Logo
Logo
×

যুগান্তরের বিশেষ আয়োজন

কুরবানির সাংস্কৃতিক পরিচর্যা

Icon

ড. মাহবুব হাসান

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কুরবানি হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পশু জবেহ করা। যাকে আমরা বলছি ত্যাগ করা। আসলে কী ত্যাগ করছি তা সম্যক উপলব্ধি করতে আমরা ব্যর্থ। আল্লাহর সন্তুষ্টির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আত্মত্যাগের একটি প্রতীকী উৎসর্গ। নিজের মনের ভেতরে যে পাপ, মানবিকতা, অসংগতি, মিথ্যাচার, মানব সমাজের জন্য যা খারাপ দৃষ্টান্ত, তাকে চিরতরে বাতিল করাই হচ্ছে কুরবানি।

কিন্তু আমাদের সমাজে এ আত্মত্যাগ, আত্ম-বলিদানের এই প্রতীকী উৎসর্গ ভিন্নমাত্রা, ভিন্ন সাংস্কৃতিক চেতনার আধারে উৎসবে পরিণত হয়েছে। জিলহজ মাসের ১০, ১১, ১২ তারিখে ইসলামি বিধান অনুযায়ী পশু জবেহ করার যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, তা প্রকৃত অর্থে আত্মবলিদানের প্রতীকের মধ্যে নেই। আমাদের মনে আছে গত বছরের এক ছাগলকাণ্ডের কথা। যার সূত্র ধরে বেরিয়ে এসেছিল সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, দুরাচারিতা ও লোভের রাজনৈতিক ইতিহাস। প্রাথমিকভাবে আইনের শাসনের চোখকে ফাঁকি দেওয়া গেলেও আখেরে যে ধরা পড়তেই হয়, সেই ইতিহাস আমাদের শেখাল যে মানব সমাজে প্রচলিত কল্যাণকর আইনের চোখ ফাঁকি দেওয়া যায় না।

এটা হচ্ছে একটি দিকে। অন্যদিকটি হলো মহান রাব্বুল আলামিনের চোখকে আমরা কীভাবে ফাঁকি দেব? তিনি যে সর্বত্র বিরাজমান, তিনি যে প্রতি মুহূর্তে আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক ও আত্ম প্রবঞ্চনাময় কাণ্ডগুলো দেখছেন, সেই সত্য আমরা মনে রাখি না। মনে করি না যে, আমাদের একদিন ফিরে যেতে হবে তার কাছে, সেই চিরভাস্বর জগতে, যাকে আমরা বলি আল্লাহর সাম্রাজ্যে, তার আরশের ছায়াতলে। সেখানে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে তার কাছে। এ পৃথিবী পরিসরে কি করেছি মাবুদের কাছে সেই সত্য স্বীকার করতে হবে, এর কোনো ব্যতিক্রম নেই। আজ আমরা মনে করি ভিন্ন জায়গা বা প্লানেট থেকে এসেছি এ পৃথিবী নামক কারাগারে ।

২.

কুরবানির সাংস্কৃতিক রূপায়ণ আমাদের আচরণের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অমানবিকতার, নিষ্ঠুরতার একটি বাস্তব জবাবদিহিতা, প্রতীকী আয়োজনে। এমনকি এ পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে পশু জবেহ করার রীতির মাধ্যমে তার একটি পথ খুলে দিয়েছেন রাব্বুল আলামিন। ক্ষমার প্রতীক মাবুদকে এটাই বলা যে, গত এক বছরে আমরা যে অপরাধ, অপকর্ম ও অন্যায় করেছি, যে পাপাচারে নিমজ্জিত হয়েছি, তাকে বলি দিয়ে নিজেকে আবারো পরিচ্ছন্ন করে নেওয়ার আয়োজনই হচ্ছে কুরবান। ‘ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!/ দুর্বল! ভীরু! চুপ রহো, ওহো খামকা ক্ষুব্ধ মন।’ নজরুলের এই পঙ্ক্তি, কোরবানী কবিতার এই লাইন বলে দিচ্ছে যে ভীরু, দুর্বল হলে চলবে না।

