের মুখরোচক স্বাদে আসক্তি বয়ে আনছে ডায়াবেটিস, কিডনিসহ নানা জটিলতা। শহর পরিকল্পনায় নেই সবুজ মাঠ, খোলা প্রান্তর। এমনকি নগরায়ণের প্রাথমিক নীতি মানা হয়নি। ফলে একচতুর্থাংশ রাস্তা, একচতুর্থাংশ খোলা ময়দান, একচতুর্থাংশ আবাসিক, একচতুর্থাংশ বাণিজ্যিক এলাকা না রেখে শহর বেড়েছে বিশৃঙ্খলভাবে। ফলে রাস্তায় জ্যাম, গাড়ির কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন আকাশ, ধূলিমাখা বাতাস গ্রাস করেছে পথিকের ফুসফুস। বাড়ছে অ্যাজমা, ব্রংকাইটিস, হাঁপানি রোগী। দ্রুতগতির জীবনে তাল সামলাতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাড়ছে। বাড়ছে আরোহী, বাড়ছে যাত্রী, কমছে পথিক, কমছে হাঁটুরে মানুষ। এমনকি সাইকেল আরোহীও কমছে। শহরে আলাদা সাইকেল লেন চিহ্নিত করতে পারেনি নগর কর্তৃপক্ষ। ফুটপাতকে পথিকের চারণভূমি না করে হকারদের বিক্রয় কেন্দ্র করা হয়েছে। ফলে পথিককে প্রলোভন দেখিয়ে বাধ্য করা হচ্ছে ক্রেতা হতে। ভোগবাদ এখন শপিংমলকে নিয়ে এসেছেন বাড়ির পাশের গলিতে। বাড়ছে পলিথিন ব্যবহার। বাড়ছে জলাবদ্ধতা। বাড়ছে মশা-মাছি। ছড়াচ্ছে ডেঙ্গি, ডায়রিয়া। দুর্গন্ধে গলির পরিবেশ হচ্ছে দূষিত। ফ্লোর এরিয়া রেশিও না মেনে বেড়ে ওঠা সুউচ্চ দালান আলো বাতাসের চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করছে। পরিবেশ হয়ে ওঠে স্যাঁতসেঁতে। নচিকেতার গানে বিষয়টি ধরা দিয়েছে এভাবে, ‘ভিড় করে ইমারত আকাশটা ঢেকে দিয়ে চুরি করে নিয়ে যায় বিকেলের সোনা রোদ, ছোট ছোট শিশুদের শৈশব চুরি করে গ্রন্থকীটের দল বানায় নির্বোধ’। কিশোর কিশোরীর শারীরিক বিকাশের জন্য খেলার মাঠ নাই। সাংস্কৃতিক বিকাশে উন্মুক্ত মঞ্চ নাই। অন্যদিকে বহুজাতিক ইলেকট্রনিক কোম্পানিগুলো বাচ্চাদের হাতে তুলে দিয়েছে ট্যাব, লেপটপ, মোবাইল অ্যাপস। এসবের ক্ষতিকর রশ্মি বাচ্চাদের চোখে তুলে দিচ্ছে চশমা। কানের করছে মারাত্মক ক্ষতি। এসব ইলেকট্রনিক গেজেট দ্রুত নষ্ট হয়ে বাড়াচ্ছে ইলেকট্রনিক বর্জ্য। এসবের সার্কিটে ব্যবহৃত লেডসহ অন্য মেটাল দূষিত করে জলাধার ও মাটি। ফলে উর্বরতা হারিয়ে ফসল উৎপাদন কমছে। শিল্পের দূষিত কেমিক্যাল মিশে নদী হারাচ্ছে মাছসহ জলজ প্রতিবেশ। ফলে ঘাটতি হচ্ছে আমিষের। দেখা দিচ্ছে পুষ্টিহীনতা। প্রাদুর্ভাব ঘটছে রোগজীবাণুর। অপরিকল্পিত নগরায়ণের দমবন্ধ পরিবেশ উন্নয়নে চাই নাগরিক সুবিধার বিকেন্দ্রীকরণ। শহরের স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাসেবা, পরিবহণসেবাকে এককেন্দ্রিক থেকে বহুকেন্দ্রিক করা চাই। শহরে ক্রমবর্ধমান জনচাপ কমাতে নাগরিক সেবা গ্রামীণ জনপদে ছড়িয়ে দিতে হবে। বহুমাত্রিক কৃষি বা জৈবপ্রযুক্তিনির্ভর আবাদে উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তিকে কাজে লাগানোর উদ্যোগ চাই। এ ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ হতে পারে স্মার্ট সমাধান। তবে বিবেচনায় রাখতে হবে, গ্রামকে কংক্রিটের আবর্জনা না করে নির্মল প্রকৃতির সহাবস্থান বজায় রেখে শিক্ষাস্বাস্থ্য খেলাধুলা গ্রামীণ সংস্কৃতিকে গ্রামের মানুষের কাছে সহজলভ্য করা চাই। তাহলেই শহরে কার্বন পদচিহ্ন কমবে, পরিবেশ দূষণ কমবে। ঢাকা শহরের নাগরিক সুবিধার উৎসমুখ এককেন্দ্রিক নয়। নানা সংস্থার সমন্বয়বিহীন, অপরিকল্পিত খোঁড়াখোঁড়ি রাস্তায় জনদুর্ভোগ তৈরি করে। বাতাসকে করে ধুলোবালিময়। পরিবেশ হয়ে ওঠে অস্বাস্থ্যকর। এমনকি আকস্মিক রাস্তা খোঁড়খোঁড়ি শুরু হয় কোনোরূপ পূর্ব অবহিতকরণ ছাড়াই। ফলে নাগরিক বিকল্প খুঁজে নেওয়ার সুযোগ বঞ্চিত হয়ে ধুলো-দূষণের শিকার হয়ে পড়ে। রাস্তাঘাটে যানজটে দীর্ঘসময় অবরুদ্ধ নাগরিক একটু খোলা হাওয়া, খোলা মাঠ, খোলা আকাশ চায় প্রাণভরে শ্বাস নেওয়ার জন্য। নন্দিনী কেমন ভালোবাসে রঞ্জনকে? এ প্রশ্নের জবাবে রবীন্দ্রনাথ নন্দিনীকে বলিয়েছিলেন, ‘জলের ভিতর নৌকোর হাল যেমন করে ভালোবাসে আকাশের পালকে, তেমনি দমবন্ধ দূষিত বাতাস, দুর্গন্ধ পানিতে আক্রান্ত নাগরিক ভালোবাসে নির্মল প্রকৃতিকে।’ নগরে যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত নাগরিক উদ্যান খোঁজে, সবুজ খোঁজে। কিন্তু নগর কর্তৃপক্ষ অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যস্ত। বনস্পতির ছায়ার চেয়ে ডেভেলপার বহুতল ভবনের ছায়ার মায়ায় আটকে আছে। সিএস ম্যাপের ঢাকায় অনেক খাল, বিল ছিল। আবাসন চাপে সেসব বিলুপ্ত হয়েছে আগেই। এখন নতুন শহর স্থাপনে বনস্পতির ছায়া চাই। নাগরিকের জন্য নির্মল সবুজবীথি দেহমনের সুস্থতার জন্য অপরিহার্য।
নগরে গাছ অতি অল্প। যাও আছে তার পাতা ধুলোয় ধূসর। ফলে সালোকসংশ্লেষণ বাঁধগ্রস্ত। নগরের বাতাসে অক্সিজেন জোগান ক্রমহ্রাসমান। যান্ত্রিক চাকা ঘুরাতে জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়ে তৈরি হচ্ছে ক্ষতিকর কার্বন ডাই-অক্সাইড। আমরা বৃক্ষ কেটে কংক্রিটের জঞ্জালে আগ্রহী।
সবুজ ঘাস ঢাকা পড়ে সিমেন্টের ঢালাইয়ে। মাটির কি শ্বাসকষ্ট হয় না? বৃষ্টির জল মাটি চুঁইয়ে ভূগর্ভে গেলেই না তবে ওয়াটার টেবল রিচার্জ হবে। ঢাকা শহরের ভূগর্ভস্থ সব পানি প্রায় খালি হয়ে গেছে। বর্ষার জল ঢালাই ভেদে অক্ষম হওয়ায় মাটি সজীবতা হারাচ্ছে। পাখিরা যেমন আকাশের নীড় চায়, মাটিও তেমন বৃক্ষমূল চায়। পরিবর্তে মাটিকে দিচ্ছি প্রিকাস্ট কিংবা সিটু পাইলিং। মহানগরে ট্রাফিক পরিবহণের ট্র্যাক হিসাবে কাজ করা রাস্তার প্রধান দায়িত্ব। কিন্তু ঢাকার রাস্তায় কি না হয়? মুদি দোকানের মাল, হোটেলের চুলা, হার্ডওয়ারের দোকানের পাইপ, ভাঙ্গারি/কারখানার গোডাউন ইত্যাদিসহ বহুল ব্যবহারে ঢাকার রাস্তার পরিবেশকে অসহনীয় করে তুলছে। আমাদের রাস্তা না পরিবহণ উপযোগী, না মানুষ হাঁটার উপযোগী। ফুটপাত বেদখল। হাঁটতে না পেরে নাগরিক অকালেই প্রবীণ হয়ে যাচ্ছে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে। আমাদের মাঠ ধুলোময়, ঘাসশূন্য। রাজধানীর হাতেগোনা কয়েকটি ওয়ার্ডে এখনো মাঠ রয়েছে। তার জন্য নগর কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ। তবে মাঠগুলো বর্ষায় কাদায় প্যাঁকপ্যাঁক, শুষ্ক মৌসুমে ধুলোয় অন্ধকার। তা সত্ত্বেও শিশুদের চোখে খুবই আশ্চর্য সবুজ একদৃষ্টি আছে। যা দিয়ে ধুলোর আবছায়াকে ভ্রুকুটি দেখিয়ে শিশুদের খেলা চলমান। একইসঙ্গে অনেক কিশোর দলের নানাবিধ খেলা দেখা যায় এসব মাঠে। কেউ খেলছে ক্রিকেট, কেউ ফুটবল, কেউ দৌড়াচ্ছে। আমাদের সবুজ বাচ্চারা ঘাসের অভাব পরোয়া করে না সত্যি কিন্তু আগামী নাগরিকের ফুসফুস নির্মল রাখতে দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রয়োজন। ঘাস লাগিয়ে যথাযথ পরিচর্যা চাই। নিয়মিত পানি দেওয়া চাই। নগরের পানি সরবরাহকারী অনেক পাইপ/ জলকল বিকল হয়ে পানির অপচয় হচ্ছে। তার কিছু অংশ মাঠে দিলেই বিবর্ণ ঘাসকে সবুজ করা সম্ভব। সড়ক-মহাসড়কের দুপাশে সবুজ ছায়াবীথি করার দায়িত্ব কেবল বন বিভাগে না ছেড়ে যার রাস্তা তাকেই এগিয়ে আসতে হবে। নগরে সবুজায়নে বড় উদাহরণ হাতির ঝিল। এমন উদ্যোগ ঢাকার অন্য এলাকাতেও চাই। বড় হয়ে যাচ্ছে নগর। এখনই সময় ত্রিমুহিনী, দক্ষিণগাঁও, ঢাকা উদ্যান, পূর্বাচলের আশপাশকে বৃক্ষে আচ্ছাদিত করা। নগরায়ণ দানবকে বাড়তে দিতে হবে নিয়ন্ত্রণের শেকলে, যাতে সে পরিবেশ বান্ধব হয়ে উঠতে শেখে। এ শিক্ষা বড় কঠিন শিক্ষা। সফলতায় চাই পরিবেশ আইনের যথাযথ প্রয়োগ। বিল্ডিং কোড, ফায়ার সেফটি বিধানসহ পরিবেশ ছাড়পত্রের অনুশাসন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে প্রতিটি বাড়ির প্ল্যান অনুমোদন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বড় বেশি প্রয়োজন পাইলিং শুরুর সময় হতেই নির্মাণ কাজের নিবিড় তদারকি। পরিবেক্ষণকারী/তদারকি সংস্থাকে দক্ষ জনবলে সজ্জিত করা প্রয়োজন। ত্রিশ ফুট রাস্তা দেখিয়ে পঁচিশ শতাংশ জায়গা ছেড়ে প্ল্যান অনুমোদন করে কাগজে। বাস্তবে রাস্তা বিশ ফুটের কম চওড়া, খালি জায়গা না রেখে নির্মাণ কাজ শেষ করার ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। ভয়েডের স্থলে সিঁড়ি নির্মাণ করে বায়ু চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের বিবেচনায় পরিবেশ বান্ধব স্মার্ট মানবিক নগরী রাখতে হবে। স্বাস্থ্যসেবাকে নাগরিকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। উদাহরণ কিন্তু আছে। ডায়াবেটিস হাসপাতাল এখন সব জেলায় এমনকি ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে শাখা চালু করে সেবাকে নাগরিকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। সরকারি বড় হাসপাতালগুলো এভাবে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে পারলে রাস্তায় যানজটসহ কার্বন নির্গমন কমানো যেত। শহুরে হয়ে মানুষ ভুলে গেছে খালি পায়ে হাঁটার আনন্দ। ভুলে গেছে নদীর জলে পা ভিজানোর স্বাদ। তুরাগ, বুড়িগঙ্গা, বালু নদীকে স্বাভাবিক প্রবাহে ফিরিয়ে আনতে হবে। নদী, খাল নগরদেহের ধমনি, শিরার মতো কাজ করে। দূষিত পয়োবর্জ্য টেনে শহরকে পরিচ্ছন্ন সতেজ প্রাণবন্ত রাখে। আবাসনের চাহিদা সর্বকালেই ছিল। আবাসন ব্যবসাও থাকবে। তাই বলে পরিবেশকে হত্যা করে নয় বরং পরিবেশ বান্ধব নগরায়ণে মনোযোগ দেওয়ার সময় এসেছে। ভোগ কমাতে হবে, লোভ কমাতে হবে, তাহলেই বর্জ্য কমবে, কমবে মানসিক অশান্তি। দিনের আলোর অধিক ব্যবহারের উপযোগী ফ্ল্যাট বানাতে হবে। ভারী পর্দা কমিয়ে জানালা খোলা চাই। আকাশ দেখা চোখ চাই, কালপুরুষে চোখ রাখার মতো মন চাই।
শিকারি মানুষ যাযাবর থেকে থিতু হয়ে আবাসী হয় জমি আবাদ করার পর। কৃষি মানুষকে দলবদ্ধ হয়ে বাঁচতে শেখায়। ফলে গড়ে ওঠে গ্রাম। আবাদে জল অপরিহার্য বিধায় গ্রামের অবস্থান ছিল জলাধার, খাল বা নদীর ধারে। উৎপাদিত শস্য বিপণনের প্রয়োজনে সাপ্তাহিক পণ্য বিনিময় প্রথার প্রচলন ঘটে। শুরু হয় বাণিজ্য। পণ্য দূর-দূরান্তে পরিবহণের প্রয়োজনে নদীপথের পাড়ে গড়ে ওঠা হাটকেন্দ্রিক গঞ্জের উদ্ভব হয়। যা কালক্রমে নগরে পরিণত হয়। নগরে তিনটি সুবিধা সুনিশ্চিত সেই প্রাচীন কাল থেকে। পরিবহণ উপযোগী, রাত্রিকালীন আলোসমৃদ্ধ রাস্তা, পয়োনিষ্কাশনসহ জল সরবরাহ এবং পৃথক আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা নির্ধারিত করে দেওয়া। একইসঙ্গে খোলা মাঠ, উন্মুক্ত মঞ্চ মানবিক বিকাশে সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে এসব মৌলিক সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোকে ফিরে তাকাতে হবে মৌলিক সেবা প্রদান কতটা নাগরিক বান্ধব তার দিকে। নগরের পরিবেশ কতটা মানসিক বিকাশ সহায়ক সেটাও বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে গেলে স্মার্ট নগরী অপরিহার্য। স্মার্ট নগরীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে স্মার্ট প্রযুক্তিতে দক্ষ জনবল প্রয়োজন। রাস্তাঘাটের পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে চাই সমন্বিত উদ্যোগ। নগরকে দিতে হবে সবুজের সমারোহ। ঢাকা শহরের খাস/সরকারি সংস্থার অব্যবহৃত জমি উদ্ধার করে নতুন উদ্যানের প্রকল্প নিতে হবে রাজউক বা গণপূর্ত অধিদপ্তরকে। নগরীর ফুসফুস রমনা উদ্যান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বাহাদুর শাহ পার্ক, ওসমানী উদ্যান, গুলশান পার্ককে নাগরিক বান্ধব করা প্রয়োজন। একইসঙ্গে বেসরকারি আবাসন প্রকল্পে উদ্যান, মুক্ত মঞ্চ রাখা বাধ্যতামূলক করা চাই। খোদ সরকারি আবাসন প্রকল্পে নক্সায় থাকা খেলার মাঠ, খোলা প্রান্তর প্রভাবশালীদের স্বার্থে প্লট করে বরাদ্দের অভিযোগ নব্বই দশক থেকেই শোনা যাচ্ছে। এসব অনিয়ম থেকে বের হতে না পারলে পরিবেশ সহায়ক নগর দূর কল্পনাই থেকে যাবে।
লেখক : কবি, পরিবেশবিদ
