Logo
Logo
×

যুগান্তরের বিশেষ আয়োজন

বাংলা ও বাঙালিবিদ্বেষী কার্জন

Icon

মযহারুল ইসলাম বাবলা

প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বঙ্গদেশের বাঙালিমাত্রই ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, রুচি, সব ক্ষেত্রেই রয়েছে ঐক্য-মিল। একমাত্র অমিলটি ধর্মীয় ভিন্নতা। বাঙালি জাতি প্রধানত দুই সম্প্রদায়ে আগাগোড়াই বিভক্ত ছিল। দুই সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিরোধ-বিভক্তি সৃষ্টিতে তৎপর উপনিবেশিক ব্রিটিশদের শঠতার কূটচালেই ভ্রাতৃপ্রতিম দুই সম্প্রদায়ের সম্পর্ক বিনষ্ট এবং পরস্পর পরস্পরের শত্রুতে পরিণত হয়েছিল। ১৯৪৭-এর দেশভাগে সাম্প্রদায়িক বিভাজনে বাঙালি আর বাঙালি থাকেনি। হিন্দু-মুসলমানে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল বলেই বাংলাভাগ বিনে বাধায় সম্পন্ন হতে পেরেছিল। বাংলাভাগে পূর্ব ও পশ্চিমবাংলা দ্বিখণ্ডিতরূপে দুই পৃথক রাষ্ট্রের অধীনস্থ হয়ে পড়ে। বাংলাভাগের প্রধান এবং একমাত্র অজুহাতটি ছিল সাম্প্রদায়িকতা। সাম্প্রদায়িকতার গিলোটিনেই দ্বিখণ্ডিত বাংলাভাগ সম্পন্ন হয়েছিল। বাংলাভাগের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যক্তিবিশেষ ভূমিকা পালন করলেও; বাংলাভাগ রোধ করা সম্ভব হয়নি। প্রধান দুই রাজনৈতিক দল, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ক্ষমতার ভাগাভাগি নিশ্চিত করতেই দেশভাগ অনিবার্য করে তোলে। সাম্প্রদায়িক বিভাজনে ভারত বিভক্তির আদলে বাংলাভাগও নির্মম উপায়ে সম্পন্ন হয়েছিল। বাংলাভাগের বিরুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে প্রতিরোধ হয়নি। বাংলাভাগের অপরিণামদর্শী ক্ষতির বিবেচনা দলগতভাবে পর্যন্ত কেউ করেনি। ব্যক্তি বিশেষ করেছিল, কিন্তু অসংগঠিত বাংলাভাগ প্রতিরোধে সেসব উদ্যোগ মোটেও যথেষ্ট ছিল না। ১৯৪৭-এর বাংলাভাগে উচ্ছেদ, বিচ্ছেদ, উৎপাটনের নজিরবিহীন হৃদয়-বিদারক ঘটনা ঘটেছিল দুই বাংলাজুড়ে। একমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে বাঙালি হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায় প্রাণ রক্ষার তাগিদে ভিটেমাটি, সহায়-সম্বল, মাতৃভূমি ত্যাগ করে এপারে-ওপারে চলে যেতে বাধ্য হয়। বাংলাভাগের নির্মম অভিজ্ঞতা যাদের রয়েছে তারা কেউ জীবদ্দশায় মর্মান্তিক সেই স্মৃতি ভুলতে পারেনি। বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি ১৯৪৭-এর বাংলাভাগ। যেটি বিনে বাধায়, বিনে প্রতিরোধে, সজ্ঞানে এবং চরম সাম্প্রদায়িক রক্তাক্ত দাঙ্গায় সম্পন্ন হয়েছিল।

অবিভক্ত বাংলার পূর্ববঙ্গের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ ছিল সম্ভ্রান্ত-সমৃদ্ধ এবং আধুনিক সুযোগ-সুবিধায় পরিপুষ্ট। অপর দিকে পূর্ববাংলা ছিল ঠিক তার বিপরীত। অনগ্রসর, আধুনিকতা বঞ্চিত, নদ-নদী, খাল-বিল কেন্দ্রিক মফস্বল সদৃশ। পূর্ববাংলার অর্থনীতি ছিল সম্পূর্ণ কৃষিনির্ভর। ক্ষুদ্র কুঠির শিল্প ব্যতীত কল-কারখানা বলতে কিছুই ছিল না। নিুাঞ্চল পূর্ববাংলার নদ-নদী, খাল-বিলে পানি থৈ-থৈ করত। জন এবং পণ্য পরিবহন ব্যবস্থাও ছিল নদীকেন্দ্রিক। পানির পর্যাপ্ততার কারণেই পাট উৎপন্নের আদর্শ স্থান ছিল পূর্ববাংলা। পূর্ববাংলার পাটের খ্যাতি সুদূর ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। পাট উৎপন্নের জন্য পূর্ববাংলার অসামান্য খ্যাতি ও কদর ছিল। কিন্তু পূর্ববাংলায় কোনো পাটকল ছিল না। পূর্ববাংলায় উৎপাদিত পাট পশ্চিমবাংলার পাটকলগুলোর চাহিদা পূরণ করত। এমন কি পশ্চিমবাংলায় নানা শিল্পের কাঁচামালেরও জোগান দিত পূর্ববাংলা। অপর দিকে পশ্চিমবাংলায় উৎপাদিত পণ্যের একচেটিয়া বাজার ছিল পূর্ববাংলায়। অবিভক্ত বাংলার দুই অংশের বৈপরীত্যের মূলে ছিল উপনিবেশিক শাসনামলে সুদীর্ঘকালের রাজধানী অত্যাধুনিক কলকাতা-কেন্দ্রিকতা। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রহসন যুদ্ধে জয়ী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বঙ্গদেশ দখলদারিত্বের পর কলকাতাকেই রাজধানী করে। ১৮৫৮ সালের ১ নভেম্বর মহারানি ভিক্টোরিয়ার ঘোষণায় ভারতবর্ষ শাসনের দায়িত্ব ব্রিটিশ রাজতন্ত্র গ্রহণ করে এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বিলুপ্ত করে দেয়া হয়। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধের মাশুল স্বরূপ ১৯১২ সালে উপনিবেশিক শাসকরা ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতা থেকে সরিয়ে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করেছিল। অর্থাৎ ১৭৫৭ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার রাজধানী ছিল কলকাতা। রাজধানীর মর্যাদায় কলকাতা আধুনিকতায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। প্রাচ্যের লন্ডনরূপে ব্রিটিশ শাসকরা রাজধানী কলকাতাকে গড়ে তুলেছিল। আধুনিক এবং সমৃদ্ধ কলকাতা শিক্ষা, সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক, মুক্তবুদ্ধি চর্চায় পুরো ভারতবর্ষের মধ্যে প্রধান হয়ে উঠেছিল। আলোকিত পশ্চিমবাংলার তুলনায় অনগ্রসর পূর্ববাংলা ছিল অন্ধকারময়। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত পশ্চাৎপদ এক জনপদ। একই বাংলার দুই অংশের ভিন্নরূপ- পরস্পর বিরোধী এবং চরম বৈপরীত্যে বিদ্যমান।

কৃষি, ক্ষুদ্র কুঠির শিল্প ব্যতীত পূর্ববাংলায় জীবিকার ক্ষেত্রও ছিল খুবই সংকীর্ণ। শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা, সাধারণ পেশা, সম্মানজনক পেশার কারণে কলকাতার গুরুত্ব ছিল সর্বাধিক। পূর্ববাংলার প্রচুর মানুষ শিক্ষা, পেশার কারণে কলকাতায় দ্বিতীয় আবাস গড়ে তুলেছিল। কলকাতা ফেরত ব্যক্তিদের কাছে কলকাতার নানা গল্প শুনে পূর্ববঙ্গীয়রা অবাক-বিস্মিত হতো। পূর্ববাংলার মানুষের কাছে কলকাতা ছিল স্বপ্নতুল্য নগরী। পূর্ববাংলার চট্টগ্রাম এবং নোয়াখালী অঞ্চলের মানুষরা জীবিকার জন্য কলকাতার পরিবর্তে মিয়ানমারকে (বার্মা) বেছে নিয়েছিল। রেঙ্গুনকেন্দ্রিক নানা পেশার পাশাপাশি জাহাজের খালাসি, সুকানি, সারেং হতে জলে-স্থলের নানা পেশায় যুক্ত ছিল চট্টগ্রাম-নোয়াখালী অঞ্চলের অজস্র মানুষ। ভারতবর্ষের বাইরে মিয়ানমার (বার্মা) এবং শ্রীলঙ্কা দেশ দুটিও ছিল ব্র্রিটিশ ইন্ডিয়ার অন্তর্গত। রাজধানী কলকাতাকেন্দ্রিক শাসনাধীন ছিল ভারতবর্ষসহ মিয়ানমার (বার্মা) এবং শ্রীলঙ্কা। যেটি ব্রিটিশ ইন্ডিয়া নামে খ্যাত ছিল।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের চরম প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিনিধি, জর্জ নাথানিয়েল ব্যারন কার্জন অব কেল্লেস্টোন সংক্ষেপে লর্ড কার্জন ১৮৯৯ সালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার ভাইসরয় রূপে ভারতে আসেন। তার কর্মস্থল-আবাসস্থল সঙ্গত কারণেই রাজধানী কলকাতা। অতি ধূর্ত এবং চরম বাঙালি বিদ্বেষী কার্জনের বাংলা ও বাঙালিকে চিনতে-বুঝতে বিলম্ব হয়নি। বাঙালিদের প্রখর জাতীয়তাবোধ-দেশপ্রেম এবং সর্বোপরি উপনিবেশিক ইংরেজ বিরোধী মনোভাব সহজেই তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন। শিক্ষা, সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় অগ্রসর বাঙালি জাতি ব্রিটিশ শাসন অবসানে ক্রমেই তৎপর হয়ে উঠেছে; এই সত্যটি তার মতো ধূর্ত ব্যক্তির পক্ষে বোঝা কঠিন ছিল না। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ বাঙালি জাতিকে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল রূপে নানা পদক্ষেপ কার্জন গ্রহণ করেছিলেন। বাঙালি জাতিকে ধর্মের বিভাজনে দ্বিখণ্ডিত করার অভিপ্রায়ে ১৯০২ সালে বাংলা বিভক্তি অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পাশাপাশি অবাধ সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে আরোপ করেন কঠোর বিধিনিষেধ। রাষ্ট্রীয় গোপন আইনের আওতায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয়। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসকরা শিক্ষা বিস্তারে যে ভূমিকা নিয়েছিল-সেটা মোটেও উদ্দেশ্যহীন ছিল না, ছিল রাষ্ট্রনীতির স্বার্থে। ভারতীয়দের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত জাতি রূপে গড়ে তোলা তাদের অভিপ্রায় ছিল না। স্থানীয় ভারতীয়দের শিক্ষা প্রদানে একটি কেরানি শ্রেণী গড়ে তোলাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। শাসন ব্যবস্থার সহযোগী রূপে এ কেরানি শ্রেণীর বিকাশ সাধন তারা করেছিল উপনিবেশিক সাম্রাজ্য রক্ষা এবং শাসন ব্যবস্থার তাগিদে। কেননা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য বিশাল ইংরেজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বহর ইংল্যান্ড থেকে ভারতে আনয়ন ছিল অসম্ভব। সেই উদ্দেশ্য সাধনেই মিশনারীদের মাধ্যমে স্থানীয় ভারতীয়দের শিক্ষিত করার অভিপ্রায়ে শাসনকার্যের স্বার্থে কেরানি শ্রেণী গড়ে তুলেছিল। ভারতীয়দের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার অভিলাষ তাদের সঙ্গত কারণেই থাকারও কথা নয়। শিক্ষা বিস্তারের সুযোগে ভারতীয়দের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পথ উন্মুক্ত হয়েছিল সত্য, তবে সেটা ব্রিটিশ শাসকদের আন্তরিক পরিকল্পনার ইচ্ছায় ঘটেনি। পরিস্থিতির সুযোগেই স্থানীয়রা উচ্চশিক্ষা লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। এ উচ্চশিক্ষার বিরুদ্ধে লর্ড কার্জনের নগ্ন হস্তক্ষেপে উচ্চশিক্ষার উন্মুক্ত পথটি বন্ধের অভিপ্রায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বেতন বৃদ্ধিসহ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের যাবতীয় কার‌্যাবলিকে ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের অধীনস্থ করেন। ব্রিটিশ শাসনকে নিষ্কণ্টক করার অভিপ্রায়ে নানাবিধ কালাকানুন আরোপ করেন। শিক্ষা-সংস্কৃতিতে অগ্রসর বাঙালিদের ওপরই কার্জনের খক্ষ হস্তটি সর্বাধিক পরিমাণে প্রসারিত হয়েছিল।

ভারতীয় মধ্যবিত্ত-সুবিধাভোগী শ্রেণীকে নিজেদের পক্ষে ব্রিটিশরা আগাগোড়া অনুগত রূপে পেয়েছে। এ শ্রেণীকে রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে স্থায়ীভাবে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার অভিপ্রায়ে ব্রিটিশ ভাইসরয়ের পরোক্ষ মদদে ব্রিটিশ সরকারের অবসরপ্রাপ্ত আমলা এ্যালেন অক্টোভিয়ান হিউমের প্রত্যক্ষ উদ্যোগে ১৮৮৫ সালে গঠিত হয় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। সময়ের ব্যবধানে কংগ্রেস দলের লাগাম ব্রিটিশদের হাত বদলে ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কংগ্রেস দলের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে ক্ষুব্ধ লর্ড কার্জন কংগ্রেস সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, তার (কার্জনের) সাহায্যের কল্যাণেই এটি (কংগ্রেস) শান্তিপূর্ণ মৃত্যুবরণের পথ খুঁজে পাবে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে চরম ব্যঙ্গবিদ্রূপ মন্তব্য করতেও কার্জন দ্বিধা করেননি। কার্জনের নিগ্রহ ও নিপীড়নমূলক নীতির কারণেই ভারতের ব্রিটিশ শাসন অবসানের লক্ষ্যে গঠিত হয়েছিল সশস্ত্র গোপন সমিতি। সশস্ত্র পন্থায় ব্রিটিশদের পরাস্ত করে মাতৃভূমি রক্ষাই ছিল গোপন সমিতির মূল লক্ষ্য।

শুরুতেই বলেছি তীক্ষ্ণ বুদ্ধিদীপ্ত লর্ড কার্জন বাঙালি জাতিকে চিনতে-বুঝতে ভুল করেনি। ব্রিটিশবিরোধী বাঙালি জাতির মনোভাব তিনি সঠিকভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন। ভারতবর্ষের অপরাপর জাতিসত্তার তুলনায় অগ্রসর বাঙালি জাতিকে বিভক্তিকরণ ছাড়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্য টিকে থাকতে পারবে না। সেই উপলব্ধি ও অভিলাষেই কার্জনের শঠতার কৌশলী উদ্যোগ বঙ্গ বিভক্তি অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গ। অবিভক্ত বঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা, ছোটনাগপুরসহ বিশালাকার বাংলা প্রদেশকে খণ্ডিত করা ছাড়া ব্রিটিশ শাসনকে স্থায়ী এবং নিষ্কণ্টক করা সম্ভব হবে না। সেই লক্ষ্যেই বঙ্গভঙ্গের উদ্যোগ গ্রহণ করেন লর্ড কার্জন।

তার প্রস্তাবিত দ্বিখণ্ডিত বঙ্গের বিহার, উড়িষ্যা, ছোটনাগপুর এবং পশ্চিমবাংলা নিয়ে গঠিত (ওয়েস্ট বেঙ্গল) পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ। অপর দিকে পূর্ববাংলার সঙ্গে স্বতন্ত্র আসামকে যুক্ত করে ইস্টার্ন বেঙ্গল নামক নতুন প্রদেশ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। Richard M. Eaton-এর The Rise of Islam and the Bengal Frontier গ্রন্থে জানা যায় ভারত স্বরাষ্ট্র সচিব এইচএইচ রিজলী ১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারি ও ডিসেম্বরে পৃথক দুটি নোটে লিখেছিলেন, Bengal United is a power. Bengal divided will pull in several different ways. That is perfectly true and is one of the merits of the scheme. পরবর্তী সময়ে আরও চূড়ান্তভাবে... One of our main objects is to split up and there by weaken a solid body of opponents to our rule.

বঙ্গভঙ্গ বাস্তবায়নে লর্ড কার্জন ১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে পূর্ববাংলায় আসেন। ব্রিটিশ শাসনাধীনে পূর্ববাংলায় আগত ইংরেজ শাসকদের আগমনকে উপলক্ষ করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ তখন একরকম নিয়মে পরিণত হয়েছিল। কলকাতায় মহারানি ভিক্টোরিয়ার আগমন উপলক্ষে কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে নির্মিত হয়েছিল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। এ বিশালাকার ব্যয় সাপেক্ষ স্থাপনা নির্মাণে অর্থের জোগান ব্রিটিশ শাসকরা করেনি। স্থানীয় জনগণের ওপর অধিক করের বোঝা চাপিয়ে অর্থ আদায়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের নির্মাণ ব্যয় নির্বাহ করা হয়েছিল। একইভাবে ঢাকায় ১৮৭৪ সালে লর্ড নর্থব্রুকের আগমন উপলক্ষে ব্রিটিশদের পদলেহনকারী ব্যবসায়ী এবং পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশদের দেয়া খেতাবপ্রাপ্ত কাগুজে নবাব আবদুল গণি কর্তৃক ২,৫০,০০০ টাকা অনুদানে নর্থব্রুক হল নির্মাণ করা হয়েছিল। লর্ড কার্জনের আগমনকে স্মরণীয় রাখার অভিপ্রায়ে ভাওয়ালের রাজকুমার নরেন্দ্র নারায়ণের ১,৫০,০০০ টাকা অনুদানে ঢাকায় নির্মিত হয়েছিল কার্জন হল। ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯০৪ সালে কার্জন হলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন স্বয়ং লর্ড কার্জন। কার্জনের স্থাপিত ভিত্তিপ্রস্তরটি আজও কার্জন হলের মূল প্রবেশদ্বারের বাম পাশের দেয়ালে অক্ষত অবস্থায় রয়েছে।

ঢাকার সদরঘাট এলাকায় অবস্থিত ট্রেজারিটি তখন ছিল ঢাকা কলেজ। স্থান সংকুলানের অভাবে কলেজের লাইব্রেরিটি কার্জন হলে স্থানান্তরিত করা হয়। ঐতিহাসিকদের মতে কার্জন হল টাউন হল হিসেবে ব্যবহারের জন্যই নির্মাণ করা হয়েছিল। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর সদরঘাট থেকে কার্জন হলে ঢাকা কলেজকে স্থানান্তরিত করে নতুন নামকরণ করা হয় ঢাকা গভর্নমেন্ট কলেজ। এর পূর্বে কার্জন হল পাবলিক হল হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর কার্জন হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন হয়ে যায়। বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষাক্রম কার্জন হল কেন্দ্রিক পূর্বের ন্যায় আজও বলবৎ রয়েছে।

বঙ্গভঙ্গ মিশনটি বস্তবায়নের উদ্দেশ্যেই পূর্ববাংলায় লর্ড কার্জনের আগমনের প্রধান কারণ। কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য সাধনে কার্জন ছুটে যান ময়মনসিংহে মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর অতিথি হয়ে। সেখানে মহারাজাকে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব সমর্থনের জন্য অনুরোধ ও চাপ প্রয়োগ করেন। ব্রিটিশ শাসনাধীনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফলভোগী স্থানীয় মহারাজা, জমিদার সামন্ত শ্রেণীর কেউ স্বয়ং ভাইসরয়ের প্রস্তাব উপেক্ষার ধৃষ্টতা দেখাতে সক্ষম হবে- কার্জনের কাছে সেটা ছিল অসম্ভব এবং চিন্তারও অতীত। অথচ মহারাজা সূর্যকান্ত চৌধুরী লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব সরাসরি কার্জনের মুখের ওপর প্রত্যাখ্যান করে অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন।

ময়মনসিংহ গমনের মিশন ব্যর্থ হওয়ার পর কার্জন ঢাকায় ফিরে আসেন এবং নবাব সলিমুল্লাহর অতিথি রূপে আহসান মঞ্জিলে অবস্থান নেন। ঢাকার সম্ভ্রান্ত মুসলিমদের উপস্থিতিতে আহসান মঞ্জিলে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের উপস্থিতিতে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে বলেন, প্রস্তাবিত আসাম ও পূর্ববাংলা নিয়ে গঠিত নতুন ইস্টার্ন বেঙ্গলের কর্তৃত্ব থাকবে সম্পূর্ণ রূপে মুসলিম সম্প্রদায়ের অধীনে। এখানকার মুসলমানদিগকে আর হিন্দুদের কর্তৃত্বে থাকা কলকাতার মুখাপেক্ষী হতে হবে না। নবাব সলিমুল্লাহকে নতুন প্রদেশ উন্নয়নে সুদমুক্ত দশ হাজার পাউন্ড প্রদানেরও প্রস্তাব দেন। নবাব সলিমুল্লাহর তখন আর্থিক টানপড়েন চলছিল। ওই অর্থ তার বিশেষ প্রয়োজন ছিল। নবাব সলিমুল্লাহ তাৎক্ষণিক বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করেন। ময়মনসিংহের অপর জমিদার নওয়াব আলী চৌধুরীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনিও কার্জনের বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব একবাক্যে সমর্থন করেন। বঙ্গভঙ্গ বাস্তবায়নে কার্জন চরম সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নিতেও কুণ্ঠিত হননি। আকারে-ইঙ্গিতে, অপ্রত্যক্ষে-প্রত্যক্ষে পূর্ববাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের হৃদয়ের গভীরে সাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপণ করে যান। যে কারণে পূর্ববাংলার সম্ভ্রান্ত মুসলিম সম্প্রদায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় বঙ্গভঙ্গের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে কার্জনের বঙ্গভঙ্গের মিশনকে গতিময় করে তোলে।

রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে কার্জন বাংলা বিভক্তিতে পূর্ববাংলা চষে বেড়িয়েছেন। ছুটে গেছেন চট্টগ্রামেও। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফেরার পথে ট্রেনে বসে ভারত সচিবকে যে চিঠিটি তিনি লেখেন সেই চিঠিতেই কার্জনের প্রকৃত উদ্দেশ্য স্পষ্ট ভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯০৪ সালে কার্জনের লিখিত সেই চিঠিটি এযাবৎকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গবেষণা গ্রন্থ শিক্ষাবিদ-অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী রচিত জাতীয়তাবাদ সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি গ্রন্থে বাংলা অনুবাদে প্রকাশিত হয়েছে। বঙ্গানুবাদটি এরূপ, ‘বাঙালিরা, নিজেদের যারা একটি জাতি বলে ভাবতে পছন্দ করে এবং যারা এমন একটি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে যখন ইংরেজদের বিদায় করে দিয়ে কলকাতার গভর্নমেন্ট হাউসে একজন বাঙালি বাবুকে অধিষ্ঠিত করবে, তারা অবশ্যই তাদের ওই স্বপ্ন বাস্তবায়নে হস্তক্ষেপ ঘটাতে পারে এমন যে কোনো প্রতিবন্ধকের ব্যাপারে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করবে। আমরা যদি তাদের হৈ-চৈ-এর কাছে নতি স্বীকার করার মতো দুর্বলতা প্রকাশ করি, তাহলে আগামীতে বাংলাকে কখনোই খণ্ডিত বা দুর্বল করতে পারব না এবং ভারতের পূর্ব পার্শ্বে আপনি এমন একটি শক্তিকে সংযুক্ত ও দৃঢ় করবেন যেটি ইতিমধ্যেই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং ভবিষ্যতে তা ক্রমবর্ধমান গোলযোগের নিশ্চিত উৎস হয়ে দাঁড়াবে।’

লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের বিরামহীন কর্মযজ্ঞ সম্প্রদায়গত বিরোধ-বিভাজন সৃষ্টির বিপরীতে বাঙালি মানসে ভিন্ন মাত্রার সৃষ্টি করেছিল। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ক্রমেই বাঙালি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন দ্রুত দাবানলের ন্যায় কেবল বাংলায় নয়, ভারতবর্ষের সর্বত্রে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলার জাতীয়তাবাদী নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে লিখেছিলেন, ‘এতে বাঙালিরা অপমানিত-অসম্মানিত হচ্ছে এবং তাদের সমগ্র ভবিষ্যৎ বিপন্ন হয়েছে।’ তার মতে বঙ্গভঙ্গ বাংলাভাষী জনগণের বর্তমান ঐক্যের প্রতি সতর্কভাবে পরিকল্পিত আঘাত। নিজ সিদ্ধান্তে অবিচল লর্ড কার্জন ৭ জুলাই ১৯০৫ সালে সরকারিভাবে বঙ্গভঙ্গের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রদান করেন। কার্জনের সেই ঘোষণা কার্যকর হয় ১৬ অক্টোবর ১৯০৫ সালে। আগষ্ট মাসেই রাজধানী কলকাতাজুড়ে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন, বিক্ষোভ, সমাবেশসহ ব্যাপক প্রতিরোধ কর্মসূচি পালিত হয়। বঙ্গভঙ্গবিরোধী সমাবেশ থেকে ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের ডাক দেয়া হয়। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব বাঙালি ১৬ অক্টোবর দিনটিকে বঙ্গভঙ্গ দিবসের পাশাপাশি জাতীয় শোক দিবস রূপেও পালন করে। কলকাতার বঙ্গভঙ্গবিরোধী বিশাল বিক্ষোভ মিছিল গঙ্গাতীরে পৌঁছে সমবেতভাবে বঙ্কিমচন্দ্র রচিত ‘বন্দেমাতারম’ গান পরিবেশন করে পুনরায় অখণ্ড বাংলার সংযুক্তিকরণের শপথ নেয়। এদিন কলকাতায় অঘোষিত হরতাল পালিত হয়। আনুষ্ঠানিক প্রতিজ্ঞার নিদর্শন স্বরূপ মণিবন্ধে প্রত্যেকে রাখি বাঁধে। এই রাখি বন্ধন বাঙালির ঐক্যের প্রতীকে পরিণত হয়েছিল। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন ক্রমেই ভারতবর্ষজুড়ে প্রভাব বিস্তার করে। সামন্ত-ভূস্বামী, মধ্যবিত্ত, পেশাজীবী, ছাত্রসমাজসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রাধান্যের পাশাপাশি অগণিত মুসলিম সম্প্রদায়ের বিশিষ্টজনরা আন্দোলনে শামিল হয়েছিল, জাতিগত চেতনায়। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র খুবই স্পষ্ট। যা ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসকদের বিপন্ন করে অজানা শঙ্কার মুখে ফেলেছিল। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে কংগ্রেস সভাপতি গোপালকৃষ্ণ গোখলে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে বাংলায় ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের আহ্বানকে আনুষ্ঠানিক সমর্থন প্রদান করেন। কংগ্রেসের সেই অধিবেশনে বালগঙ্গাধর তিলক ও তার অনুসারী চরমপন্থীরা সারা ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী আন্দোলন বিস্তারে ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের প্রস্তাব পেশ করলেও, কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থীদের অসম্মতি ও বিরোধিতায় সে প্রস্তাব গৃহিত হতে পারেনি। কলকাতার বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, রাজনীতিক হতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গবিরোধী কর্মসূচিসমূহে উপস্থিত ও অংশগ্রহণের পাশাপাশি অনেক দেশপ্রেমের দেশাত্মবোধক গান রচনা ও পরিবেশন করেন। বাংলার মাটি-বাংলার জল, বাংলার বায়ু-বাংলার ফল, আমায় বলো না-গাহিতে বলো না, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি ইত্যাদি। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশ নিয়ে ‘বিজয় সম্মিলন’ নামক এক ভাষণও তিনি দিয়েছিলেন। কলকাতার উপকণ্ঠের প্রখ্যাত নাখোদা মসজিদে উপস্থিত হয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ মসজিদের মুসল্লিদের হাতে রাখি বেঁধে দেন। বঙ্গভঙ্গবিরোধী এ আন্দোলনের ব্যাপকতাই ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের পথ উন্মুক্ত করে। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগঠিত এ আন্দোলন অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল বলেই ঘৃণিত লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ বাস্তবায়ন স্থায়ী হয়নি। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে যায়। অন্যভাবে জনদাবির মুখে রদ করতে বাধ্য হয়। পক্ষান্তরে স্থানীয় ব্রিটিশ শাসকদের জন্য ছিল সেটা চরম চপেটাঘাত। এ অপমানের প্রতিশোধে ১৯১২ সালে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করা হয়। কলকাতা হারায় তার ঐতিহ্য। হ্রাস পায় কলকাতার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব। রাজধানীর মর্যাদা হারিয়ে কলকাতা কেবলই প্রদেশের রাজধানীতে পরিণত হয়। ওদিকে বৃহৎ বাংলাকে উদ্দেশ্যমূলক সংকুচিত করা হয়। উড়িষ্যা, বিহার, ছোটনাগপুরকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। আসাম পূর্বের ন্যায় স্বতন্ত্র প্রদেশে পরিণত হয়। পূর্ব ও পশ্চিমবাংলা নিয়েই বাংলা প্রদেশ তার পূর্বেকার আয়তন ও গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।

কবি রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার বাঙালি জাতিমানসে নতুনভাবে প্রেরণা দান করেছিল। বাঙালি জাতিকে গর্বিত জাতির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছিল। ইংরেজ আইনজীবী সঙ্গীত বিশ্লেষক ফক্স স্ট্যাংওয়েজ (১৮৫৯-১৯৪৮) প্রচণ্ড রবীন্দ্রানুরাগী ছিলেন। নোবেল পুরস্কার জয়ী রবীন্দ্রনাথকে লন্ডনের সুধী সমাজে পরিচিত করার ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সম্মানিত ডিগ্রি প্রদানের জন্য ফক্স স্ট্যাংওয়েজ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গভঙ্গের ঘৃণিত খলনায়ক ভারতের সাবেক ভাইসরয় লর্ড কার্জন তখন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। কবি রবীন্দ্রনাথকে চিনতে চতুর কার্জনের বিন্দুমাত্র বিলম্ব ঘটেনি। বঙ্গভঙ্গের দুর্বিষহ স্মৃতি তিনি জীবদ্দশায় নিশ্চয় মোচন করতে পারেননি। বারংবার সেই স্মৃতি অবশ্যই তাকে আঘাত করেছে, ক্ষত-বিক্ষত করেছে। বঙ্গভঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অংশগ্রহণ এবং ভূমিকা কার্জনের স্মৃতিতে মলিন, বিস্মৃত কোনোটি হয়নি। অতীতের বিব্রতকর স্মৃতি লর্ড কার্জনের পক্ষে ভুলে যাওয়া সম্ভব হয়নি বলেই বাঙালি বিদ্বেষী অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর লর্ড কার্জন নোবেল পুরস্কার জয়ী বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সম্মান সূচক ডিগ্রি প্রদানের প্রস্তাব তাৎক্ষণিক প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। একমাত্র কার্জনের প্রত্যাখ্যানের কারণেই লন্ডনের সুধী সমাজের বিশেষ করে ফক্স স্ট্যাংওয়েজের সমস্ত উদ্যোগ ভেস্তে গিয়েছিল।

অথচ কি ভবিতব্য ব্রিটিশ বিদায়ের পরও ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে ঘৃণিত কার্জনের নামানুসারে কার্জন হলের নামকরণ অক্ষত থেকে যায়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর তল্পিবাহক খাজা নাজিমুদ্দিন সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্বাংশের অর্থাৎ পূর্ববাংলার মুসলিমলীগ সংসদীয় দলের নির্বাচিত প্রধানরূপে কার্জন হলেই আনুষ্ঠাকিভাবে ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূতিকাগার কার্জন হল। ১৯৪৮ সালে এখানেই পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আদেশের ভঙ্গিতে বলেছিলেন, উর্দু, কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। জিন্নাহর সম্মুখে ছাত্রদের মধ্যে সর্বপ্রথম যিনি নো-নো বলে প্রতিবাদ করে উঠেছিলেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল মতিন। পরবর্তী সময়ে তারই নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ একুশের প্রভাতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ইতিহাস গড়ে ছিল। আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট সরকার, ষাটের দশকের গণআন্দোলন-গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা। সমস্তরই ভিত্তিমূলে ভাষা আন্দোলন। ঘৃণিত লর্ড কার্জনের নামানুসারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের নাম স্বাধীনতার পরক্ষণেই বদলে ফেলা জরুরি ছিল। কেন বদল হয়নি; সেটাও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নিশ্চয়।

দেশের স্থাপনা-সড়ক হতে অনেক কিছুর নাম পরিবর্তন নতুন কিন্তু নয়। ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন্নাহ হল স্বাধীনতার পর মাস্টার দা সূর্যসেন হল নামকরণ করা হয়েছে। ইকবাল হলের নামও শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল নামকরণ পেয়েছে। বঙ্গভঙ্গ সরকারের উপদেষ্টা এবং আইন সভার সদস্য বঙ্গভঙ্গের প্রথম কাতারের সমর্থক এবং নবাব সলিমুল্লাহর তল্পিবাহক সৈয়দ শামস-উল-হোদার সরকারি বাস ভবনটি ‘হোদা হাউস’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল। এই হোদা হাউসকে ১৯৫৭ সালে বেগম রোকেয়ার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল নামকরণ করা হয়। আইয়ুব গেটকে ঊনসত্তরের শহীদ আসাদ-এর নামানুসারে আসাদ গেট। জিন্নাহ এভিনিউ, লিয়াকত এভিনিউ, জিন্নাহ কলেজ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নাম পরিবর্তন করা হলেও বাংলা ও বাঙালি বিদ্বেষী কার্জনের নামানুসারে কার্জন হলের নাম অপরিবর্তিত রয়েছে আজও। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার এক সময়ের রাজধানী কলকাতার অনেক সড়ক, স্ট্রিট, স্থাপনার ইংরেজ শাসকদের নামানুসারে ছিল। সে সমস্তর বেশির ভাগই নতুন নাম পেয়েছে।

কার্জন হল আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের নানাপর্বের কালের সাক্ষী। আমাদের স্বাধীনতার ভিত্তিমূলে ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনে প্রধান সংগঠকের ভূমিকায় ছিলেন ছাত্রনেতা আবদুল মতিন। যিনি ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বদানের জন্য ভাষা মতিন নামে খ্যাতিমান। জিন্নাহর হুমকির বিরুদ্ধে তিনি যেমন দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন। তেমনি সংগঠিত করেছিলেন ভাষা আন্দোলনকেও। তার নামানুসারে কার্জন হলের নাম ‘ভাষা মতিন হল’ নামকরণের মাধ্যমে জাতি তাকে কেবল সম্মান-মর্যাদা প্রদান করবে না- জাতি দায়মুক্তিও লাভ করবে। জীবদ্দশায় তাকে রাজনৈতিক মত পার্থক্যের কারণে যথার্থ সম্মান-মর্যাদা প্রদান করা সম্ভব হয়নি। এমনকি মৃত্যুর পরও তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। বিদ্যমান রাষ্ট্র ব্যবস্থা জনগণের মুক্তি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ। এ বিবেচনায় তিনি রাষ্ট্র পরিবর্তনে রাষ্ট্র ভাঙতে চেয়েছেন। বিপ্লবী মতাদর্শে জনগণের মুক্তির জন্য জীবনব্যাপী লড়াই সংগ্রামে নিজ জীবনকে উৎসর্গই করে গেছেন। এমন ত্যাগী মতাদর্শে অবিচল ব্যক্তি আমাদের সমাজে বড়ই দুর্লভ। আজন্ম বিপ্লবী আবদুল মতিনকে উপযুক্ত সম্মান প্রদানে জাতির কলঙ্ক মোচনের এ সুযোগকে গ্রহণ করা আজ কর্তব্য বলেই সর্বোচ্চ বিবেচনার দাবি রাখে। ঘৃণিত কার্জনের নাম পাল্টে কার্জন হলের নামকরণ ‘ভাষা মতিন হল’ করা হলে আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রামের স্মারক রূপে জাতিকে প্রেরণা জোগাবে, অনুপ্রাণিত করবে।

স্বাধীন দেশে ক্ষমতার হাত বদল হয়েছে। অবাঙালি শাসকের পরিবর্তে স্বজাতি শাসক এসেছে। কিন্তু রাষ্ট্র তো বদলায়নি। রাষ্ট্র কাঠামো সেই সাবেকী আমলের ঐতিহ্য সংস্কৃতি নিয়ে স্বাধীন দেশে বিরাজমান। সে কারণেই অনেক স্থাপনার নাম পরিবর্তন হলেও কার্জন হলের নাম পরিবর্তন হয়নি। বাংলা ও বাঙালি বিদ্বেষী কার্জনের নামানুসারে কার্জন হলের নাম দেরিতে হলেও পরিবর্তন অবশ্যই যোক্তিকতার দাবি রাখে। অনতিবিলম্বে কার্জন হলের নাম পরিবর্তন করে ভাষা আন্দোলনের কিংবদন্তি ‘ভাষা মতিন হল’ নামকরণের জোর দাবি জানাচ্ছি। এতে জাতির কিছুটা দায় মুক্তি ঘটবে বলেই বিশ্বাস করি।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম