Logo
Logo
×

২ যুগে যুগান্তর

সংস্কৃতি প্রসঙ্গে

Icon

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সংস্কৃতির বিষয়টি বিশেষ রকমের বিবেচনার দাবি রাখে। একাধিক কারণে। ১. সংস্কৃতি আসলে সভ্যতার চেয়েও বড়। সভ্যতার উত্থান-পতন আছে, সংস্কৃতি সতত প্রবহমান, দৃশ্যমানরূপে কখনো কখনো, অন্তর্গতভাবে অধিকাংশ সময়ে। ২. সংস্কৃতিতে থাকে জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়। সংস্কৃতিকে বলা যায় প্রবৃত্তি ও পরিবেশের সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্বের সামাজিক ও নান্দনিক প্রকাশ। সেখানে আমাদের সবলতার-দুর্বলতার হদিস পাওয়া যাবে। পাওয়া যাবে সৃষ্টিশীলতার পরিচয়। সংস্কৃতির ভেতরে কার্যকর মতাদর্শ সমাজের সর্বত্র বিস্তৃত থাকে। ৩. সংস্কৃতির দ্বারা আমরা যেমন আচার-আচরণের ক্ষেত্রে, তেমনি আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্রেও প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত হই। সেটা ব্যক্তির ইচ্ছা-নিরপেক্ষভাবেই ঘটে থাকে। তাই সংস্কৃতি বিষয়ে যত আলোচনা ততই মঙ্গল। আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা অনেক বিষয়ে সচেতন হবো, অগ্রগতির পথ ও পাথেয় বিষয়েও সহায়তা পাব।

শ্রেণি ও শ্রেণি সম্পর্কের কথাটা খুবই পরিষ্কার, সংস্কৃতি নিয়ে সাধারণত আলোচনা করা হয় না। আমাদের শ্রেণিবিভক্ত সমাজের সংস্কৃতিও বিভাজিত অবস্থাতেই রয়েছে। একদিকে আছে জনসংস্কৃতি, অপরদিকে বিত্তবানদের সংস্কৃতি। এ দুই ধারা কেবল যে সমান্তরালে চলেছে তা নয়, পরস্পরবিরোধী অবস্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

জনসংস্কৃতি লোকসংস্কৃতির কাছাকাছি যদিও, তবু তারা মোটেই অভিন্ন নয়। জনসংস্কৃতি শ্রেণিবিভাজনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে অস্বস্তিবোধ করে, শ্রেণি-বিভাজনকে সে মেনে নিতে চায় না, পারলে তাকে ভাঙবে এমন আকাঙ্ক্ষা রাখে। অপরদিকে লোকসংস্কৃতি কিন্তু শ্রেণিবিভাজনকে মেনে নেয়। মেনে নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে হয়তো, কিন্তু বিক্ষুব্ধ হয় না। বিদ্রোহী তো নয়ই। লোকসংস্কৃতির নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যই জানিয়ে দেয় যে, ভদ্রসংস্কৃতি বলে আলাদা একটা সংস্কৃতি আছে, যেটি ভদ্রলোকদের এবং লোকসংস্কৃতি হলো ভদ্রলোকদের অধীনস্থ সাধারণ লোকের সংস্কৃতি। লোকসংস্কৃতি নিয়ে বাণিজ্য চলে, তার উপাদান ও উৎপাদন ভদ্রলোকদের কাজে লাগে, উৎপাদিত জিনিসপত্রকে পণ্যে পরিণত করে বিদেশেও পাঠিয়ে দেওয়া যায়। অপরদিকে জনসংস্কৃতি থাকে জনজীবনে প্রোথিত, তাকে নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করা দুঃসাধ্য। জনসংস্কৃতিতে জনমানুষের সৃষ্টিশীলতা ও অগ্রগমনের আকাঙ্ক্ষা দুটোই কাজ করে থাকে। এক্ষেত্রে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদকে আমরা স্মরণ করব, তিনি কিন্তু লোকসংস্কৃতির চর্চা করেননি, প্রকারান্তে তিনি জনসংস্কৃতির সাহিত্যিক প্রকাশকে উদ্ধার করার কাজেই নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। এই পার্থক্যটা যেন না ভুলি।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, লোকসংস্কৃতির চর্চা এখন আর আগের মতো জমছে না। সমগ্র জনগণের অখণ্ড সংস্কৃতিও আজ আর নেই। কিন্তু সচেতন মানুষদের ভেতর আকাঙ্ক্ষা আছে ঐক্য সৃষ্টির এবং এমন একটি সংস্কৃতি গড়ে তোলার, যেখানে বৈচিত্র্য থাকবে অবশ্যই, কিন্তু বিভেদ থাকবে না।

লোকসংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ভদ্রলোকরাও এখন তেমন একটা স্বস্তিতে নেই। কারণ ভদ্র শ্রেণিটি এখন দু’টুকরো হয়ে গেছে। সেই দু’ভাগ হওয়াটা নদীর এপার ওপারের অবস্থানের চাইতেও বাস্তবিক। উচ্চবিত্ত এখন উত্তরাভিমুখী, তার ‘আধুনিক’ অংশ এখন আর পহেলা বৈশাখের ধার ধারে না, তারা থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপন করে থাকে। তাদের দাপটে সাধারণ মানুষ কিছুটা কাতর অবস্থায় রয়েছে, মনে হয় কালে কালে আরও কাতর হবে, যদি না তারা রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হয়ে অখণ্ড এক জনসংস্কৃতি গড়ে তোলে। ওই কাজটাতে হাত লাগানো আমাদের আশু কর্তব্য, সমষ্টিগত স্বার্থে।

ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে, ভদ্রলোকদের ভেতর যারা অতিশয় ভদ্র অর্থাৎ অতিরিক্ত আধুনিক তারা আর লোকসংস্কৃতির চর্চা ও উৎসবে সন্তুষ্ট থাকতে পারছে না, তারা আয়োজন করছে আন্তর্জাতিক ফোক ফেস্টের, যার আসর বসছে আর্মি স্টেডিয়ামে। পাশাপাশি সাহিত্যের ব্যাপারে লিটারারি ফেস্ট-এর আয়োজনও চলছে। সংবেদনশীল মানুষদের কারও কারও আশঙ্কা এ রকমের যে, সেদিন হয়তো দূরে নয়, আধুনিক বাংলাসাহিত্যের চর্চা যেদিন পুঁথিসাহিত্যের চর্চায় পরিণত হবে এবং নতুন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদদের প্রয়োজন হবে এ সাহিত্যের নমুনা উদ্ধার করার জন্য। ভরসা করি সেটা ঘটবে না, কেননা বাঙালি যতদিন বেঁচে আছে, ততদিন বাংলাসাহিত্যের বিকাশ অব্যাহত থাকতে বাধ্য। তবে আক্রমণ যে আসবে সেটা মিথ্যা নয়।

এ আক্রমণ বিশ্বায়নের, অর্থাৎ বিশ্ববাণিজ্যের। আন্তর্জাতিকতার নয়। আন্তর্জাতিকতা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের লালন ও পোষণ করে, বিশ্বায়ন সবকিছুকে একাকার করে দিতে চায়। বিশ্বায়ন বাণিজ্যিক, আন্তর্জাতিকতা সাংস্কৃতিক।

সংস্কৃতির উপাদান হিসাবে ধর্ম ও ভাষার ভূমিকায় ধর্ম থাকে এবং থাকবেই। পীড়িত মানুষকে সে আশ্রয় দেবে; অন্যদিকে আবার পীড়নকারীর জন্য সে অবলম্বন হবে শোষণের বাস্তবতাকে আচ্ছাদিত করার কাজে। বঞ্চিত মানুষদের ভেতর বিভাজন তৈরি করার ব্যাপারেও ধর্ম অত্যন্ত উপযোগী। এ উপযোগিতার পরীক্ষা অতীতে ঘটেছে, বর্তমানেও ঘটছে। অত্যাধুনিক পুঁজিবাদীরা ধর্মকে নিজেদের অধার্মিক স্বার্থে মহোৎসাহে ব্যবহার করে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মনিরপেক্ষ বলে ঘোষিত ভারতেও ধর্মের বিপজ্জনক রাজনৈতিক ব্যবহার প্রবল হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘটেছে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। কিন্তু রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার চলছে ক্রমবর্ধমান গতিতে। তার কারণ শাসনক্ষমতায় যারা আছে তারা জনগণকে দমিত এবং বিভক্ত অবস্থায় রাখতে চায়। শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাটিকে তারা আচ্ছাদিত করে দিতে চায় ধর্মের আবরণে। বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয়টিকে সরিয়ে দিয়ে তারা একটি ধর্মীয় পরিচয় দাঁড় করাতে আগ্রহী-আন্তর্জাতিক মুরব্বিদের কাছে যেমন, তেমনি স্বদেশবাসীর কাছেও। তারা মাদ্রাসা শিক্ষাকে যত উৎসাহ দেয় প্রাথমিক শিক্ষাকে তত উৎসাহ দেয় না। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের পথকে প্রশস্ত এবং জনগণের অসন্তোষকে রাজনৈতিকভাবে প্রকাশের পথকে সঙ্কুচিত করে দিয়ে এরা ধর্মীয় জঙ্গিবাদকে জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে উৎসাহিত করেছে। ধর্মীয় জঙ্গিবাদের প্রসারে এরা নিজেদের জন্য কোনো বিপদ দেখে না, কেননা ধার্মিকতার কপটাচারে এরা মোটেই অনভ্যস্ত নয়; এরা জানে যে জঙ্গিবাদীরা এদেরকে লক্ষ্যবস্তু করবে না, লক্ষ্যবস্তু করবে প্রগতিশীল ও সমাজতন্ত্রীদের, যাদের তারা নাস্তিক মুরতাদ ইত্যাদি নামে ভূষিত করতে চাইবে। শাসকশ্রেণি এবং জঙ্গিবাদীদের ভেতর মতাদর্শিক ক্ষেত্রে মৌলিক কোনো বিরোধ নেই, উভয়েই ব্যক্তিগত সম্পত্তি তথা পুঁজিবাদে বিশ্বাস রাখে, যেজন্য সমাজতন্ত্রীরা উভয়ের কাছেই প্রায় সমপরিমাণেই শত্রু হিসাবে বিবেচিত।

ভাষার ভূমিকা একাধারে ইহজাগতিক ও প্রগতিশীল। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সমাজকে বড় রকমের একটা ধাক্কা দিয়েছে এবং মধ্যবিত্তের মানসিকতায় পরিবর্তন এনেছে। ভাষা আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রের ওপর জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। সেই লক্ষ্য কিন্তু অর্জিত হয়নি। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের ভাষা যে হতে পেরেছে তা নয়। কারণটা বোঝা যায়। সেটা হলো এই যে, আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল যে পেটি বুর্জোয়ারা, স্বাধীনতার পরে তারা বুর্জোয়া হয়ে গেছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রের পুঁজিবাদী চরিত্রের কারণে বিশ্বপুঁজিবাদের ভাষা ইংরেজির সাংস্কৃতিক আধিপত্য অক্ষুণ্ন রাখতে পেরেছে। যাদের হটিয়ে দিয়ে বুর্জোয়ারা গদি দখল করেছে, ঠিক তাদের মতোই আচরণ করে চলেছে। অবাঙালি বুর্জোয়ারা বাঙালিবিদ্বেষী ছিল, বাঙালি বুর্জোয়ারা যে বাঙালি জনগণের মিত্র তা মোটেই নয়। বুর্জোয়ারা জনগণ থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য প্রকাশের এবং জনগণকে ভয় দেখার জন্য বিত্তবৈভব ও ক্ষমতা প্রদর্শনের পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে ব্যবহার না করা এবং অপব্যবহার করাকে কাজে লাগায়। জনগণ তাদের নিজেদের ভাষাকে সঙ্গে নিয়ে সেখানেই পড়ে আছে, যেখানে তারা আগে ছিল।

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা জনগণের মুক্তি আনতে ব্যর্থ হলেও পেটি বুর্জোয়াদের পক্ষে বুর্জোয়া হওয়ার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তারা বিলম্ব করেনি, ওই পথ ধরে হুড়মুড় করে ধাবমান হয়েছে। বৈধ-অবৈধ সব উপায়ে তারা জবরদখল, লুণ্ঠন, সম্পদ পাচার, কোনো কিছুই বাদ রাখেনি। রাখছে না, রাখবেও না। যেন বর্গি পড়েছে দেশে। এই হঠাৎ-ধনীরা বিদেশি বুর্জোয়াদের নকল করে এবং ইংরেজি পছন্দ করে। হিন্দি চ্যানেলের বর্ধিষ্ণু জনপ্রিয়তা সাক্ষী, হিন্দিকেও তারা ভালোবাসতে শুরু করেছে। এর পেছনে অন্য কারণ আছে, তবে একটা কারণ এই যে, হিন্দি বাঙালি জনগণের ভাষা নয়। এবং হিন্দিকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেওয়া হয়নি, উর্দুকে যেভাবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল।

বাংলাদেশে উন্নতি হয়েছে। সে উন্নতিতে রক্তের দাগ রয়েছে। কারণ, উন্নতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বৈষম্য। অতিসাম্প্রতিক একটি গবেষণা জানাচ্ছে যে, গত দুই দশকে আয়ের বৈষম্য দ্বিগুণ হয়েছে। বৈষম্যবৃদ্ধির ছাপ এখন সর্বত্র। সেটি বিশেষভাবে এবং সর্বাধিক মর্মান্তিকরূপে কার্যকর স্পর্শকাতর শিক্ষাক্ষেত্রে। তিন ধারায় প্রবহমান শিক্ষা শ্রেণিবৈষম্যের পরিচয়বহ এবং সংরক্ষক। শিক্ষা দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করবে কী, উলটো বিভক্ত করে চলেছে। এর ভয়াবহ ফল আমরা অচিরেই টের পাব।

ছাত্ররাজনীতির সুস্থ অংশের কোনো রকমে টিকে থাকার বিষয়টিও অপ্রাসঙ্গিক নয়। বিষয়টির ভেতরে অনেক খবরই লুকিয়ে আছে। এক সময় ছিল যখন ছাত্ররা জনতাকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করত। এখন সেই স্রোতটা নেই। কারণ, যে পেটি বুর্জোয়ারা রাষ্ট্রক্ষমতার দখল নিয়ে নিয়েছে তারা আগের বুর্জোয়াদের মতোই ছাত্ররা আন্দোলন করুক এটি চায় না। তারা জানে যে, আন্দোলন রাষ্ট্রক্ষমতার বিরুদ্ধে যাবে, আগে যেমন যেত। ছাত্রদের সংগঠিত হতে দেওয়ার ব্যাপারে রাষ্ট্রশাসকদের অনীহার খুব একটা স্বচ্ছ ও সুন্দর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদের নির্বাচন নিষিদ্ধ করে দেওয়াতে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নেই বললেই চলে। এমন ব্যবস্থা ব্রিটিশ আমলে তো বটেই, পাকিস্তানিদের শাসনকালেও অকল্পনীয় ছিল।

অথচ সেটাই হচ্ছে বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা। ছাত্র সংসদের অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন শিক্ষিত লোকের বস্তিতে পরিণত হয়েছে। ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকায় এসেছিলেন, অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হল ছাত্র সংসদের সংবর্ধনায় যোগ দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম ছাত্রের সংখ্যা তখন খুবই অল্প, তাদের আবাসিক হলের জন্য স্বতন্ত্র ভবন তখনো তৈরি হয়নি, সেটি তৈরি হয়েছে দু’বছর পরে, ১৯২৮ সালে। তথাপি মুসলিম হলের ছাত্র সংসদকে রবীন্দ্রনাথ গুরুত্ব দিয়েছেন।

১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এসেছিলেন ঢাকায়, কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো ঘোষণা করেন যে উর্দু এবং কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তখন প্রতিবাদ উঠেছিল উপস্থিত ছাত্রদের ভেতর থেকেই। এ ঘটনার দু’দিন পরে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরার জন্য যে প্রতিনিধি দল জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করে তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতিও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, যদিও জিন্নাহ তার উপস্থিতিটা পছন্দ করেননি, কেননা ঘটনাক্রমে ছাত্রদের ওই প্রতিনিধিটি ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। পাকিস্তানের পরবর্তী ইতিহাসে ছাত্র সংসদ ও ছাত্রদের ভূমিকা অত্যন্ত উজ্জ্বল। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সৃষ্টি-দুই কার্যক্রমেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ সম্মুখবর্তী অবস্থানে ছিল।

একাত্তরের পরেও ছাত্র সংসদকে গুরুত্ব দেওয়া হতো। যেজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৩ সালের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রদের রায় ক্ষমতাসীনদের পক্ষে যাচ্ছে না টের পেয়ে, সশস্ত্র ও অতিনাটকীয় পন্থায় ব্যালটবাক্স ছিনতাই করা হয়। এ ঘটনা দেখে বুঝতে কারই কষ্ট হয়নি যে, স্বাধীনতার সুযোগ-সুবিধা পেটি বুর্জোয়াদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। পরবর্তীতে কয়েক বছর ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয়েছে। এবং প্রতিটি নির্বাচনেই ছাত্ররা স্বৈরাচারের বিপক্ষে তাদের রায় দিয়েছে।

এরশাদের পতনের পর ‘গণতান্ত্রিক’ অর্থাৎ নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতায় আসা শুরু হয়। তারা এসেছে এবং তারা চলে গেছে। কিন্তু কোনো সরকারই ছাত্র সংসদের নির্বাচন দেয়নি। অদূর ভবিষ্যতে যে দেবে তা-ও মনে হয় না। এ ব্যাপারে এদলে ওদলে বিরোধ নেই, সবাই একদল। এরা সবাই ছাত্র আন্দোলনকে ভয় পায়। অন্যদিকে আবার তারা অত্যন্ত ঘৃণার্হ ও অতিশয় ক্ষতিকর একটি কাজ করেছে। নিজেদের আচরিত লুণ্ঠনের আদর্শকে তারা ছাত্রদের ওপর চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট রয়েছে। এ যেন পুকুরে বিষ ঢেলে সজীব মাছগুলোকে নিস্তেজ করে ফেলা। ছাত্ররা সুস্থ থাকে কী করে? তবু তারা আছে। দুর্যোগে সাড়া দেয়, আন্দোলনের ডাক শুনলে ছুটে আসে। তারা সাড়া দিয়েছিল ২০০৭ সালের ছদ্মবেশী সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে। পরবর্তীতেও তারাই চলে এসেছিল শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবি জানাতে।

শাহবাগের গণজাগরণটা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। আর সেখানেই ছিল তার সবলতা এবং দুর্বলতাও। স্বতঃস্ফূর্ততা তাকে প্রাণবন্ত ও স্বচ্ছ করেছিল; কিন্তু ওই স্বতঃস্ফূর্ততাই আবার দূরবর্তী লক্ষ্যাভিমুখী হওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ‘ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই’, ‘ফাঁসি চাই’ খুব সহজ কথা। দিনরাত এই আওয়াজই শুধু শোনা গেছে। ফলে যা ঘটবার তাই ঘটল। ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর আন্দোলন চুপসে গেল। এর ভেতর থেকে যে সত্যটি বের হয়ে এসেছে, তা হলো আন্দোলনকে তাৎপর্যপূর্ণ করতে হলে তার নিকটবর্তী দাবিটিকে যুক্ত করা প্রয়োজন চূড়ান্ত লক্ষ্যের সঙ্গে। চূড়ান্ত লক্ষ্যটা হচ্ছে সমাজবিপ্লব। স্থানীয়, সাময়িক, এমনকি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আন্দোলন হবে, কিন্তু সে আন্দোলন তখনই দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, যখন সে যুক্ত হবে সমাজ পরিবর্তনের চূড়ান্ত লক্ষ্যের সঙ্গে। দুঃখের বিষয় ওই রকমের লক্ষ্য নিয়ে প্রভাবশালী কোনো রাজনৈতিক দলকে কার্যকর অবস্থায় দেখা যাচ্ছে না। সমাজতন্ত্রীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল জাতীয়তাবাদীদের পেছনে ফেলে রেখে আরও এগিয়ে যাওয়া। সে কাজটি তারা করতে পারেনি। এটি খুবই স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত ছিল যে, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরে জাতীয়তাবাদীরা তাদের বিজয়ধ্বজা উত্তোলন করবে এবং বলবে, আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেছি, কেননা রাষ্ট্রক্ষমতা আমাদের হাতের মুঠোতে এসে গেছে। সমাজতন্ত্রীদের পক্ষে তেমন সন্তোষ প্রকাশের অবকাশ ছিল না; কিন্তু তারা নিজেদের কর্তব্য পালন করতে পারেনি, যুদ্ধজয়ের মুহূর্তটিকে ধরে রেখে সেখান থেকে সমাজবিপ্লবের দিকে দেশবাসীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তারা ব্যর্থ হয়েছে।

কেন পারল না? একটা কারণ তারা বিভক্ত এবং প্রায় ছত্রভঙ্গ দশায় ছিল। দ্বিতীয় কারণ তাদের ভেতর মতাদর্শিক স্পষ্টতা ও গভীরতা ছিল না। তারা দর্শনের চর্চা যে করেনি তা নয়, কিন্তু সে চর্চাটা ছিল যান্ত্রিক ও সীমিত। তৃতীয় একটা কারণও ছিল। সেটি হলো পরনির্ভরতা। তারা মস্কোপন্থি, পিকিংপন্থি, নকশালপন্থি ইত্যাদি হয়েছে, কিন্তু নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে মেহনতি মানুষের কাছে, বিশেষ করে কৃষকের কাছে যেতে পারেনি। কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার সাহিত্যিক জীবনের দ্বিতীয়ার্ধে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছিলেন, দুঃখের সঙ্গে যে মন্তব্যটি তিনি তার ডায়রিতে একান্তে লিখে গেছেন, সেটা হলো এই যে, ‘সিপিআই ভারতের মন বোঝে না।’ উপমহাদেশের বাম আন্দোলন সম্পর্কে এটি একটি সাধারণ সত্য। বামপন্থিরা পেটি বুর্জোয়া শ্রেণি থেকে এসেছেন। সেটাই ছিল স্বাভাবিক। তারা কঠিন আত্মত্যাগ করেছেন, ভয়াবহ নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু তারা শ্রেণিচ্যুত হতে পারেননি। পেটি বুর্জোয়া সংস্কৃতি তাদের সঙ্গ ছাড়েনি। যেজন্য মেহনতি মানুষের কাছে গিয়েও এক হয়ে যাওয়াটা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। পরনির্ভরতা ও আত্মসচেতনতা পরিহার করার ব্যর্থতা পেটি বুর্জোয়া সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য বৈকি।

বাংলাদেশ সমাজতন্ত্রীদের নেতৃত্বে স্বাধীন হবে এটাই ছিল প্রত্যাশা। তা হয়নি। হলে ভিন্ন এক বাংলাদেশ পাওয়া যেত। আর হয়নি বলেই মানুষের এমন দুর্গতি, সমাজে এত অসংগতি। স্মরণ করা যেতে পারে ১৯৫৪ সালের সংস্কৃতি সম্মেলনে লায়লা সামাদের উদাত্ত আহ্বান : ঘোমটা ছেড়ে বেরিয়ে এসো নারী। ছয় দশক ধরে দীর্ঘ সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের মেয়েরা অনেকটা অগ্রসর হয়েছে। মেয়েদের এখন কর্মক্ষেত্রের সর্বত্র দেখা যায়। তারা দেশে-বিদেশে শ্রম বিক্রি করে। মুক্তিযুদ্ধে তারা অংশ নিয়েছে। পাবলিক পরীক্ষায় তারা ভালো ফল করছে; কখনো কখনো, কোথাও কোথাও ছেলেদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ১৯২১ সালে ঢাকায় যখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন ছাত্র ছিল ৮৮৭ জন; ছাত্রী মাত্র একজন। সেই একা ছাত্রীটিও ভর্তি হয়েছিল অনার্সে নয়, এমএ-তে; কলকাতা থেকে বিএ পাশ করে এসে। বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারে মোটেই উৎসাহ দেয়নি। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংখ্যা এখন পঁয়ত্রিশ হাজার, যাদের ভেতর মেয়েদের সংখ্যা ছেলেদের প্রায় সমান। শুরুতে শিক্ষকরা মেয়েদের ক্লাসে নিয়ে আসতেন কমনরুম থেকে; পরবর্তীতে মেয়েরা এগিয়ে গিয়ে ক্লাস রুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকত শিক্ষকের অপেক্ষায়; এখন দেখা যায়, মেয়েরা আগে থেকেই এসে বসে আছে, ছেলেদেরই বরঞ্চ কখনো কখনো আড়ষ্ট বলে মনে হয়। কিন্তু ঘোমটা বোরখার কেন এমন প্রার্দুভাব, এত সব অর্জনের পরও?

কারণ মনে হয় দুটি। প্রথমটি, নিরাপত্তাহীনতা। দ্বিতীয়টি আত্মপরিচয়ের সন্ধান। বর্তমানে তৎপর পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নারীর জন্য এগোবার পথ প্রশস্ত করে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু নারীকে নিরাপত্তা দেয়নি। উলটো নিরাপত্তা হরণ করেছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা অসংশোধনীয়রূপে পিতৃতান্ত্রিক। এর কেন্দ্রে আছে অদমনীয় ভোগবাদিতা। সভ্যতার আবরণে নিজেকে যতই ঢেকে রাখুক না কেন, সে ইতর প্রাণীর চেয়েও অধিক মাত্রায় ভোগবাদী। তাই দেখা যাচ্ছে, শুধু যে ধর্ষণ তা নয়, গণধর্ষণও এখন সমানে চলছে। বাবা-মা মেয়েদের দ্রুত বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন, নিরাপত্তাহীনতার কথা ভেবে। নিরাপত্তাহীনতার তাড়ায় মেয়েরা আত্মসমর্পণ করছে; বোরখা ও হিজাবে তারা পরিচয় গোপন রাখতে চায়। একইসঙ্গে তারা জানিয়ে দিতে চাচ্ছে যে, পুরুষদের তারা চ্যালেঞ্জ করছে না, পুরুষের কাছে তারা করুণা চায়, ভিক্ষা চায় চলাফেরার স্বাধীনতাটুকু। অপমানকে মেনে নিয়ে মানরক্ষার ব্যস্ততা!

দ্বিতীয় কারণ সমষ্টিগত আত্মপরিচয়ের সংকট। কেবল মেয়েরা বলে তো নয়, পুরুষরাও এখন আর বাঙালি পরিচয় নিয়ে ভরসা পায় না। একাত্তরের মহাসংকটের পর বাঙালি পরিচয়ের মানসম্মান খুব উঁচুতে উঠেছিল। পরবর্তীতে সেটা আর অক্ষুণ্ন থাকেনি। বাঙালির সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নেমে গেছে বাঙালির মানসম্মান। তাই প্রবণতা দেখা দিয়েছে বাঙালি পরিচয়টি সরিয়ে রেখে মুসলমান পরিচয়টিকে সামনে নিয়ে আসার। বোরখা ও হিজাব ওই দৃষ্টিভঙ্গিরও দ্যোতক।

করণীয়টা তাহলে কী? সংস্কৃতির ভেতর কার্যকর তৃতীয় একটি শক্তির অবস্থান রয়েছে। সেটি হলো মতাদর্শ। স্বীকৃত হোক, চাই অস্বীকৃতই হোক, সংস্কৃতিতে একটি মতাদর্শ থাকেই। আমরা মনে করি, সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের ওই পথে এগোলেই প্রকৃত জনসংস্কৃতি গড়ে উঠবে এবং মুক্তির সম্ভাবনা তৈরি হবে। এর জন্য করণীয় কাজগুলো কী কী হতে পারে? মূল কাজটা রাজনৈতিক। সেটি যে এড়াব, এমন কোনো উপায় নেই। পরিপূরক কাজটা সাংস্কৃতিক। সেটি বিশাল এক দায়িত্ব। সেখানে মতাদর্শের কথা ভুললে চলবে না। সংস্কৃতি চর্চা ব্যাপকভাবে দরকার এবং তাতে সর্বত্র ও সর্বক্ষণ উপস্থিত থাকবে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ।

বাংলাভাষার চর্চার প্রসঙ্গে উদ্বেগের বিষয় এটি যে, অতসব অগ্রগমন ও উত্তরণের পরেও বাংলাভাষার চর্চাটা উৎসাহব্যঞ্জক মাত্রায় হচ্ছে না। আমাদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় হলো বাংলাভাষাকে যথার্থরূপে ব্যবহার করা। করলে ভাষা নিজে সমৃদ্ধ হবে, তার ধারণক্ষমতা ও চলমানতা দুটোই বৃদ্ধি পাবে এবং আমাদের জ্ঞানের চর্চা স্বাভাবিকতা ও গভীরতা লাভ করবে।

মাসিক পত্রিকার বিষয়ে বলা যায়। ঢাকায় এক সময়ে বেশকিছু মাসিক পত্রিকা ছিল; আমরা সাগ্রহে পড়তাম, আনন্দিত ও উপকৃত হতাম। সেসব এখন নেই। জনগণের কাছে পৌঁছাতে হলে এবং মতাদর্শিক ঐক্য গড়ে তুলতে চাইলে গণমাধ্যম ছাড়া চলবে কী করে? গণমাধ্যম সমাজতন্ত্রীদের হাতে নেই; এই এলাকাটিতে পুঁজিবাদীদের দৌরাত্ম্য একচেটিয়া। পত্রিকা চাই। মাসিক তো অবশ্যই, দৈনিক পত্রিকাও দরকার। সাপ্তাহিক পত্রিকাও এক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করতে পারে।

খুবই প্রয়োজন পাঠাগার গড়ে তোলা। পাড়ায়-মহল্লায় আনাচে-কানাচে পাঠাগার চাই। পাঠাগার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষণাবেক্ষণকে সামাজিক উদ্যোগ ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অপরিহার্য অঙ্গ করে তোলা দরকার। পুঁজিবাদীরা মাদ্রাসা তৈরি করছে, সমাজতন্ত্রীরা পাঠাগার গড়ুক। ধর্মবাদীরা ওয়াজের আয়োজন করে, সমাজতন্ত্রীরা আয়োজন করতে পারে নাটকের। পাঠাগার থাকতে পারে নাটকসহ সব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে।

তরুণরা অপেক্ষা করছে। তারা কাজ চায়। দুঃসাহসিক কাজ। সবচেয়ে দুঃসাহসিক কাজটা হলো সমাজপরিবর্তনের। সমাজপরিবর্তন রাষ্ট্রপরিবর্তনের চেয়েও কঠিন। এ কাজ অত্যাবশ্যকীয়ও বটে। তরুণরা আসবে যদি নেতৃত্ব পায়। যদি তারা চিনতে পারে যে, শত্রু হচ্ছে সমাজব্যবস্থা। শাসক বদল হয়েছে, কিন্তু সমাজব্যবস্থার বদল হয়নি। ফলে রাষ্ট্র বদলাচ্ছে বলে হইচই শোনা গেলেও আসলে সে বদলায়নি। ওদিকে বর্তমান সমাজ মানুষের সঙ্গে শত্রুতা করে চলেছে নিরন্তর। সমাজ মানে তো আসলে বিভিন্ন সম্পর্ক; সেই সম্পর্কগুলো রয়ে গেছে আগের মতোই। ওই সম্পর্কগুলোতে একপক্ষের অবস্থান রাজার, অপর পক্ষের অবস্থান প্রজার; একপক্ষ প্রবল, অপরপক্ষ দুর্বল।

মূল কাজটা কিন্তু রাজনৈতিকই। এনজিও’রা যাই বলুক ও বোঝাক না কেন, রাষ্ট্রকে পাশ কাটাবার কোনো উপায় নেই। সমাজপরিবর্তনের কাজে রাষ্ট্র প্রথমে ভান করবে উপেক্ষার, পরে নৃশংসভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে সব শক্তি নিয়ে। শাসকশ্রেণির মস্তিষ্ক ভরপুর লুণ্ঠন, ভোগবাদিতা ও বিচ্ছিন্নতার আদর্শে। নির্বিবাদে তারা সেটা চাপিয়ে দিচ্ছে সমগ্র জনগণের ওপর। ওই কাজ তারা অব্যাহত রাখবে। মতাদর্শিক সংগ্রামের অত্যাবশ্যকীয়তার ব্যাপারটা আমরা যেন কখনো, কোনো অবস্থাতেই না ভুলি। রাষ্ট্রক্ষমতা জনগণের হাতে না এলে ক্ষমতাবানরা তাদের শোষণ ও নিপীড়ন চালু রাখবে, এখন যেমন রেখেছে। লড়াইটা তাই সর্বাত্মক। রাষ্ট্র, সমাজ ও সংস্কৃতি, সবকিছুকে জড়িয়েই। এখানে আপসের বা দ্বিধার কোনো অবকাশ নেই।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম