জোরের যুক্তি নয়, যুক্তির জোর চাই
রাজীব সরকার
প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
প্রায়ই আমার মনে হয় যে জাতি হিসেবে আমরা চিন্তাশীল নই, চিন্তাগ্রস্ত। চিন্তাচর্চা ব্যতিরেকে কোনো সভ্য জাতি অগ্রসর হতে পারে না। চিন্তাশীলতা বিস্তারের জন্য মুক্তচিন্তা পূর্বশর্ত। মুক্তবুদ্ধির চর্চা যে সমাজে নেই, সেই সমাজ স্থবির হতে বাধ্য। শতাব্দীর প্রাচীনকাল থেকে প্রাচ্যে এবং পাশ্চাত্যে মুক্তবুদ্ধির চর্চা হয়েছে। এমন নয় যে, মুক্তচিন্তার ধারাটি আমরা শুধু পাশ্চাত্য থেকে গ্রহণ করেছি। প্রাচ্যেও মুক্তবুদ্ধি চর্চার গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে। মুক্তচিন্তা ও বাকস্বাধীনতা পরিপূরক। এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে গণতন্ত্রের চেতনা। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য মুক্তবুদ্ধি চর্চার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার বিকল্প নেই। সে পরিবেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে বিতর্ক। শুধু মুক্তবুদ্ধি চর্চা নয়, পূর্ণাঙ্গ শিক্ষালাভের ক্ষেত্রেও বিতর্কের ভূমিকা পরিপূরক।
খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৯ অব্দে প্রাচীন গ্রিসের নগর রাষ্ট্রগুলো থেকে বিতর্কের প্রাতিষ্ঠানিকতা শুরু হয়। ওই সময় সোফিস্ট নামে পেশাদার বিতার্কিক শ্রেণী গড়ে ওঠে। প্রায় ২০০০ বছর পূর্বে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা ও জাতীয় নীতিনির্ধারক বিষয়ে জনগণের মতামত গ্রহণ করা হতো। রাষ্ট্রের সভাসদস্যরা তাদের মতামত তুলে ধরতেন; বিতর্কে অংশগ্রহণ করতেন। এভাবেই এথেন্সে বিতর্ক একটি প্রাতিষ্ঠানিক রুপ লাভ করে। এক্ষেত্রে সোফিস্টরা যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। সে সময়ে প্রত্যেক ছাত্রকে অস্ত্রবিদ্যা, ভূগোল, ইতিহাসবিদ্যার পাশাপাশি বিতর্ক শাস্ত্রে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করতে হতো। উপযুক্ত নেতৃত্ব লাভের অন্যতম শর্ত ছিল বাগ্মিতা। যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের যুক্তিকে দুর্বল করে নিজের মতকে জোরালোভাবে উপস্থাপনার প্রচলিত ধারাটি প্রথম সক্রেটিসের বক্তব্যের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল। তার শিক্ষাদানের নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না। তিনি পথেঘাটে যেখানে-সেখানে সাধারণ জনগণের সঙ্গে দর্শন আলোচনা ও বিতর্কে লিপ্ত হতেন। তিনি বিপরীত পক্ষের জন্য তর্কের ফাঁদ পাততেন এবং পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ না করা পর্যন্ত প্রতিপক্ষকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতেন। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মতপ্রকাশের জন্য তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। তাকে মুক্তি দেয়ার একটি শর্ত ছিল বিতর্কের অভ্যাস ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু তিনি তা মানেননি। তিনি মৃত্যুকেই গ্রহণ করেছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে সক্রেটিসই প্রথম মুক্তচিন্তার জন্য জীবন দিয়েছিলেন।
বর্তমান সময়ে বিতর্কের সবচেয়ে কাছাকাছি মিল লক্ষ্য করা যায় প্লেটো আর প্রোটাগোরাসের সঙ্গে। প্রোটাগোরাসকে বিতর্কের জনক বলা হয়। সক্রেটিস আর প্রোটাগোরাসের বুদ্ধিদীপ্ত তর্কযুদ্ধে আধুনিক বিতর্কের সূচনা হয়েছিল। প্লেটো তার একাডেমিতে যেসব বক্তব্য দিয়েছিলেন তার কোনো প্রামাণিক দলিল নেই। তবে তার সংলাপগুলোতে দার্শনিক অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলকে যুক্তিবিদ্যার জনক বলা হয়। অ্যারিস্টটল প্রথম বিতর্কে যুক্তিবিদ্যার অবতারণা করেন। তিনিই প্রথম যুক্তির একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র প্রদান করেন এবং তা বিতর্কে প্রয়োগ করেন। দীর্ঘ দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে অ্যারিস্টটলের লজিক মানুষের চিন্তার জগতে আধিপত্য বিস্তার করেছে। খ্রিস্টপূর্ব ১৩৩ অব্দে রোমের বিখ্যাত ঋষি ও দার্শনিক সিসেরো সেখানে বিতর্কের সূচনা করেন রোমের সমাজেও বিতর্কের ব্যাপক প্রচলন ছিল। তিনি মনে করতেন সমাজকে কলুষতামুক্ত করতে হলে বিতর্কের প্রয়োজন। ক্লাশরুম ও আদালতে প্রস্তাবের পক্ষে ও বিপক্ষে যে কোনো পাশে কথা বলার এবং নিজস্ব মত প্রদানের পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস যেমন বলেছিলেন ‘নিজেকে জানো’ তেমনি সিসেরো পরামর্শ দিয়েছিলেন সমাজের সঙ্গে বিতর্ক করার আগে নিজের সঙ্গে বিতর্ক করার জন্য।
আধুনিক সময়ে বিতর্কের যে প্রাতিষ্ঠানিক চিত্র আমরা দেখতে পাই তা মূলত ইউরোপের আঠারো শতকের নবজাগরণের সময় হয়েছিল। এ সময়ে লন্ডনে ডিবেটিং সোসাইটি গড়ে ওঠে এবং খুব দ্রুত এটি জাতীয় সংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে ওঠে। সমাজ সংস্কৃতি, রাষ্ট্রনীতি, বিচার, প্রেম-ভালোবাসা সব ক্ষেত্রে বিতর্ক শিল্প একটি স্থান দখল করে নিতে শুরু করে। বাংলাদেশে বিতর্কের সূচনা খুব বেশি পুরনো নয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আশির দশকের প্রারম্ভে বিতর্কের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। বর্তমানে আমাদের দেশে বিতর্ক একটি সংঘবদ্ধ রুপ লাভ করেছে। আমাদের দেশে বিতর্ককে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে বাংলাদেশ টেলিভিশন। বিভিন্ন প্রজন্মের বিতার্কিকগণ বিটিভিতে প্রদর্শিত বিতর্ক অনুষ্ঠান দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত শিক্ষাবিদ Norman Cousins বলেছিলেন, ‘The first purpose of education is to enable a person to speak clearly and confidently.’ স্পষ্টতা ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলতে পারার সামর্থ্য অর্জনকে যদি শিক্ষার উদ্দেশ্য বলে অভিহিত করা হয় তবে এদেশে কতজন শিক্ষিত মানুষ রয়েছেন তা বলা শক্ত। একাডেমিক ডিগ্রিধারী শিক্ষিত মানুষের অভাব নেই। কিন্তু স্পষ্ট করে নিজেকে উপস্থাপন করা- এ বৈশিষ্ট্য খুব বেশি মানুষের নেই। অথচ এটি গুরুত্বপর্ণ যোগ্যতা। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার কোনো স্তরেই শিক্ষার এ প্রাথমিক উদ্দেশ্য অর্জনের কোনো উপায় রাখা হয়নি। তাই বলে এ যোগ্যতা অর্জন অসম্ভব এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।
শিক্ষার উদ্দেশ্য অর্জনে সূচনালগ্ন থেকেই মানুষ তর্ক করে এসেছে। নিজের কৃতকর্মের পক্ষে কারণ তুলে ধরা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি কখনও তর্ক করেননি। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে, সামাজিক ও রাজনৈতিক আচারে তর্কই সবচেয়ে দৃশ্যমান বস্তু। বাঙালি তর্কপ্রিয় জাতি বলেই সম্ভবত টেলিভিশনে টকশো এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। এ তর্কের কথা আমরা বলছি না, বলছি বিতর্কের কথা।
তর্ক নয়, বিতর্কই আমাদের লক্ষ্য। তর্কের সঙ্গে আবেগ, একগুঁয়েমি ও অন্ধবিশ্বাস জড়িত। কখনও কখনও পেশিশক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটে তর্কের পরিণতিতে। তর্ক আর কুতর্কে জড়িয়ে পড়ার অসংখ্য নজির রয়েছে আমাদের সমাজে। সেই অর্থহীন তর্কের সংস্কৃতি থেকে বের হতে হবে। বিতর্ক শিল্প হিসেবে নবীন হলেও শিক্ষিত ও সচেতন সমাজের কাছে এ শিল্প যথেষ্ট সমাদৃত। বিতর্কে তর্ক থাকে, তবে সে তর্ক যুক্তিসিদ্ধ ও কার্যকারণ সংশ্লিষ্ট। বিতর্কে অন্ধ বিশ্বাস বা কুসংস্কারের কোনো ঠাঁই নেই।
বিতর্কে উত্তেজনা থাকে। সে উত্তেজনা পরিশীলিত। আক্রমণ থাকে, সে আক্রমণ শিল্পিত। বিতর্কে দ্বন্দ্ব থাকলেও তা পরমতসহিষ্ণু ও উদার হতে শেখায়। সমাজে বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যে মতপার্থক্য থাকবেই। শক্তিমান মতপার্থক্য একটি সমাজের প্রাণশক্তির পরিচায়ক। বিতর্কে এ মতপার্থক্য চিহ্নিত হয় যুক্তি দ্বারা। এটি অত্যন্ত আশার কথা যে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত বিতর্কের চর্চা হচ্ছে। বিতর্ক প্রতিযোগিতা এখন একটি সংঘবদ্ধ রুপ পেয়েছে। শিক্ষার্থীরা যেন নিয়ম জেনে ও মেনে এই বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন এবং সাফল্য অর্জন করেন সেটিই কাম্য। তবে প্রতিযোগিতার মঞ্চে জয়লাভই বিতার্কিকের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। জীবনের মঞ্চেও জয়ী হওয়া চাই। সেই জয়ের পূর্বশর্ত প্রতিনিয়ত যুক্তির অনুশীলন। মননে ও ব্যক্তিত্বে যুক্তিবাদী হওয়াই বিতার্কিকের চূড়ান্ত অর্জন, জয়-পরাজয় নয়। বিতর্কের জন্য বিতর্ক নয়, এমন এক সমাজ নির্মাণের জন্য বিতার্কিক বিতর্ক করবেন যেখানে জোর নয়, যুক্তি বিজয়ী হয়। যেখানে জোরের যুক্তি নয়, যুক্তির জোর প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিগত সহস্রাব্দের মধ্যভাগে ইউরোপের মানুষের মাঝে জাগরণ এসেছিল।
প্রচলিত নিয়মনীতি, ধর্মবিশ্বাসকে সেদিন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। এ জিজ্ঞাসার মূলে ছিল বিভিন্ন বিজ্ঞানী, দার্শনিকের অনুসন্ধিৎসু রচনা সম্ভার। এ জাগরণের যে ফসল ইউরোপকে সমৃদ্ধ করেছিল তা রেনেসাঁ নামে পরিচিত। রেনেসাঁর হাত ধরেই ইউরোপে আবির্ভাব ঘটে ‘এনলাইটেনমেন্ট’ যুগের। মুক্তবুদ্ধির জাদুবলে অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটে ইউরোপের চিন্তাজগতে, সমাজ কাঠামোতে। রুশো, ভলতেয়ারের মতো চিন্তাবিদের রচনায় অনুপ্রাণিত হয় ফরাসি বিপ্লব। যুক্তিতর্কের মধ্য দিয়ে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল ইউরোপের রেনেসাঁ যা মুক্তবুদ্ধির দ্বার
উন্মোচন করেছিল।
ভারতীয় উপমহাদেশে জাগরণ এসেছিল ঊনবিংশ শতাব্দীতে। সেই জাগরণ বা রেনেসাঁ ছিল খণ্ডিত। কারণ বৃহৎ মুসলিম সমাজকে সেই রেনেসাঁ স্পর্শ করেনি। মূলত হিন্দু মধ্যবিত্তের বিকাশ সাধিত হয়েছিল এ জাগরণে। ডিরোজিওর নেতৃত্বে একদল প্রগতিশীল ছাত্র প্রচলিত সংস্কার, রীতিনীতির প্রতি বিদ্রোহ ঘোষণা করে। হিন্দু কলেজ ও সংস্কৃত কলেজ হয়ে উঠে নতুন চিন্তা ও দর্শনচর্চার ক্ষেত্র। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, বিবেকানন্দ প্রমুখ ছিলেন এ নবজাগরণের অগ্রদূত। তাদের সাবলীল বিতর্কে, তৎপরতায় শাণিত হয়ে উঠেছিল সেই সময়ের চিন্তাধারা।
বাঙালি মুসলমান সমাজে মুক্তবুদ্ধির প্রসারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত। তখন ঢাকায় ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ গড়ে ওঠে মুসলিম সাহিত্য সমাজের নেতৃত্বে। কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হুসেন, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজলের মতো মুক্তচিন্তার বাহকরা ছিলেন এই আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তাদের একটি মুখপত্র বের হতে ‘শিখা’ নামে। এর প্রত্যেক সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা থাকত, ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ এ অসাধারণ উক্তির ভেতর স্পষ্ট হয়ে যায় তাদের জীবনদর্শন। মুক্তবুদ্ধি, প্রগতি ও আধুনিকতার প্রতি তাদের নিষ্ঠা আজও আমাদের বিস্মিত করে।
পূর্বোক্ত আন্দোলন কিংবা সংগঠনের মতো কোনো কার্যক্রম এখন আমাদের চোখে পড়ে না। সেই আন্দোলন কিংবা সংগঠন অনুপস্থিত থাকলেও থেমে নেই সেই লক্ষ্য-মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন জীবনদর্শন নির্মাণের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য পূরণে কাজ করে যাচ্ছে বিতর্ক শিল্প। বিতর্ক আমাদের কিছু প্রশ্ন ও সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষা আমরা বিতর্কের কাছ থেকে পাই-পরমতের প্রতি শ্রদ্ধা। এক অসহিষ্ণু মানসিকতা গড়ে উঠেছে এদেশে। ‘আমিই ঠিক, অন্য সবাই ভুল’- এই মানসিকতায় আক্রান্ত কমবেশি সবাই। বিতর্ক এ ভ্রান্তধারণা থেকে আমাদের মুক্তি দেয়। নিজের বিশ্বাসকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ দেয়। ‘An unexamined life is not worthliving.’- সক্রেটিসের এই বাণী একজন বিতার্কিকেরও বিশ্বাস। অসত্য ও অসুন্দরের বিরুদ্ধে বিতর্ক শৈল্পিক প্রতিবাদ। কুসংস্কার, কূপমণ্ডুকতা ও অন্ধকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হলে মুক্তবুদ্ধি চর্চার কোনো বিকল্প নেই। সেই মুক্তবুদ্ধির অনিবার্য অনুষঙ্গ বিতর্ক।
সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতা কীভাবে মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে এর উদাহরণ আমাদের দেশে এবং বহির্বিশ্বে রয়েছে। ধর্মান্ধতাকে পুঁজি করে একশ্রেণীর দুর্বৃত্ত জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটিয়েছিল এদেশে। যেসব তরুণ বিভ্রান্ত হয়ে এসব আত্মঘাতী দুষ্কর্মে নিজেদের নিয়োজিত করেছিল তারা আকৃষ্ট হয়েছিল ধর্মের অপব্যাখ্যা দ্বারা। যুক্তির আলোয় আলোকিত কোনো তরুণের পক্ষে জঙ্গিবাদে দীক্ষিত হওয়া সম্ভব নয়।
ভলতেয়ার বলেছিলেন, ‘তোমার মতের সঙ্গে আমি একমত না হতে পারি, কিন্তু তোমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আমি জীবন দিতে পারি।’ বিতর্কের মূল চেতনাই এই উক্তিতে ফুটে উঠেছে। শুধু ব্যক্তিজীবনে নয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও যুক্তির অনুশীলন অপরিহার্য। এক্ষেত্রে যুক্তিবর্জিত হলে কী ভয়ঙ্কর পরিণতি দেখা দেয় তার উদাহরণ বিশ্বময় ছড়িয়ে রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়েছিল হিটলারের অযৌক্তিক ও একগুঁয়ে মনোভাবের কারণে। এরপর যত যুদ্ধ বিগ্রহ দেখা দিয়েছে তার কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে কোনো পক্ষের যুক্তিবর্জিত চিন্তাধারা ও পেশিশক্তির প্রদর্শনের প্রবণতা। যুদ্ধের বদলে যখন শান্তির আকাক্সক্ষা ব্যক্ত হয়, রণাঙ্গনের বদলে যখন কূটনীতির টেবিলে সমস্যার সমাধান হয়, তখন যুক্তিরই জয় হয়।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটটি স্মরণ করা যাক। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭০-এর নির্বাচনে জয়ী জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অনীহাই সংঘর্ষের বীজ বপন করেছিল। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে সেটাই হতো যৌক্তিক ও গণতান্ত্রিক আচরণ। কিন্তু তা না করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বর্বরের মতো বাঙালি জাতির ওপর গণহত্যা চাপিয়ে দেয়। তাদের এই নৃশংসতাই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করে এদেশের মানুষকে। এরই পরিণতিতে স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম। বলা যায় ইতিহাসের যৌক্তিক পরিণতিতেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। তাই এদেশে একটি যুক্তিবাদী ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের আকাঙ্ক্ষা খুব তীব্র। এ তীব্রতাকেই ধারণ করছে এ যুগের বিতার্কিক।
মুক্তচিন্তা, বিতর্ক ও গণতন্ত্র অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। গণতন্ত্রের মূলমন্ত্রই হচ্ছে পরমতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীল আচরণ। বিতর্ক আমাদের এই অনুশীলনই করায়। পছন্দ হোক বা না হোক, প্রতিপক্ষের বক্তব্য একজন বিতার্কিককে মন দিয়ে শুনতে হয়। এরপর নিজের অকাট্য যুক্তি দিয়ে তিনি যদি প্রমাণ করতে পারেন যে তার বক্তব্য অধিকতর যৌক্তিক, তবে তিনি বিজয়ী। অর্থাৎ পেশিশক্তি নয়, যুক্তির শক্তি দিয়ে এখানে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হচ্ছে। জোরের যুক্তি নয়, যুক্তির জোর এখানে প্রাধান্য পাচ্ছে। এটিই গণতান্ত্রিক চেতনা। যা যৌক্তিক ও সঙ্গত, যেদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থন সেদিকেই বিজয়।
তাই প্রত্যেক বিতার্কিক একজন ক্ষুদে রেনেসাঁ মানব। মানব সভ্যতার আলোকায়নের যে সুদীর্ঘ যাত্রা, সেই যাত্রায় আজ নেতৃত্ব দিতে হবে বিতার্কিককে। আমরা প্রায়ই শুনি শক্তিশালী গণতন্ত্র ও কার্যকর সংসদের গুরুত্বের কথা। যুক্তিস্নাত সেই রাঙ্গা প্রভাতটি বিতার্কিকরাই এনে দিতে পারেন।
