বাংলা সাহিত্যে ঈদুল আজহা

ড. নূর-ই আলম সিদ্দিকী
প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফলো করুন |
|
---|---|
মুসলিম সমাজে ঈদ উৎসব দুটি-ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। ইসলামি অনুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ঈদ মুসলিম উম্মাহকে ত্যাগে, মানবতায় ও মনুষ্যত্বে জাগ্রত হওয়ার ঐশ্বরিক প্রেরণায় উদ্দীপিত করে। মহান আল্লাহ প্রিয় বান্দাকে তার মহিমার পবিত্র প্রভায় রাঙিয়ে নিতেই এ উৎসব প্রবর্তিত করেছেন। ঈদুল আজহা মূলত আরবি বাক্য অংশ। অর্থ ত্যাগের উৎসব। এ উৎসবের মূল প্রতিপাদ্য হলো ত্যাগ করা। প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর রাহে কুরবান করার এ দীক্ষা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর মাধ্যমে দুনিয়ায় প্রচলিত হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশীয় উৎসব থেকে ঈদ উৎসব ব্যতিক্রম তার আধ্যাত্ম-চেতনার প্রগাঢ় সমর্পণে। নিজেকে মহিমান্বিত করার ব্যাকুল বাসনায় চিন্তাশীল মানুষ তাই সৃষ্টির প্রবাহে সদা থাকেন উদ্বেল।
ঈদকে কেন্দ্র করে কবি-সাহিত্যিকরা বাংলা সাহিত্য ভুবনকে করেছেন সৃষ্টির আলোয় প্লাবিত। ইতিহাসের খেরো পাতায় চোখ দিলে বাংলা সাহিত্যের আদি যুগে এ সম্পর্কে কোনো তথ্য মেলে না। কিন্তু মধ্যযুগে ঈদুল আজহার উপস্থিতি মিলে। সে যুগে কুরবানি উৎসব সরাসরি কাব্যের বিষয়বস্তু হিসাবে উত্থাপিত হয়নি, কাহিনি প্রস্বরিত হয়েছে ত্যাগের চেতনায়। পনের শতকের কবি সৈয়দ সুলতান (১৫৫০-১৬৪৮) রচিত ‘নবীবংশ’ কাব্যটি ঈদ সম্পর্কিত প্রথম রচনা। এ কাব্য কাহিনিতে হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তার পুত্র ইসমাইল (আ.)-এর ত্যাগ রেখায়িত হয়েছে। কাহিনির ভেতর ঈদুল আজহার পটভূমির প্রেক্ষাপটে কুরবানি প্রথার উৎপত্তি বর্ণিত হয়েছে। এ ছাড়া কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তার চন্ডীমঙ্গল কাব্যে ঈদুল আজহার ধারণা পরোক্ষভাবে চিত্রিত করেছেন।
ঊনবিংশ শতাব্দী ছিল ইংরেজ শাসনের প্রতাপ কাল। ভেদ-নীতির কৌশলে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের সম্পর্ক ছিল দা-কুমড়া। ফলে সামান্য অজুহাতে বঙ্গ অঞ্চলের মানুষ কুরবানির পশু জবাইকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে থাকে। সামাজিক বিরোধ চরম আকার নিলে হিন্দু সমাজ গো রক্ষায় মরিয়া হয়ে ওঠে। হিন্দুদের বিরোধিতার মুখে মুসলমানদের কুরবানি পালনে প্রতিকূল প্রতিবেশ সৃষ্টি হয়। সামাজিক এ অবক্ষয়ের ওপর ১৮৮৯ সালে বাঙালি মুসলিম সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেন ‘গো জীবন’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। প্রবন্ধে লেখক গো হত্যার বিপক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি সম্মান জানিয়ে তার যুক্তি তুলে ধরেন। গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ধর্মীয় রীতিনীতি প্রতি পালনের বাধার আশঙ্কা থেকে এ লেখার প্রতিক্রিয়ায় একই বছরে রচিত হয় ‘গো কাণ্ড’ বা ‘গো জীবন’ রচনা। গ্রন্থটি লেখেন মৌলভী নঈম উদ্দিন (১৮৩২-১৯০৭)।
বিষয়টির নেতিবাচকতা আদালত পর্যন্ত গড়ালে মুসলিম স্কলারদের মধ্যে ব্যাপক বোঝাপড়া শুরু হয়। ১৮৯০ সালে রিয়াজ উদ্দিন আহমদ মাশহাদী (১৮৫২-১৯১৮) ‘অগ্নিকুক্কুট’ নামক একটি প্রবন্ধ পুস্তিকা রচনা করেন। এ গ্রন্থে তিনি যৌক্তিক, বৈজ্ঞানিক ও ধর্মীয় দলিলসহ গরু কুরবানির পক্ষে বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করেন। সমসাময়িক ‘সুধাকর’ পত্রিকায় এ লেখার তাৎপর্যের ওপর একটি ইতিবাচক রিভিউ প্রকাশিত হয়। বাস্তবতা হচ্ছে, কুরবানির পক্ষ-বিপক্ষের মনোভাব প্রসারিত করতে সে সময়ে রচিত এ সাহিত্যকর্মগুলো ধর্মীয় অধিকার রক্ষার দলিল হয়ে ওঠে। বিশ শতক থেকে মূলত ঈদ উৎসবকেন্দ্রিক যথার্থ সাহিত্যচর্চার উন্মেষ ঘটে। এ শতকের প্রথম দশকে বাঙালি মুসলমানদের নিজস্ব উৎসবভিত্তিক সংস্কৃত সাহিত্য রচনার প্রবণতা বেশ গতিশীল হয়ে ওঠে।
১৯০০ সালের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরী (১৮৬৩-১৯২৯) ‘ঈদুল আযহা’ নামক একটি স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থে লেখক নিজে এলাকায় ঈদে জামাতে ইমামতি করছেন এবং জানা যায়, ঈদের আগে পশু কিনে যত্ন করা হতো, কুরবানির দিন ঈদের নামাজের পর সবাই আহার করতেন। এ দৃশ্যটির প্রামাণ্য ছবি আমরা শহীদ জননী জাহানারা ইমামে’র ‘স্মৃতিকথামূলক’ রচনা ‘অন্য জীবন’ গ্রন্থে পাই। তিনি উল্লেখ করেন-‘বকরি ঈদে সকালে কোরবানী না হওয়া পর্যন্ত কেউ কিছু মুখে দিতেন না। পুরুষেরা গোছল সেরে নতুন কাপড় পড়ে নামাজ পড়তে যেতেন খালি পেটেই। ফিরে এসে একেবারে কোরবানী দিয়ে তারপর বাড়িতে ঢুকতেন।’ এসব বিশ্লেষণে অনুমান করতে কষ্ট হয় না, বিশ শতক থেকে ঈদুল আজহার পরিবেশে ধর্মীয় আচারনির্ভরতা আনুষ্ঠানিক রূপ পায়। এখানে উল্লেখ্য ঊনবিংশ শতকের শেষ প্রান্তে গরুকেন্দ্রিক দ্বন্দ্বের মর্মস্পর্শী সাহিত্যিক রূপায়ণ শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয় ‘মহেশ’ (১৩২৯) নামক ছোট গল্পটি। গল্পে সরাসরি ঈদ উদযাপনের কথা নেই। কিন্তু এর প্রেক্ষাপট ও দ্বন্দ্ব কুরবানির পশু ও হিন্দু-মুসলিম সামাজিক সম্পর্ক। বাংলা সাহিত্যে ত্যাগের মর্ম ও সাম্প্রদায়িক সংকটের প্রতীকী উপস্থাপনায় ‘মহেশ’ গল্পটি অনন্য মাত্রা পেয়েছে।
বাংলা সাহিত্যে ঈদ উৎসবকেন্দ্রিক সাহিত্যধারা ঠিক এ লগ্ন থেকেই আনুষ্ঠানিক পরিণতি পায়। ঈদকে নিয়ে সর্বপ্রথম কবিতা রচনা করেন কবি সৈয়দ এমদাদ আলী (১৮৮০-১৯৫৬)। ১৯০০ সালে ঢাকায় প্রকাশিত ‘নবনূর’ পত্রিকায় তার ‘ঈদ’ নামক কবিতাটি প্রকাশিত হয়। ঈদ সকালের সূর্যোদয়ের সুন্দর বর্ণনা এবং মুসলিম জাহানের একতার আহ্বান ছিল কবিতায়। ‘কুহেলি তিমির সরায়ে দূরে, তরুণ অরুণ উঠেছে ধীরে।’ ‘নবনুরে’র পৌষ (১৩১১) সংখ্যায় প্রকাশিত হয় কবি কায়কোবাদে’র ‘ঈদ’ ও ‘ঈদ আবাহন’ নামক দুটি কবিতা। তিনি লেখেন-‘এই ঈদে বিধাতার কি যে শুভ উদ্দেশ্য মহান, হয় সিদ্ধ, বোঝে না তা স্বার্থপর সন্তান।’ পত্রিকাটির ফাল্গুন সংখ্যায় (১৩১১) ঐতিহাসিক রামপ্রান গুপ্ত লেখেন ‘ঈদুজ্জোহা’ প্রবন্ধ। ‘ঈদ সম্মিলন’ নামক কবিতা লেখেন জীবেন্দু কুমার দত্ত।
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২) লেখেন ‘ঈদ সম্মিলন’ (১৯০৪) নামক প্রবন্ধ। প্রবন্ধে তিনি মুসলমানের ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের ওপর জোর দেন। তিনি লেখেন-‘ঈদ সমাগমে আজি আমাদের সে দুঃখ যামিনীর অবসান হউক।...সমষ্টির মঙ্গলের জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থ পদদলিত হউক।’ কবি মোজাম্মেল হক (১৮৬০-১৯৩৩) ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় ১৩২৭ সালে ‘ঈদ’ কবিতায় উল্লেখ করেন-‘আজ মিলনের দিন, গলায় গলায় মাখামাখি, আমির ফকির হীন।’ কবি শেখ ফজলুল করিম ‘বাসনা’ পত্রিকায় তার প্রকাশিত ‘ঈদ’ (১৯০৮) কবিতায় লেখেন-‘অলস অধম মোরা এখনো অবহেলে, যাবো রসাতলে।’ অন্যদিকে কবি গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪) ‘সওগাত’ পত্রিকায় ১৩২৬ সালে কাহিনি ধর্মী ঈদ উৎসব কবিতা লেখেন। কবিতায় প্রত্যাশা করে বলেন-‘এই ঈদ হোক আজি সফল ধন্য, নিখিল মানবের জন্য।’
ঠিক ওই সময় মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী তার ‘ঈদুল আযহা’ প্রবন্ধে কুরবানির গুরুত্ব তুলে ধরেন। তৎকালীন সব লেখকের লেখার প্রতিপাদ্য ছিল কুরবানির ঈদের মাধ্যমে মুসলিম ঐক্য, ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহানুভূতির প্রচার করা। সব সাহিত্যিকের চেষ্টায় বিশ শতকের প্রথম দিকে ঈদুল আজহা বাংলা সাহিত্যে আনন্দ ও ঐক্যের উৎসব হিসাবে স্থান করে নেয়। ঈদ উদযাপনের আনুক্রমিক ধারায় কাজী নজরুল ইসলামে’র অবদান সবচেয়ে বেশি বৈচিত্র্যময় ও তাৎপর্যপূর্ণ। দুই ঈদ নিয়েই তার সৃষ্টিশীলতা প্রবহমান ছিল।
তবে কুরবানির ঈদকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে তিনি উৎসবটির দর্শনকে সামাজিক সাম্যের বার্তায় রূপান্তরিত করেছেন। ঈদু আজহাকে নিয়ে নজরুলের জনপ্রিয় ঈদ গান-‘ঈদুজ্জোহার চাঁদ এলো ঐ, এলো আবার দুসরা ঈদ’ খুবই প্রাসঙ্গিক ও উদ্দীপনাময়। গানটির পরের অন্তরাতে তিনি আল্লাহর নির্দেশ মতো প্রিয়বস্তু কুরবানির ওপর জোর দিয়ে বলেছেন- ‘কোরবানী দে, কোরবানী দে, শোন খোদার ফরমান তাগিদ।’
নজরুল সাম্যের কবি কুরবানি ঈদ সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি শুধু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ ছিল না। সামাজিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেও তা ছিল বিস্তৃত ও প্রসারিত। ১৯২৭ সালে কবি নজরুলই প্রথম উচ্চারণ করেন-‘আমি মনে করি বিশ্ব-কাব্যলক্ষ্মীর একটি মুসলমানি ঢঙ আছে।’ এই ‘মুসলমানি ঢঙে’ রবীন্দ্র যুগে নজরুলই একমাত্র জোয়ার এনেছিলেন। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্তি পেতে নজরুল কুরবানির চেতনাকে রাজনৈতিক রূপক হিসাবে ব্যবহার করেছেন। লড়াইকে তিনি কুরবানির প্রকৃত তাৎপর্য বলে মনে করতেন। কুরবানির ত্যাগের গুরুত্ব প্রসঙ্গে তিনি লেখেন-‘পশু কোরবানী দেস তখন, আজাদ মুক্ত হবি যখন। জুলুম মুক্ত হবে রে দ্বীন, জালিমের যেন রাখে না চিন।’ ১৯২০ সালে নজরুল রচনা করেন তার বিখ্যাত ‘কোরবানী’ কবিতাটি। জনৈক তরিকুল নামের এক ম্যাজিস্ট্রেটের প্রবন্ধের জবাবে তিনি গর্জে উঠে লিখেন-‘ওরে হত্যা নয়, আজ সত্যগ্রহ শক্তির উদ্বোধন, দুর্বল! ভীরু! চুপ রহো, ওহো খামখ্যা ক্ষুব্ধ মন।’ ঈদুল আজহা নিয়ে লেখা কবিতায় অনাচারের পাশাপাশি জাতীয় চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন কবি নজরুল- ‘শহীদান’দের ঈদ এলো বকরীদ, অন্তরে চির নওজোয়ান যে তার তরে এই ঈদ।’
শুদ্ধ হওয়ার সাধনা করলে নবী-রাসূলদের শেখানো রাস্তায় সত্যিকার কুরবানি দেওয়া হয়। নজরুল সে কথাই বলেছেন কাব্যিক ছন্দে-‘ইব্রাহিমের কাহিনী শুনেছ? ইসমাইলের ত্যাগ? আল্লারে পাবে মনে কর কোরবানী দিয়ে গরু-ছাগ? আল্লাহর নামে, ধর্মের নামে, মানবজাতির লাগি, পুত্রেরে কোরবানী দিতে পারে, আছে কেউ হেন ত্যাগী। সেই মুসলিম থাকে যদি কেউ, তসলিম কর তারে, ঈদগাহে গিয়া তারি সার্থক হয় ডাকা আল্লারে, অন্তরে ভোগী বাইরে সে যোগী, মুসলমান সে নয়, চোগা চাপকানে ঢাকা পড়িবে না সত্য সে পরিচয়।’ মুসলিমের দায়িত্ববিদ্বেষ মুক্ত পৃথিবী গড়া মুসলমান জাতি আত্মপূজা ও স্বার্থপরতা না ছাড়লে পৃথিবীতে ন্যায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠা হবে না। স্বার্থপরের জন্য জান্নাত হারাম, নজরুল তার কবিতায় বলেন- ‘শুধু আপনারে বাঁচায় যে, মুসলিম নহে সে, ইসলাম বলে বাঁচ সবাই, দাও কোরবানি জান ও মাল, বেহেশত তোমার কর হালাল।’
নজরুলের সাহিত্যে ‘ঈদ ও কোরবানী’ অনন্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে উপস্থিত। ধর্মীয় উৎসবের আনন্দ, আত্মত্যাগ ও শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী নজরুলের ঈদপর্বের লেখাগুলো সতত প্রবহমান। নজরুল পরবর্তী কবি-সাহিত্যিকরাও তার দেখানো পথে ঈদের মধ্যে সাম্য ও মানবতার বার্তা হদিস করে ফেরেন অনুক্ষণ। কবি ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪) ঈদকে লক্ষ্য করে লিখেছেন-‘আজকে এল খুশির দিন, দেখনা চেয়ে খুশির চিন।’ কবি তালিম হোসেন তার কবিতায় ঈদ নিয়ে বলেন-‘ঈদ মোবারক সালাম বন্ধু, আজিকে এই খুশরোজ, দাওয়াত কবুল কর মানুষের বেদনার মহাভোজ।’ কবি আল মাহমুদ ঈদকে বাংলা কবিতায় এক অনন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছেন। জীবনের অন্তিম লগ্নকে তিনি তার কবিতায় আনন্দ-বেদনার এক গভীর ব্যাকুল মন্থন পাথারে প্রক্ষেপণ করেছেন। পিয়াসী চিত্তে বেদনার বিউগল বাজিয়ে তাই তিনি বিনম্র স্বরে নিজকে ত্যাগের কামনায় সৃষ্টির সরোবরে ছলছলিয়ে বলে ওঠেন-‘কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রি শেষে শুভ শুক্রবারে, মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাগিদ, ...ভালো মন্দ যা ঘটুক মেনো নেব এ আমার ঈদ।’ আবুল মনসুর আহমদ এর ‘নায়েবে নবী’ গল্প এবং মাহবুব উল আলম চৌধুরী ‘স্মৃতির সন্ধানে’ গ্রন্থে কুরবানি ঈদের কথা পাওয়া যায়।
একুশ শতকের বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি সাময়িকী ও বিশেষ সংখ্যাগুলো ঈদবিষয়ক নানা গল্প, কবিতা ও উপন্যাস প্রকাশ করছেন। বর্তমান যুগের লেখকরা শহরের কর্মব্যস্ত মানুষের ঈদ যাত্রা, গ্রামে ফেরা, পরিবারের পুনর্মিলন এবং ঈদকে ঘিরে সংস্কৃতির পরিবর্তনকে বিষয়বস্তু হিসাবে তাদের লেখায় স্থান দিচ্ছেন। তবে লেখার উপকরণে যাই থাক, এটি শাশ্বত যে, সব যুগের সাহিত্যের মধ্যে ঈদের একটি মৌলিক সত্য প্রতিফলিত হয়েছে। কুরবানির ঈদ মানে কেবল পশু জবাই বা উৎসবের আনন্দ নয়, বরং এর গভীরে রয়েছে আত্মত্যাগের চেতনা এবং মানবিক মূল্যবোধের পরীক্ষা। সাহিত্যিকরা বারবার তাদের সৃষ্টিকর্মে মধ্যে স্মরণ করিয়ে দেন যে, সত্যিকারের ত্যাগ হলো ভেতরের পশুকে জবাই করে মানবিক মহত্ত্ব অর্জন।
বাংলা সাহিত্য মধ্য যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত কুরবানির ঈদকে নানা আঙ্গিকে ধারণ ও চিত্রায়ণ করেছে। প্রাচীন ধর্মীয় কাব্যে ইব্রাহিম-ইসমাইলের আত্মত্যাগ থেকে শুরু করে, ঊনবিংশ শতকের উপনিবেশকালীন সংঘাত এবং বিশ শতকের জাতীয়তাবাদী ও সামাজিক চেতনার সর্বত্র ঈদুল আজহা এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক উপাদান হিসাবে উপস্থিত থেকেছে। এই উৎসবের মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতি যেমন ব্যক্ত হয়েছে, তেমনি ব্যক্ত হয়েছে সামাজিক অসাম্য দূর করার আহ্বান ও মানবতার কল্যাণ কামনা। নজরুল ইসলামের ভাষায় বললে-‘কোরবানীর প্রকৃত সার্থকতা অর্জিত হবে তখনই যখন ঈদের ত্যাগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে শোষণমুক্ত ন্যায়পরায়ন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা যাবে।’ বাংলা সাহিত্যে কুরবানির ঈদের এই সর্বমুখী পর্যালোচনা প্রমাণ করে, ঈদ কেবল ধর্মীয় আচার নয়, বরং বাঙালির সামাজিক সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত একটি অনুপ্রেরণার উৎস। যাকে সাহিত্যিকরা সুজনশীলতার মাধ্যমে যুগে থেকে যুগান্তরে মানুষকে আলোকিত পথের, পথিক হয়ে মহাসত্যের মোহনায় মিলিত হওয়ার প্রেরণা দিয়েছেন বারংবার।
লেখক : গবেষক