কুরবানি হচ্ছে সত্যকে গ্রহণ করার সাংস্কৃতিক পরিচর্যা। এ সাংস্কৃতিক ধারার চেতনাই আমাদের পূত-পবিত্র করার উপায় ও পথ। আমরা যে এ প্লানেটের প্রাণী নই, আমাদের যে সেই মাবুদের নিজস্ব নিখিল থেকে নিক্ষেপ করা হয়েছিল পরম্পরাসহ, আমাদের মানবিক ও মানসিক বিকাশের পথ তৈরি করা হয়েছিল জগতের মালিকের সেবা ও উপাসনা করার জন্য, তার সন্তুষ্টির জন্য, তার নৈকট্য লাভের জন্য, তার ক্ষমা পাওয়ার জন্য যে আমরা প্রাণান্তকর, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, রোজা, হজ পালন, জাকাত প্রদান করে সমতা-অর্জনের য়ে ব্যবস্থা, তা মূলত এ-সবের বহিরাবরণ। এর অন্তরে আছে রবের সুকীর্তি ও সুনামের অন্তর্গত সত্যকে আবাহন, সেই সত্যে অবগাহন ও স্বীকৃতিদানের ভেতর দিয়ে এটাই প্রমাণ করা যে আমরা উৎসর্গিতপ্রাণ। ওই উৎসর্গ আল্লাহর প্রতি আমাদের নতশির করেছে। তার চিরভাস্বর সম্মান ও স্বীকৃতিস্বরূপ, পশু বলিদান তার বাহ্যিক আয়োজনমাত্র।

এটা মনে হতে পারে, আমরা যেন পশু জবেহ করে নিজেদের পেটের ক্ষুধা নিবারণের উদ্দেশ্য সাধন করছি। সাদা চোখে ভাবলে এমনটাই হতে পারে। কিন্তু মর্মে আমাদের রয়েছে সেই আকুল আবেদন, যা মহান রব আমাদের শিখিয়েছেন। আমরা পড়ে বিস্মিত কাজী নজরুল ইসলামের কোরবানী কবিতায় মর্মমূলে ওই সৌন্দর্যই বিকশিত হয়েছে দুধারী বক্তব্য নিয়ে। তিনি যে তার সময়-কাল ডিঙিয়ে উত্তর-আধুনিক যুগের সূচনাকারী, তা প্রমাণ করে তারে ঐতিহ্যপ্রবণা এবং তাকে নবায়ন করে তোলার ভেতরে। যা তাকে ভিন্নমাত্রার এক কবি হিসাবে চিহ্নিত ও চিত্রিত করেছে।

লোকধর্মে সেই সমাজের কেবল কাঠামোই দেখা যায় না, তার অন্তর্গত আকাঙ্ক্ষার রূপও আমরা উপলব্ধি করতে পারি। একশ বছর আগে নজরুল যে সত্য উচ্চারণ করেছেন তার কোরবানী কবিতায়, তার নবযুগ হচ্ছে নবায়ন করে তোলার কলাকৌশল। নজরুল কেন অগ্রগামী চিন্তক, কেন তিনি আধুনিককালের মানুষ ও পরাধীন ভারতের নাগরিক হয়েও সত্য অন্বেষণ ও সত্য গ্রহণের দ্বিধারী চেতনার স্বরূপ প্রকাশ করেছেন এ কবিতায়, সেই ব্যাখ্যা প্রয়োজন। তিনি কীভাবে তা করেছেন?

আজ শোর ওঠে জোর ‘খুন দে, জান দে, শির দে বত্স’ শোন্!

এ শব্দগুলো এই কবিতার দ্বিধারী অর্থ বহন করছে। শব্দগুলো একদিকে কুরবানির মর্মচেতনার রূপ প্রকাশ করেছে, অন্যদিকে তার প্রতিবাদ-প্রতিরোধের আহ্বানও আমাদের বুঝিয়ে দেয় যে, তিনি কি বলেছেন। ঔপনিবেশিক শাসক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে ওই আহ্বান তার। ‘খুন দে, জান দে, শির দে, বৎস-শব্দগুলো তো পরাধীন মানুষের উদ্দেশ্যেই বলা। ওই কথা তো পশুর উদ্দেশে নয়। এটা আরও পরিষ্কার করেছে ‘বৎস’ শব্দটি। পশুকে কেউ বৎস বলে না, বলবে না। বৎস মানুষেরই সম্বোধন। ঠিক একই উদ্দেশে তিনি কুরবানিকে বলছেন শক্তির উদ্বোধন। কোন সে শক্তি? তার সেই শক্তির প্রয়োজনের কথা আমরা শুনতে পেয়েছি বিদ্রোহীতে, সাম্যবাদীর কবিতাগুলোয়। তার সৃষ্টিশীল চিন্তার ভেতরে লুকিয়ে আছে স্বাধীনতা লাভে শক্তি ও সামর্থ্যরে উদ্বোধনের কথা। সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে লড়তে হলে অস্ত্র ও সাহস বা শক্তি অর্জন করার অন্য কোনো বিকল্প নেই।

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!

চ’ড়েছে খুন আজ খুনিয়ারার

মুস্লিমে সারা দুনিয়াটার!

‘জুল্ ফেকার’ খুল্ বে তার

দু’ধারী ধার শেরে-খোদার, রক্তে-পূত-বদন!

খুনে আজকের রুধ্ বো মন!

ওরে শক্তি-হস্তে মুক্তি, শক্তি রক্তে সুপ্ত শোন্!

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!

কুরবানি কবিতার এই পঙ্ক্তিগুলো কি আত্মবলিদানের বস্তুববাদী চিন্তার ফসল নয়? রিচুয়ালের ভেতরেও যে স্বাধীনতার জন্য রক্তদানের আহ্বান থাকতে পারে, নজরুল তাই প্রমাণ করেছেন।

পারলৌকিক মহাশক্তিধর রাব্বুল আলামিনের উদ্দেশে পশু কুরবানির সঙ্গে ইংরেজদের বলি করার একই অর্থ বহন করে। ওই সাম্রাজ্যবাদী শোষকদের হত্যা করার মধ্য দিয়ে শক্তির উদ্বোধন করতে চেয়েছেন নজরুল।

আস্তানা সিধা রাস্তা নয়,

‘আজাদী’ মেলে না পস্তানো’য়!

দস্তা নয় সে সস্তা নয়!

তার মানে আজাদী সস্তা নয়। এর মূল্য অসীম, যা সীমার মধ্যে বদ্ধ নয়। জীবন পস্তালেই যে আজাদী মানে স্বাধীনতা আসবে, এমন সোজা রাস্তা না এটা। শুধু রক্ত দিলেই হবে না, শক্তির উদ্বোধনও করতে হবে, যার মানে স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই করার জন্য শরীর-মন ও আশা আকাঙ্ক্ষাকে প্রস্তুত করতে হবে। আর সেটাই তিনি আবাহন করেছেন কোরবানি কবিতায়, জনআকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসাবে।

ওরে সত্য মুক্তি স্বাধীনতা দেবে এই সে খুন-মোচন

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন।

কুরবানি যে স্বাধীনতার দ্যোতক, সে কথাই তিনি বলেছেন। এই বলা কেবল মুখে উচ্চারণের মধ্যেই সীমায়িত নয়, আমাদের রিচুয়ালের তরঙ্গে তিনি উড়িয়ে দিয়েছেন তার আহ্বান। এ কবিতার শেষ স্তবকে তিনি কুরবানির আসল চেতনার ছবি ভাষায় এঁকেছেন।

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!

জোর চাই, আর যাচ্ না নয়,

কোরবানী-দিন আজ না ওই?

বাজ্ না কই? সাজ্ না কই?

কাজ না আজিকে জান্ মাল দিয়ে মুক্তির উদ্ধরণ?

বল্“যুঝ্ বো জান্ ভি পণ!”

ঐ খুনের খুঁটিতে কল্যাণ-কেতু, লক্ষ্য ঐ তোরণ,

আজ আল্লাহর নামে জান্ কোরবানে ঈদের পূত বোধন!

ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!

স্বাধীনতার আশার সঙ্গে চিরায়ত রিচুয়ালের এই যে মিথস্ক্রিয়া, তা নজরুলের মানসিক শক্তির কেবল পরিচয় বহন করে না, তার নতুন চিন্তারও উদ্বোধন ঘটায়। উত্তর-আধুনিকতার রাজপথটি হচ্ছে ঐতিহ্যের ব্যবহারের নবায়ন। আর সেই নবায়ন অবশ্যই নতুন মানে নির্মাণ করবে এবং চলমানতার নৌপথে তাকে আরও উত্তরের দিগন্তে নতুন পৃথিবী নির্মাণ করবে, যা বাংলা কবিতার, সাহিত্যের উত্তরণ বলে চিহ্নিত হবে। নজরুল সেই পথেরই উদ্বোধক শত বছর আগে সেই চারাটি রোপিত হয়েছে, তাকে দিগন্তের খোলা আসমানের মধ্যে পুঁতে রেখে ওপরের অনন্ত আকাশ ছুঁতে দেবে।

লেখক : কবি ও গবেষক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম