Logo
Logo
×

যুগান্তরের বিশেষ আয়োজন

সাক্ষাৎকার

কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ আধুনিকায়ন অপরিহার্য: শেখ মোহাম্মদ মারুফ

ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), ঢাকা ব্যাংক পিএলসি

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ আধুনিকায়ন অপরিহার্য: শেখ মোহাম্মদ মারুফ

বাংলাদেশের কৃষি এখন আর কেবল খাদ্যশস্য উৎপাদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এ খাতে হর্টিকালচার, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, অর্গানিক ও রপ্তানিমুখী কৃষিপণ্য উৎপাদনসহ একাধিক সম্ভাবনাময় উপখাত গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে ড্রাগন ফল, স্ট্রবেরি, বিদেশি জাতের সবজি ও ফুলচাষ- এ সব খাতে এখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লাভজনক বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে যুগান্তরকে জানিয়েছেন ঢাকা ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ মোহাম্মদ মারুফ।

যুগান্তর : বাংলাদেশে কৃষি খাতে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে সম্ভাবনা কেমন?

শেখ মোহাম্মদ মারুফ : বাংলাদেশের জাতীয় উৎপাদনে কৃষি খাতের অবদান ১২-১৪ শতাংশের মধ্যে থাকলেও, খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য হ্রাসে এর ভূমিকা অতুলনীয়। কৃষি খাতকে উৎপাদনশীল, টেকসই ও লাভজনক হিসাবে গড়ে তুলতে হলে এ খাতে বিনিয়োগ ও ঋণ বিতরণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন অপরিহার্য। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কৃষি অর্থায়নে যে ইতিবাচক ধারা পরিলক্ষিত হয়েছে, তা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কৃষি খাতে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ হয়েছে, যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের মধ্যে রেয়াতি সুদের আওতায় সরবরাহ করা হয়েছে। মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের বিস্তারের ফলে এখন অনেক কৃষক সহজেই ঘরে বসেই ব্যাংকিং সুবিধা পাচ্ছেন, যা আর্থিক অন্তর্ভুক্তির এক সফল উদাহরণ।

এ ছাড়া কৃষি প্রযুক্তি কৃষি খাতে এক নতুন বিপ্লবের সূচনা করেছে। ড্রোন প্রযুক্তি, মাটি বিশ্লেষণ, স্মার্ট সেচ ব্যবস্থাপনা, মোবাইল অ্যাপভিত্তিক কৃষি পরামর্শসেবা ইত্যাদি প্রযুক্তির প্রয়োগ কৃষকদের উৎপাদন দক্ষতা ও ফসল ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এর ফলে কৃষি খাত দিন দিন একটি বিনিয়োগবান্ধব ও আকর্ষণীয় খাতে রূপ নিচ্ছে।

সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে বলা যায়, কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ ও বিনিয়োগের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে সময়োপযোগী নীতি সহায়তা, প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থাপনা এবং সমন্বিত কৌশল গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ওপর জোর দিতে হবে।

যুগান্তর : আপনার প্রতিষ্ঠান থেকে কৃষি খাতে ঋণ বিতরণে কী কী স্কিম রয়েছে?

শেখ মোহাম্মদ মারুফ : বাংলাদেশের কৃষি খাতকে আধুনিক, টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে হলে কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে প্রযুক্তিনির্ভর আর্থিক সেবা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে ঢাকা ব্যাংক কৃষি অর্থায়নে সময়োপযোগী, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং প্রযুক্তিনির্ভর একাধিক স্কিম চালু করেছে। এগুলো হলো- ১. ‘সুফলা’ স্কিম- প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিঋণ সুবিধা, ২. বিশেষায়িত কৃষি ঋণ ও বিনিয়োগ স্কিমগুলো, ৩. বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন স্কিমগুলোয় সক্রিয় অংশগ্রহণ।

যুগান্তর : কৃষি খাতে বিতরণ করা ঋণ দ্রুত আদায় হয়-এর কী কারণ থাকতে পারে?

শেখ মোহাম্মদ মারুফ : বাংলাদেশে কৃষি খাতে বিতরণকৃত ঋণ বা বিনিয়োগ অন্য অনেক খাতের তুলনায় তুলনামূলকভাবে দ্রুত পুনরুদ্ধার হয়। এ ধারা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একটি ইতিবাচক বার্তা বহন করে, যা তাদের এ খাতে আরও সক্রিয় অংশগ্রহণে উৎসাহিত করে। এর প্রধান কারণগুলো হলো-ক. মৌসুমি আয় ও নির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক ঋণ, খ. ক্ষুদ্রঋণের সহজাত পরিশোধযোগ্যতা, গ. ক্লাস্টারভিত্তিক ঋণ বিতরণ, ঘ. চুক্তিভিত্তিক চাষ, ঙ. সামাজিক ও পারিবারিক দায়বদ্ধতা, চ. নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের নজরদারি ও প্রণোদনা।

বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ ও পুনরুদ্ধারে সক্রিয় মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। পাশাপাশি, বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন স্কিমের আওতায় ৪ শতাংশ সুদে ঋণ পাওয়ার সুযোগ কৃষকদের মাঝে দায়বদ্ধতা ও সচেতনতা বাড়িয়েছে। এটি কেবল ঋণ গ্রহণে আগ্রহ তৈরি করে না, বরং সময়মতো পরিশোধেও অনুপ্রাণিত করে।

যুগান্তর : কৃষি খাতে ঋণ বিতরণে কী ধরনের নীতি সহায়তা দরকার?

শেখ মোহাম্মদ মারুফ : কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ ও বিনিয়োগ বাড়াতে হলে একটি সমন্বিত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং বাস্তবভিত্তিক নীতির প্রণয়ন অত্যাবশ্যক, যা কৃষির মৌসুমভিত্তিক প্রকৃতি, প্রাকৃতিক ঝুঁকি এবং কৃষকের আর্থসামাজিক অবস্থাকে বিবেচনায় নেবে। ঢাকা ব্যাংকের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা মনে করি, নিুোক্ত নীতি সহায়তাগুলো বিশেষভাবে কার্যকর হতে পারে- ক. স্বল্পসুদের ঋণ ও সরকারি ভর্তুকি, খ. কৃষি বিমা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, গ. কৃষিঋণের ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা, ঘ. তথ্যভিত্তিক ক্রেডিট স্কোরিং ব্যবস্থা, ঙ. অঞ্চলভিত্তিক নীতিমালা, চ. কৃষকের প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সচেতনতা বৃদ্ধি, ছ. বাধ্যতামূলক কৃষিঋণ লক্ষ্যমাত্রা ও প্রণোদনা, জ. কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য ও বাজারব্যবস্থা উন্নয়ন।

‘কৃষকের বাজার’ ও ডিজিটাল মার্কেট প্লেসের প্রসার ঘটিয়ে কৃষকদের জন্য সরাসরি বিক্রয় সুযোগ তৈরি করতে হবে। সংরক্ষণ সুবিধা ও পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত হলে তারা ন্যায্যমূল্য পেয়ে ঋণ পরিশোধে সক্ষমতা অর্জন করবেন এবং ভবিষ্যতে আরও বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন।

যুগান্তর : কৃষি খাতে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যাগুলো কী? এসব সমস্যা সমাধানে আপনার প্রস্তাবনা কী?

শেখ মোহাম্মদ মারুফ : কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কয়েকটি মৌলিক ও বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা কৃষকের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, উৎপাদনশীলতা এবং দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উন্নয়নের পথে বড় বাধা তৈরি করে। ঢাকা ব্যাংকের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী প্রধান প্রতিবন্ধকতাগুলো হলো-ক. অপর্যাপ্ত ঋণপ্রবাহ ও উচ্চ সুদহার, খ. জটিল ও সময়সাপেক্ষ ঋণ প্রক্রিয়া, গ. উচ্চঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা, ঘ. আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সচেতনতার ঘাটতি।

উপরোক্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের পক্ষ থেকে নিচের কয়েকটি প্রস্তাবনা উপস্থাপন করছি, যেগুলোর বাস্তবায়ন কৃষি ঋণের টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং উৎপাদনমুখী ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে- ১. ঋণ প্রক্রিয়ার সরলীকরণ, ২. সরকারি ভর্তুকি ও পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা, ৩. প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সচেতনতা, ৪. কৃষি বিমা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, ৫. কৃষি উন্নয়ন তহবিল গঠন।

যুগান্তর : আপনার প্রতিষ্ঠান থেকে কৃষি ঋণ বাড়াতে নতুন কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে?

শেখ মোহাম্মদ মারুফ : ঢাকা ব্যাংক কৃষি খাতে অর্থায়ন বৃদ্ধি, কৃষকের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একাধিক উদ্ভাবনী, সময়োপযোগী এবং প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এসব উদ্যোগের লক্ষ্য হলো একটি কৃষককেন্দ্রিক, সহজ ও সাশ্রয়ী ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা-ক. স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ, খ. ডিজিটাল অনবোর্ডিং ও ‘সুফলা’ প্ল্যাটফর্ম, গ. ক্লাস্টার ক্রেডিট ও ন্যানো লোন, ঘ. বিশেষ সুদের সুযোগ ও প্রণোদনা, ঙ. কৃষি ইন্সুরেন্স ব্যবস্থা।

বাংলাদেশে কৃষি ইন্সুরেন্সের সম্ভাবনা ব্যাপক, বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ একটি দেশে এটি কৃষকদের জন্য একটি সুরক্ষা বলয় তৈরি করতে পারে। ঢাকা ব্যাংক সঠিক নীতি, প্রযুক্তি এবং কৃষক-সংযোগ নিশ্চিত করে কৃষকদের কৃষি ইন্সুরেন্সের আওতায় এনে গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরও সুসংহত করার চেষ্টা করছে।

বাংলাদেশ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম