Logo
Logo
×

যুগান্তরের বিশেষ আয়োজন

ধর্মভেদে গরু ও অনাচারের রাজনীতি

Icon

মযহারুল ইসলাম

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ভারতবর্ষের ইতিহাসে গরু জবাইকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, রক্তপাতের অজস্র ঘটনা ঘটেছে। এখনো যে ঘটছে না, তা নয়। ভারতের বর্তমান হিন্দুত্ববাদী সরকারের শাসনামলে সেটা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন রাজ্য-সরকারে বিজেপি ক্ষমতায় থাকায়, ওই সব প্রদেশে গো-হত্যা নিষিদ্ধ। পৃথিবীতে এমন দৃষ্টান্ত কোথাও না থাকলেও, ভারতে কেন রয়েছে ? কারণ, ভারতে উগ্র হিন্দু ধর্মান্ধরা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। অহিন্দুদের কেবল খাদ্য অধিকারে হস্তক্ষেপ নয়, তাদের ভারত-ছাড়া করতে নানা আইন প্রণয়ন চলছে। অথচ গরু হত্যা করে গরুর হিমায়িত মাংস বিশ্বজুড়ে রপ্তানিতে গো-রক্ষার কোনো ধার ধারছে না। কেবল ভারতীয় অহিন্দুদের খাদ্যাভ্যাসে করে চলেছে অন্যায় হস্তক্ষেপ। ভারতকে তারা হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষণার তালে আছে। ভারতে এখন মানুষের জীবনের চেয়েও গরুর জীবন অনেক বেশি মূল্যবান। যদিও হিন্দুশাস্ত্রে গরু জবাই এবং গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ নয়। হিন্দুদের দেবতা শ্রীকৃষ্ণ গাভির দুধ পান করে জীবন রক্ষা করেছিলেন বলেই কৃতজ্ঞতায় হিন্দুরা গরুর মাংস খাওয়া ত্যাগ করেছে কেবল সেজন্য নয়, কৃষি কাজে গরুর ব্যবহার যেন অক্ষুণ্ন থাকে সেটাও কারণ। গরুর মাংস খাওয়া তাদের ব্যবহারবিরুদ্ধ, তবে শাস্ত্রবিরুদ্ধ নয়। অতীতে হিন্দুরা এমনকি ব্রাহ্মণরা পর্যন্ত গরুর মাংস খেত। শূদ্ররা এখনো খায়। করোনাকালে করোনা থেকে রক্ষার একমাত্র উপায় হিসাবে হিন্দুত্ববাদীদের নির্দেশে গরুর মূত্র পান এবং গরুর মল-মূত্র দিয়ে øান করেছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের অজস্র মানুষ। ধর্মীয় এ নির্দেশ যারা পালন করেছিল তাদের অনেকেই করোনায় প্রাণ হারিয়েছিল। ব্যক্তিগতভাবে ভারত ভ্রমণে অনেক মন্দিরে গিয়েছি। অনেক মন্দিরে বিশালাকার পাথরের বসে থাকা ষাঁড়ের মূর্তি দেখেছি। গাভির দুধ পানে শ্রীকৃষ্ণের জীবন রক্ষা পেয়েছিল; সে-কৃতজ্ঞতা তাদের রয়েছে, কিন্তু ‘মন্দিরে ষাঁড়ের মূর্তি কেন? ষাঁড়ের মূর্তির নিম্নাংশে খোদাই করা ‘নন্দী’ নাম দেখেছি। হিন্দু পুরাণ মতে হিন্দুদের তিন দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব। শিবের স্ত্রী (পার্বতী) দুর্গা। তাদের দুই ছেলে কার্তিক ও গণেশ এবং দুই মেয়ে সরস্বতী ও লক্ষ্মী। শিবের বাহন ছিল নন্দী। এ ছাড়া শিবের প্রধান দুই অনুচর নন্দী ও ভৃঙ্গি। নন্দী ছিল বামন আকৃতির, দুই হাত খাটো, দেখতে কুৎসিত ছিল বলেই নন্দীর কুৎসিত দেহকে আড়াল করতে ষাঁড়ের রূপ দেওয়া হয়েছে। ষাঁড়রূপী নন্দী যেহেতু শিবের অনুচর এবং বাহন সেজন্য ষাঁড়ের প্রতিও হিন্দুদের সমান শ্রদ্ধা এবং পূজনীয় আচার লক্ষ করেছি। নন্দীরূপী ষাঁড় মূর্তিকে নন্দী ঠাকুর অভিধায় হাঁটু গেড়ে বসে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতেও দেখেছি। ব্যবহারিক আচারের আনুগত্যে হিন্দু সম্প্রদায়ে গরু হত্যা এবং গরুর মাংস পরিত্যক্ত হয়েছে। নিজেরা না খেলেও অন্যদেরও গো-হত্যা, গরুর মাংস খাওয়ায় বাধা প্রদানকে ধর্মীয় অনুষঙ্গ হিসাবে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা আরোপ করেছে। বিজেপি সরকারের গো-হত্যা নিষিদ্ধ ঘোষণায় সেটাই প্রমাণ করে।

হিন্দু শাস্ত্রমতে বিধবাবিবাহ নিষিদ্ধ নয়। এক সময়ে বিধবাদের প্রয়াত স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যেতে বাধ্য করা হতো। রাজা রামমোহন রায়ের দীর্ঘমেয়াদী পরিশ্রমের ফলে আইনিভাবে ঘৃণিত সতীদাহ প্রথার বিলোপ ঘটেছিল। কিন্তু এরপরও অজ্ঞাতে প্রচুর বিধবা নারীকে স্বামীর চিতায় জোরপূর্বক হত্যার ঘটনা ঘটেছে। কালক্রমে সেই ঘৃণিত প্রথা থেকে হিন্দু বিধবাদের প্রাণ রক্ষা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বিধবাবিবাহ প্রথা সমাজে নিষিদ্ধ ছিল শত-সহস্র বছর। বিধবাবিবাহ ঠেকাতে শঠতার উপাদানরূপে গরুর মাংস প্রয়োগের ঘটনাও ঘটেছে। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়’র রানী ভবানী গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে সেই ঘটনার। হিন্দু ধর্মমতে, বিধবাবিবাহ শাস্ত্রমতবিরুদ্ধ ছিল না। পলাশীর প্রতারক যুদ্ধের অন্যতম কুশীলব এবং মুর্শিদাবাদের নবাবি আমলের ঢাকার প্রধান নবাব-প্রতিনিধি রাজা রাজবল্লভ নিজ তরুণী বিধবা কন্যার কঠোর নিয়মরীতির পীড়নে ব্যথিত হয়ে বিধবা কন্যার বিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ঢাকা এবং বিক্রমপুরের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের সঙ্গে পরামর্শ করে এবং আশপাশে খোঁজখবর নিয়ে সিদ্ধান্তে নেন বিধবা কন্যাকে তিনি আবারও বিয়ে দেবেন। এ জন্য নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এবং নবদ্বীপের পণ্ডিতদের সম্মতি আদায়ের উদ্দেশ্যে নিজ অঞ্চল বিক্রমপুরের পণ্ডিতদের নৌকাযোগে নবদ্বীপ পাঠিয়েছিলেন। পণ্ডিতরা নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে বিস্তারিত জানালে কৃষ্ণচন্দ্র বিধবাবিবাহে অসম্মত হলেও প্রকাশ্যে আগত পণ্ডিতদের এক ধরনের সম্মতি প্রদানে শঠতার আশ্রয় নিয়েছিলেন। নিজ পণ্ডিতদের গোপনে বিধবাবিবাহে অসম্মতি প্রদানের কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। শেষে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বিক্রমপুরের পণ্ডিতদের বিধবাবিবাহের প্রস্তাব ঠেকাতে গোপাল ভাঁড়কে ব্যবহার করেন। বিক্রমপুরের পণ্ডিতদের রাতের খাবার নিয়ে গোপাল ভাঁড় নৌকায় যায়। পণ্ডিতরা খাবারের মধ্যে গরুর মাংস দেখে একযোগে রাম রাম বলে তীব্র ঘৃণায় চিৎকার করে ওঠে। গোপাল ভাঁড় তাদের বলে, ‘গো-মাংস খাওয়া শাস্ত্রবিরুদ্ধ নয়, এগুলো আপনাদের আহার করতেই হবে।’ একথা শুনে পণ্ডিতরা বলে ওঠেন, ‘শাস্ত্রসম্মত হলেও গো-মাংস ভক্ষণ ব্যবহারবিরুদ্ধ। এটা খাওয়া অসম্ভব।’ গোপাল ভাঁড় এ কথারই অপেক্ষা করছিল। স্মিত হেসে গোপাল ভাঁড় বলে, ‘যদি ব্যবহারবিরুদ্ধই হয় তাহলে বিধবাবিবাহ প্রচলন করতে এসেছেন কেন? বিধবাবিবাহ শাস্ত্রবিরুদ্ধ না হলেও ব্যবহারবিরুদ্ধ। গো-মাংসও তেমনি ব্যবহারবিরুদ্ধ। কোনটিই মানা যায় না।’ এ ঘটনার পর রাতের অন্ধকারে রাজা রাজবল্লভের প্রেরিত বিক্রমপুরের পণ্ডিতরা নবদ্বীপ ত্যাগ করেন। ঘটনাটি প্রসঙ্গে স্বয়ং লেখক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় বলেছেন, এ ঘটনার তথ্য প্রমাণ তার কাছে নেই। তবে জনশ্রুতিতে এ কাহিনী বহুল প্রচলন বলেই ঘটনাটি ‘গ্রন্থে’ উল্লেখ করেছেন। বহু লড়াই-সংগ্রাম করে অবশেষে বিধবাবিবাহ প্রথা সমাজে প্রচলন করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গরু বা গরুর মাংসের ব্যবহার ইতিহাসের নানা পর্বে ঘটেছে। ১৮৫৭ সিপাই বিপ্লবের মূলে ভারতীয় সিপাইদের শোষণ-বঞ্চনার নানা যৌক্তিক কারণ থাকলেও, উপলক্ষ্যটা ঘটেছিল এনফিল্ড রাইফেলের গরু ও শুকরের চর্বি মাখান টোটার ব্যবহার নিয়ে, যেটি দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে রাইফেলের নলে ঢোকাতে হতো। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের সিপাইরা টোটা ব্যবহারে অস্বীকৃতি জানায়। ইংরেজরা টোটা ব্যবহারে অস্বীকারকারী সিপাইদের কামানের মুখে সারিবদ্ধ দাঁড় করিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ভারতবর্ষব্যাপী সিপাই বিপ্লবের সূচনাটি ঘটে। টোটা সংক্রান্ত এ ঘটনার সত্যতা নিয়ে ভিন্নমতও অবশ্য রয়েছে। বাস্তবে শোষণ-বঞ্চনার বিষয়টিই বিদ্রোহের মূল কারণ ছিল। দুই সম্প্রদায়ের মিলিত সিপাই বিপ্লবকালে কুরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে বিভক্তির আশঙ্কা দেখা দেয়। মুসলিম সম্প্রদায় তাদের রীতি অনুযায়ী ঈদে গরু কুরবানি দেবে। যেটা হিন্দু সম্প্রদায় মেনে নেবে না। বিদ্রোহী সিপাইদের ঐক্য শঙ্কার মুখে। গরু কুরবানি নিয়ে দাঙ্গার প্রবল সম্ভাবনাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বিদ্রোহ দমনে আর শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন পড়বে না, দুই সম্প্রদায়ের দাঙ্গা-বিরোধকে কেন্দ্র করে বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটবে, এমনটাই আশা করছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ শাসকরা। লর্ড ক্যানিংকে কোম্পানির প্রভাবশালী ইংরেজ হেনরী লরেন্স ওই সময়ে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে (কুরবানি ঈদের গরু জবাই নিয়ে) বিরোধ বাধবে, আমি তার অপেক্ষায় আছি।’ মুসলিম নেতৃত্বের বিচক্ষণতায় ইংরেজদের আশাপূরণ না হওয়ায় পরবর্তীতে ইংরেজ এইচসন এ নিয়ে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করে বলেছেন, ‘এ ক্ষেত্রে মুসলমানদের আমরা হিন্দুদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছি।’ ধর্মবিশ্বাসী মুসলমানরা গরু কুরবানি দিতে না পারলে অসন্তষ্ট ও ক্ষুব্ধ হয়ে অঘটন ঘটাবে। অপরদিকে হিন্দু সম্প্রদায় গো-হত্যার প্রতিবাদে বিদ্রোহ থেকে সরে দাঁড়াবে, এটা অস্বাভাবিক ছিল না। অথচ উত্তেজনাকর ওই পরিস্থিতিতে দুই সম্প্রদায়ের ঐক্যের কোনো বিকল্প ছিল না। দায়িত্বসচেতন মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতারা সেদিন যথার্থই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন। উত্তর প্রদেশের বেরলীর বিদ্রোহী প্রধান বাহাদুর খান ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘হিন্দু সিপাইরা যদি এ বিদ্রোহে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে তবে বেরলীতে কুরবানি ঈদে গরু কুরবানি দেওয়া হবে না।’ বেরলীতে এমন কি গরু জবাই পর্যন্ত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।

মোগল সাম্রাজ্যের ক্ষমতাহীন শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে বিদ্রোহী সিপাইরা বিদ্রোহের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল। বাহাদুর শাহ জাফর পরিস্থিতি বিবেচনায় অত্যন্ত সাহসিকতায় ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘কুরবানি ঈদ উপলক্ষ্যে দিল্লীতে কোনো গরু জবাই করা চলবে না। যদি কোনো মুসলমান এ নির্দেশ অমান্য করে, তাহলে তাকে তোপের মুখে উড়িয়ে দেওয়া হবে। অন্যকোনো মুসলমান যদি এ ব্যাপারে কাউকে সাহায্য করে তবে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।’ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর নিজে কুরবানির ঈদের দিন নামাজ আদায়ের পর একটি ভেড়া জবাই করে সিপাই বিদ্রোহের ঐক্য রক্ষা করেছিলেন। ফলে ১৮৫৭ সালের ১ আগস্ট কুরবানির ঈদে গরু কুরবানি দেওয়া নিয়ে দুই সম্প্রদায়ের বিরোধ ঘটেনি। ঈদের নামাজ আদায় এবং ভেড়া, খাসি, দুম্বা, ছাগল কুরবানি দিয়ে মুসলিম সম্প্রদায় ঈদ উদযাপন করেছিল।

গরুকে কেন্দ্র করে বহু রাজনৈতিক ঘটনা ভারতবর্ষে ঘটেছে। গো-হত্যার বিরুদ্ধে গান্ধীর জীবনভর দৃঢ় অবস্থনের কথা আমরা জানি। এক্ষেত্রে আরএসএস এবং বিজেপির অবস্থান আর গান্ধীর অবস্থান প্রায় অভিন্ন। তার কিছু উদাহারণ স্মরণযোগ্য। (তথ্যসূত্র : সুনীতি কুমার ঘোষ রচিত বাংলা বিভাজনের অর্থনীতি-রাজনীতি)।

২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭ সালে গান্ধী তার হরিজন পত্রিকায় লিখেছেন, ‘এটি লেখা হচ্ছে বকর ঈদ দিবসে। এ দিবসটি মুসলমানের পক্ষে আনন্দের এবং হিন্দুদের পক্ষে শোকের। হিন্দুদের কাছে এ দিবসটি শোকের এ জন্য যে, তাদের মুসলমান ভাইয়েরা বলি দেওয়ার জন্য গো-হত্যা করেন, যদিও তারা জানেন যে গরু হিন্দুদের পূজ্য ও শ্রদ্ধার বস্তু।’

গান্ধী সারা ভারতের গো-রক্ষা সভার সভাপতি ছিলেন এবং ওই সভার নিয়মতন্ত্র নিজে রচনা করেছিলেন। ১৯২৪ সালের শেষে বেলগাঁও কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে তিনি সভাপতিত্ব করেন। সভাপতির ভাষণে গান্ধী বলেন, ‘স্বরাজের প্রশ্নের চেয়ে গো-রক্ষার প্রশ্নকে আমি কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না। বরং কয়েকদিক থেকে অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি’।

খিলাফত আন্দোলনের স্বীকৃতি প্রদান উপলক্ষ্যে গান্ধী বলেছিলেন, ‘এখন বোঝা যাবে কেন আমি নিজেকে সনাতনী হিন্দু হিসাবে গণ্য করি। গরুর প্রতি শ্রদ্ধায় আমি কারুর থেকে কম নই। খিলাফতের আদর্শকে আমার নিজের আদর্শ করেছি এই জন্য যে, একে রক্ষা করে গরুকে সম্পূর্ণ রক্ষা করা যাবে।’ গান্ধী আরও বলেছেন, ‘মৌলানা মহম্মদ আলীর কাছে খিলাফত হচ্ছে ধর্ম, আর খিলাফতের জন্য জীবনদান করে আমি মুসলমানের ছুরি থেকে গরুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাই। সেটাই আমার ধর্ম, তাই আমার দাবি, খিলাফত আমাদের দু’জনের কাছেই কেন্দ্রীয় বিষয়।’

স্বাধীন ভারতের প্রথম আইনমন্ত্রী এবং প্রধান সংবিধান প্রণেতা (কথিত নিম্নবর্ণের) ড. আম্বেদকর বলেছিলেন, ‘যদি জাত-বর্ণ থাকে তাহলে বর্ণ-বহির্ভূত জাতিও (outcaste) থাকবে। সমগ্র জাতপ্রথার অর্থাৎ বর্ণাশ্রম ধর্মের বিলুপ্তি না হলে এ সমস্যার সমাধান হবে না।’ গান্ধী কিন্তু বরাবরই ছিলেন বর্ণাশ্রম ধর্মের গোঁড়া সমর্থক। তিনি অস্পৃশ্যদের শূদ্র অথবা চতুর্থ বর্ণ হিসাবে গণ্য করার বিধান দিয়েছিলেন। গান্ধী আম্বেদকরের কথার প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, ‘মেথর মেথরই থাকবে, তবে তার ‘আদর্শ ভাঙ্গি’ (মেথর বা ঝাড়ুদার) তার পেশাকে পবিত্র কর্তব্যরূপে গ্রহণ করে মলমূত্র শুদ্ধভাবে পরিষ্কার করবে, টাকা-পয়সার আকাঙ্ক্ষা করবে না, মদ-মাংস ছোঁবেন না। যেসব অন্ত্যজ লেখাপড়া শিখেছেন তারাও পিতৃ-পিতামহের পেশা ত্যাগ করবেন না, তাকেই মহত্বদান করবেন’। গান্ধী বর্ণাশ্রমকে বিজ্ঞানভিত্তিক বলেছিলেন এবং এর মধ্যে সৌন্দর্যও আবিষ্কার করেছিলেন।

ভারতবর্ষের দুই প্রধান সম্প্রদায় হিন্দু-মুসলমানের সমস্যাকেও গান্ধী দেখেছেন একজন নিবেদিতপ্রাণ সনাতনী হিন্দু রূপেই, ভারতীয় জাতীয়তাবাদী রূপে নয়। ৫ ডিসেম্বর ১৯৪৬ সালে নোয়াখালিতে তিনি হিন্দু মহাসভার নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বলেছিলেন, ‘আমি হিন্দু হয়ে জন্মেছি, আমার মৃত্যুও হবে হিন্দু হিসাবে, একজন সনাতনী হিন্দু হিসাবে। আমি যদি মুক্তি লাভ করি তো হিন্দু হিসাবেই করব।’ এর আগে আরও বলেছিলেন, ‘আমার দেশের থেকেও আমার ধর্মকে আমি বেশি ভালবাসি, তাই আমি প্রথমে হিন্দু, পরে জাতীয়তাবাদী।’

গান্ধীজি ১৯২৬ সালের এপ্রিলে পুঁজিপতি এবং হিন্দু মৌলবাদী রাজনীতির প্রবাদতুল্য ঘনশ্যামদাস বিড়লাকে লিখেছিলেন, ‘...কলকাতার দাঙ্গায় আমি বিচলিত হইনি। আমি আগেই বলেছি হিন্দুরা যদি লড়াই করতে চায় তাহলে আমাদের উচিত হবে তাকে নিষ্ঠুরতার লক্ষণ মনে করে দোষ না দিয়ে গুণ হিসাবে গণ্য করা এবং তার আরও বিস্তার লাভে সাহায্য করা।’

(তথ্যসূত্র : শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, দাঙ্গার ইতিহাস।)

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম