গল্প
একটি পূর্ণিমা এবং কিছু বিভ্রম

মনিরুস সালেহীন
প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফলো করুন |
|
---|---|
ঘণ্টাকয়েক আগে হয়ে গেছে কালবৈশাখী ঝড়, সঙ্গে প্রবল বর্ষণ। এখন চারপাশ শান্ত, সমাহিত। হালকা ঠান্ডা বাতাস বইছে। বৃষ্টিস্নাত স্নিগ্ধতার চাদর গায়ে চেপেছে প্রকৃতি। অদূরের কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচটা ছেয়ে আছে স্খলিত লাল ফুল আর ছোট ছোট ডালপালায়, যেন একটা সুন্দর আল্পনাকে লেপ্টে দিয়েছে কোনো অবোধ শিশু।
বিকাল থেকে রসালো জমাট আড্ডায় মত্ত ছিলেন পাঁচ বন্ধু। মুকিত সাহেব ও তার বন্ধুরা। ঝড় শুরু হতেই কারেন্ট চলে গিয়েছিল। ঘরের কাচের জনালা দিয়ে কালবৈশাখীর তাণ্ডব দেখেছিলেন তারা। গাছ থেকে টপাটপ নিচে পড়ছে কাঁচা আম, কয়েকজন ছেলেমেয়ে সেগুলো কুড়োচ্ছে। চোখের সামনেই দেখা গেল একটা গাছে একদিকে হেলে পড়ছে। দৃশ্যের প্রতিটি ঘটনারই ধারাবর্ণনা দিয়েছিলেন কেউ না কেউ। একজন বলেছিলেন, যেন স্বগত সংলাপ, যাব নাকি, আম কুড়াতে?
শহরের ফ্ল্যাট বাড়িতে কখন বৃষ্টি হয়, কখন ঝড় ওঠে কিছুই টের পান না তারা। এখানে ঝড়ে গাছপালার উন্মত্ত উদ্দাম নৃত্য, বাতাসে তীব্রতায় প্রায় উড়ে যেতে থাকা ছেলেমেয়ের মাটি আঁকড়ে আম কুড়ানো-এসবই তারা দেখেন পুরস্কার জয়ী আর্ট ফিল্ম দেখার মুগ্ধতা নিয়ে।
পাঁচ বন্ধুকে নিয়ে গ্রামে বেড়াতে এসেছেন মুকিত সাহেব। বন্ধুদের মতো তিনিও কাজ থেকে অবসরে গিয়েছেন সম্প্রতি। স্ত্রীর অনিচ্ছা ও বারণ সত্ত্বেও গ্রামে একটা ছোট্ট দোতলা বাড়ি করেছেন। বাড়ির সামনেই বেশ পুরোনো বড় পারিবারিক পুকুর, দুয়েক মিনিট হাঁটলেই নদী, চারপাশের সবুজ জমি আর গাছগাছালির ছায়াঘেরা বাড়ি। অবসরের পর মাঝে মধ্যে এখানে বেড়াতে আসবেন-সপরিবারে কিংবা সবান্ধব-এমন ভাবনা থেকেই তৈরি হয়েছিল বাড়িটা। খুব ভালো লাগে তার এ বাড়ি আর চারপাশের পরিবেশ। সুযোগ পেলেই আত্মীয়, বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানান তার গ্রামের বাড়ি বেড়াতে আসতে।
দুপুরে মনে হয়েছিল এ গরমে বন্ধুদের নিয়ে গ্রামে বেড়াতে আসা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হয়নি। গ্রীষ্মের দাবদাহে প্রকৃতি তখন যেন আগুনে শ্বাস ফেলছিল। বাতাসবিহীন সময়ে চারদিকের নিষ্পলক পত্রপল্লবের ফাঁক গলে যেন সেই নিশ্বাসই গায়ে লাগছিল।
তারপরও বন্ধুরা শুরু থেকেই উপভোগ করছে গ্রামীণ পরিবেশ। বয়সের হিসাবে তাদের বৃদ্ধ বললে অত্যুক্তি হয় না। কিন্তু তারা নিজেদের বৃদ্ধ ভাবে না, দেখতেও বৃদ্ধ মনে হয় না তাদের। দুপুরে পাঁচজনের চারজনই পুকুরে নেমে গোসল করেছে। গ্রামের মানুষ তাকে কখনো লুঙ্গি পরে কিংবা খালি গায়ে দেখেনি, তাই মুকিত সাহেব আর নামেননি, পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন বন্ধুদের সন্তরণ। অপর পাড় থেকে কৌতূহল নিয়ে শহুরে বুড়োখোকাদের জলকেলি দেখেছিল গোসল করতে আসা গ্রামের ছেলে যুবারা।
কবিবন্ধু রহিম শিকদার এ সফরের নাম দিয়েছেন পূর্ণিমা বিহার। ক্যালেন্ডারের হিসাবে আজ বৌদ্ধ পূর্ণিমা।
সন্ধ্যা উতরাতেই তারা এসে বসেন দোতলার খোলা বারান্দায়। মেঘে ঢাকা আকাশ। পূর্ণিমার আবহ আছে চারদিকে কিন্তু চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। দক্ষিণের স্নিগ্ধ ঠান্ডা বাতাস তাদের গায়ে আরামের পরশ বুলিয়ে দেয়। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তারা টুকটাক গল্প করেন।
‘ইসস, কত দিন পর এমন গ্রামীণ পরিবেশে এসেছি। কারেন্ট চলে যাওয়ায় ভালোই হয়েছে, দেখ, কেমন মায়াবী লাগছে এ পরিবেশটাকে। ব্যাঙের ডাক, জোনাকির শব্দ আর নাম না জানা পোকাদের কলরব,’ কবির কণ্ঠে মুগ্ধতা।
“আরে, তোমার পূর্ণিমা বিহারের সেই চাঁদের মুখই তো দেখতে পেলাম না এখনো, কৃত্রিম খেদ নিয়ে বলে ব্যবসায়ী বন্ধু খালেদ।
তার দিকে তাকিয়ে কবি সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে,‘মনে হয় জীবনে কখনো প্রেম করোনি!’
হঠাৎ প্রেমের প্রসঙ্গে যেন ভ্যাবাচ্যাকা খায় খালেদ। সে কিছু বলার আগেই কবি বলে, ‘অভিসারের নির্ধারিত জায়গায় গিয়ে প্রেমিকার জন্য অপেক্ষা করলে ঠিক বুঝতে অপেক্ষাও কেমন মধুর। এখন আমরা তেমনি অপেক্ষা করছি চাঁদের জন্য। একটু রসো, চাঁদের দর্শন ঠিক পাবে।’
খালেদ ছাড়া অন্যরা হেসে উঠে কবির কথায়। অস্পষ্ট আলোয় তার বিব্রত মুখ কারোর নজরে পড়ে না। সে হাল ছাড়েন না, বলে, ‘তোমার মতো বিশ্বপ্রেমিক আর হতে পারলাম কোথায়!’ আবারো হাসি।
‘টাকার প্রেমে আছ, ওইটা নিয়েই থাক। তোমার আর কবির মতো প্রেমিক হওয়ার দরকার নাই।’ ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন থেকে রিটায়ার করা মাহবুব যোগ দেয় খালেদের লেগ পুলিং-এ।
তিন তাসের খেলায় জ্যাকের জোড়ার ওপর টেক্কার ট্রয়ের মতো বিস্ময় নিয়ে হঠাৎ আকাশে উদ্ভাসিত হয় চাঁদ। বন্ধুদের লেগপুলিং, চাপানউতোর নিমিষেই হারিয়ে যায় চাঁদের উদ্ভাসনে।
পূর্ণিমার চাঁদের লুকোচুরি খেলাটা তাড়িয়ে উপভোগ করেন তারা। মেঘের সঙ্গে চাঁদের লুকোচুরি। সম্ভাব্য প্রেমিকের সঙ্গে গ্রামের দুষ্টু কিশোরী যেমন দেউরির ফাঁক দিয়ে একবার মুখ লুকিয়ে পরক্ষণেই আবার খিলখিল হাসি নিয়ে মুখটা বের করে আনে, চাঁদও যেন তেমন করে মেঘের সঙ্গে। ঝড়মথিত, বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় পূর্ণিমার চাঁদকে এমনি মনে হয় কারোর।
চাঁদের দিকে মুখ করে বসে আছে সবাই। কেউ কারো মুখ দেখে না।
কবিবন্ধু বলে, ‘দেখ দেখ, মনে হচ্ছে না চাঁদটা এখন কোনো পর্বতের চূড়া অতিক্রম করছে?’
মুকিত সাহেবের মনে হয়, ঠিক তাই। কিংবা চাঁদকে মনে হয় একটা ভেলা, মেঘের সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে।
কেউ কথা বলে না। সব মনোযোগ লাস্যময় পূর্ণযৌবনা চাঁদের দিকে। এর আগে কবে এত আগ্রহ নিয়ে কেউ চাঁদ দেখেছিল? নিজের মনে প্রশ্ন জাগে মুকিত সাহেবের। রিটায়ারমেন্টের পর তিনি গ্রামে আসেন প্রায় প্রতি মাসেই। তারও দেখা হয়নি এমনি চাঁদ। বিশেষ করে এমনি ঘটা করে কিংবা বৃষ্টিস্নাত রাতে সবান্ধব বা সপরিবারে। বন্ধুদের সঙ্গে তিনিও উপভোগ করেন।
হঠাৎ করে কানে আসে একটা সুরেলা কণ্ঠের গান। বন্ধু চান্নু গান ধরেছে, জনপ্রিয় একটা গান- আকাশ ভাইঙা জোসনা পড়ে, আমার ঘরে জোসনা কই চান্নু এখনো অভিনয় করে বিভিন্ন চ্যানেল ও টিভির নাটকে, বেশ ভালোই করে কিন্তু ওর গানের গলাও যে এত ভালো বন্ধুরা কেউ আগে জানত না। নির্বাক মুগ্ধতায় বন্ধুদের কান চান্নুর গানে, চোখ আকাশে।
ষাট বছর বয়সি একজন কেমন নিঃসংকোচে গলা ছেড়ে গান গাইছে! তাও এমন পরিবেশে। হয়তো তার গান অদূরে পাড়ার চা স্টলের আড্ডাবাজদের কানেও পৌঁছে যাচ্ছে। মুকিত সাহেব ভাবেন, মেঘের সঙ্গে চাঁদের সলাজ লুকোচুরি, একটু আলো, একটু আঁধারিই যেন যৌবনের নিঃসংকোচ উন্মাদনা এনে দেয় বয়স্কদের মধ্যেও।
ব্যালকনির দরোজায় উঁকি দেয় একজন। মাঝ বয়সি হিরা মিয়া। মুকিত সাহেবের পাড়ার লোক, পাড়া সম্পর্কের ভাস্তে, হিরার সঙ্গে সকালেই সবার পরিচয় হয়েছে। তখনই কথা প্রসঙ্গে সে জানিয়েছিল যে অতিথিদের জন্য সে আগের রাতে বড়শি দিয়ে মাছ ধরেছে পুকুর থেকে। রাতের বেলায় ছিপ দিয়ে কীভাবে মাছ ধরা যায় তা জানেন না মুকিত সাহেব। গ্রামের ছেলে হলেও তিনি নিজে কখনো তা করেননি বা কাউকে করতে দেখেননি।
সেটা জিজ্ঞেস করতেই হিরা আত্মপ্রতয়ের হাসি দিয়ে বলে, ‘আছে টেকনিক।’
ছোটবেলা থেকেই পাকা মৎস্য শিকারি হিরা মিয়া। মুকিত সাহেব নদীর ফ্রেশ মাছ পছন্দ করেন। তিনি বাড়ি আসবেন শুনলে সে ব্যস্ত হয় ব্রহ্মপুত্রে নেমে তার জন্য মাছ ধরতে।
অন্ধকারে মাছ ধরার টেকনিকটা কী তা সবাই শোনে। সহজ টেকনিকই। পুকুরে বড়শি ফেলে একটা টর্চ দিয়ে আলো ফেলতে হয় ফাতনার ওপর। তাতেই বোঝা যায় মাছ কখন টোপ গিলছে।
খালেদ সাহেব সায় দিয়েছিলেন হিরার কথায়। ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ছোটবেলায় এভাবে গ্রামের পুকুরে আমিও মাছ ধরেছি।’ তারপর মাঝ বয়েসি হিরার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘ভাই আপনি আজ রাতে আবার মাছ ধরার ব্যবস্থা করবেন। আমিও ধরব।’
আলম খোঁচা দিয়ে বলেন, ‘হ, মজা কম না! পূর্ণিমা দেখতে দেখতে মাছও ধরা! তবে তোমরা যেভাবে খেলায় মজো তাতে পূর্ণিমা দর্শন আর মৎস্য শিকার দুটিই না ফসকে যায়!’
এ বন্ধুটি হজ করার পর আর তাস ছোঁয় না, জীবনে কখনো নিষিদ্ধ পানীয়তে ঠোঁট ভিজায়নি। ইদানীং শুভ্র শশ্রূমণ্ডিত বন্ধুটি এক সময় ছিল মেয়েদের হার্টথ্রব। বন্ধুদের কার্ড খেলার আড্ডায় নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকে পাশে, মাঝে মধ্যে টুকটাক মন্তব্য করে, আবার আজান পড়লেই ছুটে যায় মসজিদে। বন্ধুদের সব আড্ডার সে কো-অর্ডিনেটর। খেলার সময় তাকে পাশে না দেখলে কেউ না কেউ বলবেই, ‘আমাদের আম্পায়ার গেল কই?’
হিরাকে দেখেই আলম বলে, ‘এই খালেদ, উনি বোধহয় মাছ ধরবেন। তোমাকে মনে হয় নিতে আসছেন। তুমি না মাছ ধরবে বলেছিলে?’
হিরা জানায়, আসলেই তা-ই। সে মাছ ধরতে বড়শি ফেলবে। জানতে এসেছে খালেদ যাবেন কি না।
খালেদ সোৎসাহে জানান তিনি যাবেন।
আবারও কবি বন্ধুর লেগপুলিং-এর শিকার হয় খালেদ। ‘এই চমৎকার পূর্ণিমা রেখে তুমি যাবে মাছ ধরতে! মৎস্য ধরিবো, খাইবো সুখে-এটাই তো তোমার মোটো। কখনো ধরো চায়নায়, কখনো বাংলাদেশে।’ মিলিত হাসির রোল উপেক্ষা করে খালেদ হিরার অনুগামী হয়।
মেঘলা আকাশে ভেসে বেড়ায় পূর্ণিমা চাঁদ। নিচে রহস্যময় আলো-আঁধারির এক স্যুরিয়েলিস্টিক পরিবেশ। ব্যালকনি থেকে দেখা যায় হিরা মিয়া শানবাঁধানো পুকুর ঘাটে ছিপ নিয়ে বসে আছে। তার পাশে আরেকটা ছিপ নিয়ে আছে খালেদ। অন্য একজন টর্চ ফোকাস করে আছে ফাতনার ওপর। নিবিষ্ট মনোযোগ দিয়ে হিরা ফাতনার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে দেখে মনে হয় না আশপাশের অন্য কোনো কিছুর দিকে তার খেয়াল আছে।
বারান্দায় চা, স্ন্যাক্স, অম্লমধুর বাতচিত, কখনো রাজনীতির বিশ্লেষণ, কখনো আদিরসাত্মক জোক সহযোগে বন্ধুদের আড্ডা চলে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে মুকিত সাহেব নিরিখ করে লক্ষ করেন মাছ ধরায় হিরার নিবিষ্ট মনোযোগ। মাছ ধরার আনন্দ তো আছেই, সঙ্গে নিশ্চয়ই এটাও তার মাথায় আছে- ভালো মাছ পেলে কাকা, মুহিত সাহেব, খুব খুশি হবেন আজ। বিনিময়ে যাওয়ার সময় দেবেন অন্যবারের চেয়েও বড় বখশিশ।
বাপের যেটুকু জমি পেয়েছিল তা বিক্রি করে কাতার গিয়েছিল হিরা। থেকে এসেছে প্রায় চার বছর। প্রবাস জীবনের কষ্ট আর শ্রমের বিনিময়ে বাড়িতে একটা আধাপাকা ঘর তুলেছে। ছেলে সন্তান নেই, দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে। ছোটটির বর তাদের সঙ্গেই থাকে ঘরজামাই হিসাবে।
এখন সে আধাপাকা বড়োসড়ো একটি ঘরওয়ালা ভূমিহীন। নদী-পুকুরে খাল-বিলে মাছ শিকারের তীব্র অদম্য নেশা ছেড়ে এ হিরাই গিয়েছিল মরুর দেশে। কীভাবে সে এসব ছাড়া বেঁচেছিল সেখানে? মুকিত সাহেবের মনে হয় অন্ধকারে মাছেদের টোপ গেলার মতোই হিরাও গিলেছিল বিদেশ যাওয়ার টোপ, সে টোপ গিলে জলের সজীব হিরা উঠে এসেছিল মরুময় ডাঙায়। তারপর নিশ্চয়ই কাতরে ছিল তা বড়শিতে গাঁথা ডাঙায় তোলা মাছেদের মতোই।
মুকিত সাহেবের চেয়ে পাঁচ-সাত বছরের ছোট হিরা এক সময় ছিল তাদের খেলার সঙ্গী। প্রায় চার বছর প্রবাস জীবন কাটিয়েছে সে, নিজের স্মার্ট ফোনে ওখানকার ছবি দেখিয়েছে সে মুহিত সাহেবকে। বিশ্বকাপের একটা ম্যাচও নাকি দেখেছিল! ছয় মাসের পাওনা না দিয়েই নাকি তাকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে কোম্পানি। ফিরেছে প্রায় খালি হাতেই। পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য এখন সে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে। অন্য অনেকের মতো মুখ ফুটে সে কখনো কিছু চায় না মুকিত সাহেবের কাছে। কিছু দিলে কৃতজ্ঞতাভরা হাসিমুখে তা গ্রহণ করে।
পাশাপাশি দুজন বড়শি ফেলেছে। খালেদের জন্য ওটা বিনোদন। আর হিরার ভাবনায় হয়তো বড় মাছ ধরে মুহিত সাহেব তথা তার অতিথিদের মনোরঞ্জন, নাকি মাছ ধরতে পারার আনন্দই কেবল!
পুকুরঘাট থেকে হঠাৎ ভেসে আসা গুঞ্জনে বোঝা যায় মাছ গেঁথেছে। হিরার বড়শিতে। ব্যালকনির রেলিং ধরে বন্ধুরা সবাই ঔৎসুক্য নিয়ে দেখে মাছটাকে খেলাচ্ছে হিরা। বড় মাছই হবে মনে হয়।
একটু পরই বালতিতে করে হিরা মাছটা নিয়ে আসে দোতলার বারান্দায়। কিলো দুয়েক ওজনের রুই লেজ নাড়ায় বালতিতে।
বালতিটা মুকিত সাহেবদের সামনে রাখতে রাখতে বলে, ‘আপনাদের রাশিটা খুব বালা। রাইতের বেলা বড় মাছ তো আধার খায় না। আইজ কেমনে যে খাইল!’
বন্ধুরা উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে মাছের, হিরার। পূর্ণিমার আলোতে চকচক করে মাছের শরীর। কিন্তু অনেক বেশি চকচক করে হিরার মরুদগ্ধ মুখ। মুকিত সাহেব মাছ দেখার চেয়েও বেশি মুগ্ধতা নিয়ে দেখেন অব্যাখ্যেয় আনন্দে উদ্ভাসিত সেই মুখ। কত সামান্য প্রাপ্তিতেই হিরা মিয়ারা যে কত বেশি আনন্দিত হতে পারে!
মেঘের বাতাবরণ ডিঙিয়ে চাঁদ হাসছে আকাশে। মুকিত সাহেব সেদিকে তাকান। আবার তাকান হিরার দিকে। পূর্ণিমা মনে হয় তার মধ্যে এক ধরনের বিভ্রম তৈরি করে। তিনি ঠিক বুঝতে পারেন না কোনটা বেশি উজ্জ্বল-পূর্ণিমার চাঁদ নাকি হিরা মিয়ার মুখ।