সম্ভাবনার মোটরসাইকেল শিল্পে স্থবিরতা
সহজ ব্যাংক ঋণ, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং দাম কমিয়ে চাহিদা বাড়ানো সম্ভব

সাদ্দাম হোসেন ইমরান
প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফলো করুন |
|
---|---|
বাংলাদেশ মোটরসাইকেল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে-এক দশক আগেও তা ছিল সবার কল্পনার বাইরে। ভোক্তার চাহিদা ও সরকারের নীতি সহায়তার কারণে এখন দেশীয় ইলেকট্রনিক্স কোম্পানিগুলো নিজস্ব ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল বানাচ্ছে। পাশাপাশি বিদেশি ব্র্যান্ডেরও মোটরসাইকেল উৎপাদন হচ্ছে। অবশ্য গণঅভ্যুত্থানপরবর্তী অস্থিতিশীলতার কারণে শিল্পে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। মূল্যস্ফীতি, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং ব্যাংক ঋণের অপ্রতুলতা ও উচ্চ সুদের কারণে মোটরসাইকেল বিক্রিতে ভাটা পড়েছে, যা শিল্পোদ্যাক্তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলছে।
দেশীয় ইলেকট্রনিক্স শিল্পকে উৎসাহ দিতে ২০১০ সালে রেফ্রিজারেটর ও মোটরসাইকেল উৎপাদনে স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেয় সরকার। পরে পর্যায়ক্রমে সেই অব্যাহতি সুবিধার মেয়াদ বাড়ানো হয়। কর অব্যাহতি সুবিধা পাওয়ায় দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগ শুরু করে। এতে ১০টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে মোটরসাইকেল উৎপাদন করছে। মোট চাহিদার ৯৮ শতাংশ মোটরসাইকেল বাংলাদেশেই উৎপাদন হয়। দেশীয় ইলেকট্রনিক্স কোম্পানিগুলোর মধ্যে যমুনা ইলেকট্রনিক্স পেগাসাস ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল উৎপাদন ও বিপণন করছে। আরেক দেশীয় প্রতিষ্ঠান রানার অটোমোবাইল নিজস্ব ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল বানায়। পাশাপাশি জাপানি ব্র্যান্ড হোন্ডা, সুজুকি ও ইয়ামাহা, ভারতীয় ব্র্যান্ড বাজাজ, টিভিএস ও হিরো বাংলাদেশে কারখানা স্থাপন করে পুরোদমে মোটরসাইকেল উৎপাদন করছে। এসব কারখানায় মোট বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। আর মোটরসাইকেল শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত।
প্রতিবছর বাংলাদেশে মোটরসাইকেলের চাহিদা কত, তার সঠিক পরিসংখ্যান সরকারি দপ্তরে নেই। তবে খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিবছর সাড়ে ৩ লাখ থেকে ৪ লাখ ইউনিট মোটরসাইকেলের চাহিদা রয়েছে। আর্থ-সামাজিক অস্থিতিশীলতকার কারণে মোটরসাইকেলের চাহিদা ক্রমশ কমছে। বিআরটিএ’র পরিসংখ্যানও বলছে সেই কথা। বিআরটিএ’র তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রায় ৪৭ লাখ মোটরসাইকেল নিবন্ধিত আছে। এর মধ্যে ২০২২ সালে ৫ লাখ ৬ হাজার ৯১২টি, ২০২৩ সালে ৩ লাখ ১০ হাজার ৪১৮টি এবং ২০২৪ সালে ২ লাখ ৬২ হাজার ৭১৫টি। অর্থাৎ ২০২২ সালের পর থেকে মোটরসাইকেল বিক্রি ক্রমশই কমছেই। ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত এক লাখ ১৭ হাজার ৪৩০টি মোটরসাইকেল নিবন্ধন নিয়েছে। বছর শেষে বিক্রি পরিমাণ ২ লাখ ছাড়াতে পারে বলে খাতসংশ্লিষ্টরা ধারণা করছে।
অবশ্য উচ্চগতির মোটরসাইকেল উৎপাদনের অনুমতি দেওয়ায় স্থবির মোটরসাইকেল শিল্পে গতি ফিরিয়ে এনেছে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে সরকার ৩৭৫ সিসি পর্যন্ত মোটরসাইকেল উৎপাদন ও বিপণনের অনুমতি দেওয়ায় তরুণ প্রজন্ম নতুন মোটরসাইকেল কেনায় ঝুঁকেছে। এ কারণে প্রায় সব উৎপাদক প্রতিষ্ঠানই এখন নিজেদের ব্র্যান্ডের উচ্চ সিসির বাইক বানাতে মনোযোগ দিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি এবং ডলারের সংকট ও ঊর্ধ্বগতির কারণে মোটরসাইকেলের বিক্রি কমছে। প্রথমত, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের আয় কমে যাওয়ায় মোটরসাইকেলের চাহিদা কমেছে। দ্বিতীয়ত, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব আমদানি খরচ বেড়েছে। পাশাপাশি কাস্টমসে উচ্চ শুল্ক পরিশোধ করতে হচ্ছে। এ কারণে বাজারে মোটরসাইকেলের দাম বেড়েছে। মূলত এ দুই কারণে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশে মোটরসাইকেলে দাম বেশি পড়ে। তৃতীয়ত, ঋণের অপ্রতুলতা। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে মোটরসাইকেল কেনার ক্ষেত্রে ব্যাংক সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে ঋণ দেয়, এমনকি মোটরসাইকেল বিক্রেতারাও ঋণ দেয়। বাংলাদেশের এ প্রচলন নেই। ব্যাংকগুলোকে ঋণ দিতে উদ্বুদ্ধ করা গেলে, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে পারলে, কর্মসংস্থান বাড়াতে পারলে এবং সর্বোপরি দাম কমানোর মাধ্যমে মোটরসাইকেলের চাহিদা বাড়ানো সম্ভব।
এ বিষয়ে টিভিএস অটো বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার রায় যুগান্তরকে বলেন, আর্থ-সামাজিক কারণে মোটরসাইকেল শিল্প চাপে আছে। গত ৩ বছর ধরে বিক্রি কমছে। অন্যদিকে সরকার শিল্পের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। এবারে বাজেটে মোটরসাইকেল উৎপাদনে ভ্যাট ও আয়কর বাড়ানো হয়েছে। যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিল্পের জন্য মোটেও যুতসই সিদ্ধান্ত নয়। অন্যদিকে ইঞ্জিন সংযোজনে কর সুবিধা দেওয়া হয়েছে, এটি ভালো উদ্যোগ। তবে এ সুবিধা সবাই পাবে না। শর্ত আরও শিথিল করলে শিল্প আরও সুফল পেত।
যমুনা ইলেকট্রনিক্সের পরিচালক (বিপণন) সেলিম উল্যা সেলিম বলেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে বাহন হিসেবে মোটরসাইকেল আদিকাল থেকে বেশ জনপ্রিয়। যানজট এড়াতে এখন উচ্চবিত্তরাও মোটরসাইকেল ব্যবহার করছে। তাই বাংলাদেশে মোটরসাইকেল শিল্পের সম্ভাবনা রয়েছে। এ বছর আমাদের ভালো বিক্রি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ২০১৪ সাল থেকে যমুনা ইলেকট্রনিক্স পেগাসাস ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল উৎপাদন করছে। ভোক্তাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে সাশ্রয়ী দামে দেশিয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একমাত্র যমুনাই মোটরসাইকেল বিক্রি করছে। পেগাসাস মোটরসাইকেলে মাইলেজও ভালো পাওয়া যায়।