Logo
Logo
×

যুগান্তরের বিশেষ আয়োজন

মওলানা ভাসানীর ঈদ: সমাজ, সংগ্রাম ও আধ্যাত্মিকতার অনন্য সমন্বয়

Icon

আজাদ খান ভাসানী

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ঈদ উদযাপন ছিল বাংলার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা। তার ঈদে ইসলামের চিরায়ত সৌন্দর্য, সংগ্রামী জীবনাদর্শ এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের দর্শন একাকার হয়ে উঠত। পশুপ্রেম থেকে শুরু করে সুদখোর মহাজনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ-সবই যুক্ত ছিল তার ঈদের ইতিহাসে।

১৯৭৬ সালে সাপ্তাহিক হক কথা পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঈদের দিন ফজরের নামাজ শেষে মওলানা ভাসানীর প্রথম কাজ ছিল বাড়ির গাভিগুলোর যত্ন নেওয়া। তিনি বিশ্বাস করতেন, ঈদের আনন্দে পশুদেরও অংশীদার করা উচিত। তাই গাভিগুলোকে গোসল করিয়ে তাজা কলাই ঘাস খাওয়ানো হতো। একবার তিনি কৃষকের কাছ থেকে গোটা কাঁচা কলাইয়ের খেত কিনে রেখেছিলেন। কিন্তু ঈদের আগে সেগুলো গাভিকে দেননি, বিশেষ দিনের জন্য সেগুলো সংরক্ষণ করেছিলেন। এগুলো দেখে একজন মুরিদ মজা করে বলেছিলেন, ‘হুজুরের পালের গরু হয়ে জন্ম নেওয়াও ভাগ্যের কথা!’

ঈদের সকালে মওলানা ভাসানীর প্রস্তুতিতে দেখা যেত এক অনন্য আত্মিক ও লৌকিক সমন্বয়। গাভিদের দেখাশোনা শেষে তিনি নিজে পরিবার-পরিজনসহ গোসল করতেন। বছরে শুধু দুই ঈদেই তিনি ঘটা করে গায়ে সাবান দিতেন। মুরিদদের দেওয়া নতুন লুঙ্গি, পুরোনো গেঞ্জি-পাঞ্জাবির ভাঁজে লুকিয়ে থাকা স্মৃতি, আর কালি মাখা চটি জুতায় ফুটে উঠত তার নিরাভরণ ব্যক্তিত্ব। মাথায় সুগন্ধি তেল, দাড়িতে চিরুনির আঁচড়, চোখে পানেরো বটা দিয়ে কৌশলে লাগানো সুরমা-প্রতিটি কাজে ছিল এক নিবিড় যত্ন। পাঞ্জাবিতে ভাতের মাড় দেওয়া হতো, ইস্ত্রির বদলে বালিশের নিচে ভাঁজ করে রাখা হতো কাপড়, আর কালি লাগানো চটি জুতাগুলো পরতেন গোসলের পর মুহূর্তে। তার এ সাধারণ প্রস্তুতির মধ্যেই ধরা পড়ত ঈদের তাৎপর্য-ভোগবিলাস নয়, বরং সহজ-সত্যই যার সমাধান।

মওলানা ভাসানীর ঈদ কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়, সামাজিক সংগ্রামেরও প্রতীক ছিল। তিনি কিশোরগঞ্জে সুদখোর মহাজনদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের স্মৃতিচারণা করে বলতেন, খেলাফত আন্দোলনের আগে তিনি ও তার সহযোগীরা স্থানীয় কৃষক-মজুরদের সংঘটিত করে বিদ্রোহের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু জমিদার ও মহাজনদের শক্তির কারণে সফল হতে পারেননি। মহাজনরা সুদের কাগজপত্র লাহিড়ী বাড়িতে (একটি পাড়ার মতো) জমা রেখেছিল। ফলে তারা বিকল্প কৌশল নেন। শোলাকিয়া ময়দানে ঈদের নামাজ আদায়ের পর এক রাতে ভাসানী ও তার সঙ্গীরা লাহিড়ী বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেন। এর মাধ্যমে কৃষকদের সুদের ঋণমুক্তির পথ প্রশস্ত হয়। এ ঘটনায় শত শত কৃষক পরিবারে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।

১৯৩০ সালের ঈদুল ফিতরের দিনে টাঙ্গাইল শহরের ঈদগাহ ময়দানে মওলানা ভাসানীর ইমামতিতে প্রথম ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। ভাসানী ইমামতি করবেন। এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে শহর ছাড়িয়ে গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে বাঁধভাঙা স্রোতের মতো মুসল্লিরা ময়দানে জমায়েত হতে শুরু করেন। ঈদের জামাত শেষে তিনি এক সমাবেশ করেন। সমাবেশে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কৃষক-খেতমজুররা সমবেত হয়েছিলেন। এতে হিন্দুদের জন্য চিড়া-দই ও মুসলমানদের জন্য খিচুড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এ সময় স্থানীয় জমিদার ও প্রশাসনের চোখে ধুলা দিয়ে মওলানা ভাসানী কৃষকদের জমিদারদের বিরুদ্ধে সংগঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

১৯৬৬ সালের ঈদুল আজহার ভাষণে মওলানা ভাসানী কুরবানির গভীর আধ্যাত্মিক তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে বলেন, প্রকৃত কুরবানি হলো পশু জবাইয়ের পাশাপাশি নিজের আমিত্ব, হিংসা, লোভ ও কুপ্রবৃত্তি ত্যাগ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। তার মতে, ঈদের প্রকৃত শিক্ষা হলো মানবতার ঐক্য, আত্মনিবেদন ও আল্লাহর প্রেমে আত্মশুদ্ধি। তিনি জোর দিয়ে বলেন, আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য মানুষের সেবা করা অপরিহার্য-ক্ষুধার্তকে খাওয়ানো, অসুস্থের সেবা করা ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে। ভাসানীর মতে, আত্মকেন্দ্রিকতা ত্যাগ করে সৃষ্টির সেবায় আত্মনিয়োগ করাই আল্লাহ ও সৃষ্টির রহস্য বোঝার পথ। এ ভাষণে তিনি কুরবানিকে শান্তি, সম্প্রীতি ও আধ্যাত্মিক ত্যাগের প্রতীক হিসাবে উপস্থাপন করেন, যা আজও প্রাসঙ্গিক।

১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ঈদুল আজহা উদযাপিত হয়। মওলানা ভাসানী সম্প্র্রতি ভারত থেকে ফিরে এসেছিলেন এবং তীব্র দারিদ্র্যের মধ্যে ঈদ পালন করেন। তার মুরিদদের মতো তারও কোনো সম্পদ অবশিষ্ট ছিল না-খাবারের বাসন, হারিকেন, বিছানা বা চৌকি পর্যন্ত ছিল না। খড় ও কাঁথার ওপরই তিনি পরিবারসহ রাত কাটাতেন। টাঙ্গাইলের সিভিল সার্জনের উদ্যোগে পরে একটি চৌকির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এ ঈদুল আজহা ছিল অভাব ও অনাড়ম্বরতার মধ্য দিয়ে অত্যন্ত সহজ-সরলভাবে উদযাপিত।

ফলত, মওলানা ভাসানীর ঈদ ছিল ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা, সামাজিক ন্যায়বিচার, প্রকৃতি-প্রেম ও আধ্যাত্মিকতার এক অনন্য সমন্বয়। তার জীবনাদর্শে ঈদ শুধু উৎসব নয়, বরং সংগ্রাম, ত্যাগ ও মানবতার প্রতীক। আজও তার ঈদের শিক্ষা আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক সংগ্রামে প্রেরণা জোগায়।

লেখক : সদস্য সচিব, ভাসানী পরিষদ ও কেন্দ্রীয় সংগঠক, জাতীয় নাগরিক পার্টি

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম