বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে?
এমাজউদ্দীন আহমদ
প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া জরুরি। আঁন্দ্রে ম্যাথিয়ট ব্রিটিশ রাজনৈতিক ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে বলেছেন, ‘লর্ড মর্লি (Lord Morley) ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানকে সমান ক্ষমতা সম্পন্নদের মধ্যে প্রথম’ (Primus inter pares) (first among the equals) অথবা স্যার ইউলিয়াম হারকোর্টের (William Harcourt) মতে, (inter stellas Luna minors-Virtually a sun around which other minor planets revolve)- এমন এক সূর্য, যার চারদিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রহ পরিক্রমণ করছে- এর কোনোটি কিন্তু বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বর্তমানে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অনেক বেশি ক্ষমতাশালী। আঁন্দ্রে ম্যাথিয়ট তারপরও বলেন যে, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী তার ইচ্ছামতো নীতিনির্ধারণ করতে পারেন না। তার একনায়কসুলভ শাসন বন্ধ করার জন্য বহু সাংবিধানিক ঐতিহ্যগত বিধি রয়েছে। সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান হল সংসদীয় ব্যবস্থা সংক্রান্ত মৌল বিধিবিধানগুলো। তারপর তাকে মেনে চলতে হবে সার্বভৌম (রাজা বা রানী) সংক্রান্ত রাজনৈতিক বিধানগুলো। তত্ত্বগত দিক থেকে বলা হয়, ক্যাবিনেট এখন পর্যন্ত সার্বভৌমের বিশ্বস্ত কর্মচারীদের অনানুষ্ঠানিক সমাবেশ। (Theoretically the cabinet is still an informal gathering of His/Her Majesty's trusted servants).
সর্বশেষে কোনো প্রধানমন্ত্রী বিভাগীয় কার্যক্রমের বিস্তীর্ণ এলাকার ওপর ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধায়ন করতে পারেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার সহকর্মীদের দ্বারাই তিনি তা সম্পন্ন করেন। এভাবেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী একজন অত্যন্ত ক্ষমতাশালী শাসকে রূপান্তরিত হয়েছেন। তবে একনায়কে পরিণত হননি।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান কিন্তু ভিন্ন। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদের মধ্যমণি। তাকে বলা হয় মন্ত্রিপরিষদ ‘স্থাপত্যের প্রধান প্রস্তর’। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা ও বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদের প্রধান হিসেবে তার গুরুত্ব ও পদমর্যাদা অনন্য। সংবিধানের ৫৫(১) অনুচ্ছেদে লেখা হয়েছে : ‘প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি মন্ত্রিসভা থাকিবে।’ ৫৫(২) অনুচ্ছেদে বলা হয় : ‘প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তার কর্তৃত্বে এ সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হইবে।’ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব সংসদের কাছে, রাষ্ট্রপতির কাছে নয়। তা ছাড়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলেরও নেতা।
এদিক থেকে বলা যায়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা অসীম। কোনো নিয়মতান্ত্রিক কাঠামোয় কোনো নিয়ন্ত্রণবিহীন এমন ক্ষমতার অধিকারী অন্য কোনো কর্মকর্তা বিশ্বে দেখা যায় না। তার ক্ষমতা রাশিয়ার ঈুধব-এর ক্ষমতার মতো। ভারতের মোগল সম্রাটদের মতো। বিশ্বের পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার চেয়েও তিনি অধিক ক্ষমতার মালিক। প্রেসিডেন্টকে পদে পদে সিনেটের ওপর নির্ভর করতে হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে জাতীয় সংসদের কোনো পদক্ষেপ কার্যত নিয়ন্ত্রণে সক্ষম নয়। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ তার হাত আরও শক্তিশালী করেছে। সংসদে বক্তব্য উপস্থাপনের সময় সংসদ সদস্যদের মাথার ওপর সর্বদা ঝুলন্ত থাকে ডেমোক্লিসের তরবারির (Democles' Sword) মতো সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ। ৭০ অনুচ্ছেদের ভীতির কারণে কোনো সদস্য প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে মুখ খুলতে সাহস করেন না। এসব কারণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তার সাংবিধানিক ক্ষমতাকে ‘ব্যক্তিগত ক্ষমতায়’ (Personalized Power) রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছেন তার নিজস্ব সচিবালয়ের মাধ্যমে। এ সচিবালয় এক অর্থে একটি ‘সুপার সচিবালয়’, কেননা এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী সব মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের শুধু সমন্বয় করেন না, নিয়ন্ত্রণও করেন। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী সংসদের মাধ্যমে বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এ অবস্থা কোনোক্রমে কাম্য হতে পারে না। বাংলাদেশ সরকারের তিনটি শাখার মধ্যে সাম্যাবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সবাইকে ভাবতে হবে। কিছুদিন আগে ড. শামছুল হুদা ও আরও কয়েকজন বুদ্ধিজীবী প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার বিন্যাসে সাম্যাবস্থা আনার জন্য নির্বাচিত রাষ্ট্রপাতির প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিন্তু তেমন হলে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাচিত রাষ্ট্রপাতির মধ্যে যে সম্পর্ক রচিত হবে তা কাঙ্ক্ষিত নয়। কেননা তখন রাষ্ট্রক্ষমতার বেশি টানাটানি শুরু হবে সরকারপ্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে এবং এক পর্যায়ে শাসনব্যবস্থা অস্থিতিশীল হতে বাধ্য।
এ প্রেক্ষাপটে আমি মনে করি, নিম্নে বর্ণিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করলে সরকারের তিনটি শাখার মধ্যে যেমন সাম্যাবস্থা সৃষ্টি হবে, তেমনি কোনো শাখা রক্তহীনতায় ভুগবে না এবং কোনো শাখা, বিশেষ করে নির্বাহী বিভাগ দায়িত্বের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়বে না।
এক.
কোনো নিয়মতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় সরকারপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিত্ব গ্রহণের পর দলীয় প্রধানের পদে আর থাকেন না এই জন্য যে দলের নেতৃত্ব ত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রতিটি দলের ও প্রত্যেক নাগরিকের প্রধানমন্ত্রী রূপে শাসনকাজে মনোযোগী হতে পারেন। তা ছাড়া এ অবস্থায় রাজনীতি (Politics) ও শাসনব্যবস্থার (Governance) আবর্ত স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে।
দুই.
রাষ্ট্রপতি যেসব কর্মকর্তার পদচ্যুতি ঘটাতে পারেন, বিশেষ করে সাংবিধানিক সংস্থাগুলোর, যেমন নির্বাচন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যবৃন্দ, কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যবৃন্দ, কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেল, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যবৃন্দ, দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ প্রভৃতি পদে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে নয়, বরং রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের মাধ্যমে বাছাই করে জাতীয় সংসদের সংশ্লিষ্ট স্থায়ী কমিটির অনুমোদনের পর যদি রাষ্ট্রপতি নিজে নিয়োগ দেন, তাহলেও রাষ্ট্রপ্রধান এ নিয়োগের মাধ্যমে জাতীয় অভিভাবক রূপে কিছুটা ভূমিকা পালন করতে পারেন।
তিন.
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন এনে, শুধু অনাস্থা পেশের সময় ছাড়া অন্য সময়ে বিরোধী দলের আনীত উপযুক্ত প্রস্তাবের পক্ষে যেন সরকারি দলের যারা আগ্রহী তারা সমর্থন দিতে পারেন, তার ব্যবস্থা রাখা যায়। কেননা বর্তমান অবস্থায় ৭০ অনুচ্ছেদ শুধু সদস্যদের আনুগত্য বৃদ্ধি ছাড়া অন্য কোনো লক্ষ্য অর্জন করে না। সদস্যদের সৃজনশীলতা অথবা যথার্থ বক্তব্যের সব পথ রুদ্ধ করেছে।
চার.
প্রতি বছরের প্রথম অধিবেশনে জাতীয় সংসদে মন্ত্রিসভা কর্তৃক তৈরি করা বক্তব্য উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের সূচনা করেন। এ ক্ষেত্রে তার মতামত অথবা উপদেশের কোনো সুযোগ নেই। অথচ কার্যত তিনিই জাতির অভিভাবক। তিনি যেন এ ক্ষেত্রে তার কথা উচ্চারণ করতে পারেন তার ব্যবস্থা থাকা উচিত। তার বক্তব্য তিনিই লিখবেন।
পাঁচ.
সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদের বক্তব্য, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।’ এই সংবিধানের শ্রেষ্ঠতম বক্তব্য, কিন্তু পর্যালোচনা করুন, দেখবেন প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিকদের রাষ্ট্রের কোনো পর্যায়ে নির্দিষ্ট দিনে ভোট দেয়া ছাড়া আর কোনো ভূমিকা নেই। অত্যন্ত জটিল বিষয়ে, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের যেসব ক্ষেত্রে ঐকমত্য হচ্ছে না অথচ হওয়া উচিত, সে ক্ষেত্রে প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিকদের যথার্থ ভূমিকা পালনের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। কোনো কোনো বিষয়ে জনমতের প্রকাশ ঘটিয়ে রেফারেন্ডামের ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি।
ছয়.
সংবিধানের ৪৮(৫) অনুচ্ছেদকে পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতি যেন জাতীয় সংকটকালে প্রধানমন্ত্রী তথা সরকারকে পরামর্শ দান করতে পারেন তার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।
সাত.
সংসদীয় ব্যবস্থা হল এমন সরকারব্যবস্থা, যা কার্যত সংখ্যালঘু দলের সম্মতিসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের শাসন। তাই বলা হয়, আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ ছাড়াও অনানুষ্ঠানিক নিয়ম-পদ্ধতির মাধ্যমে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহিষ্ণুতা ও সমঝোতার বন্ধনে সব রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু দল আবদ্ধ থাকে। কেননা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অর্থপূর্ণ হয় শুধু গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির আবহে। এর কোনো বিকল্প নেই।
